অসঙ্গতির অভিযোগ তুলে সূর্যদের কক্ষত্যাগ, ধৈর্য ধরতে আবেদন মুখ্যমন্ত্রীর
বিরোধী-শূন্য সভায়
পাশ সিঙ্গুরের বিল
ছরতিনেক আগে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ধরে ফিরতে ফিরতে সিঙ্গুরের অধিগৃহীত জমিতে তখনও নির্মীয়মাণ টাটাদের কারখানার দিকে তাকিয়ে সফরসঙ্গী দলীয় নেতা কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, “সিঙ্গুরের এই জমি আমি অনিচ্ছুক চাষিদের হাতে ফিরিয়ে দেবই!”
সেই প্রতিজ্ঞা পালনে একটি বড় ধাপ এগোলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
এবং তা করলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসার এক মাসেরও কম সময়ে! মঙ্গলবার বিরোধীশূন্য বিধানসভায় (শেষ মুহূর্তে প্রধান বিরোধী দল সিপিএমের নেতৃত্বে বামফ্রন্ট কক্ষত্যাগ করে) ধ্বনিভোটে পাশ হয়ে গেল সিঙ্গুর-বিল। যে বিলের মাধ্যমে সিঙ্গুরে অধিগৃহীত ৯৯৭.১৭ একর জমির পুরোটাই ফিরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করল রাজ্য সরকার। আর বিল নিয়ে বিতর্কে ‘স্বতঃপ্রণোদিত’ হয়ে বক্তৃতা দিতে উঠে মুখ্যমন্ত্রী বললেন, “সিঙ্গুরের অনিচ্ছুক কৃষকদের জমির স্বত্ব দিয়ে পুরোপুরি মালিকানা দেওয়া হবে।” বিধানসভার দর্শক-গ্যালারিতে তখন সিঙ্গুরের বেশ কিছু ‘অনিচ্ছুক’ কৃষকদের পরিবার। যাঁদের মধ্যে ছিলেন সিঙ্গুর-আন্দোলনের সময় ধর্ষিতা এবং নিহত তাপসী মালিকের বাবা মনোরঞ্জন মালিকও। বিল পাশ হওয়ার পর বিধানসভা চত্বরে যাঁদের মাঝখানে নেমে এলেন মমতা। যিনি সভায় তুমুল বিতর্ক এবং হইচইয়ের মধ্যে বলেছেন, “এই সিঙ্গুর-বিল সারা পৃথিবীকে পথ দেখাবে। এটি এক ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ দিন। সিঙ্গুরের সবাইকে অভিনন্দন ও নমস্কার। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সুবিচার দিতে এই বিল আনা হয়েছে। এই বিল তৈরি করার আগে বাংলার মাটির কথা মনে পড়ছে।” মমতা আরও জানান, সিঙ্গুরের খেতমজুরদের জন্য আলাদা প্যাকেজ তৈরি করবে রাজ্য সরকার।
মমতার মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকের প্রথম সিদ্ধান্তই ছিল সিঙ্গুরের ‘অনিচ্ছুক’ কৃষকদের জমি ফেরত দেওয়া। সে দিক দিয়ে তাঁর প্রতিশ্রুতি পালনে আরও এক ধাপ এগোলেন নতুন মুখ্যমন্ত্রী। দৃশ্যতই তৃপ্ত মমতা এ দিন বিল পাশের পর বলেন, “সিঙ্গুরের মানুষের আন্দোলনের জয় হল।” বিধানসভায় বিলটি পাশ হওয়ার পর সেটি এখন রাজ্যপালের কাছে পাঠানো হবে।
লক্ষ্যপূরণের তৃপ্তি। মঙ্গলবার সিঙ্গুর বিল পাশের পরে বিধানসভা চত্বরে সিঙ্গুরের
অনিচ্ছুক কৃষকদের একাংশ ও অন্যদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজীব বসু
এ দিন ‘সিঙ্গুর পুনর্বাসন ও উন্নয়ন বিল’ নিয়ে ঘণ্টাদুয়েক আলোচনায় বিরোধী বামফ্রন্টের বিধায়কেরা জানিয়ে দেন, কৃষকদের জমি ফেরতের বিষয়ে তাঁদের ‘নীতিগত আপত্তি’ নেই। কিন্তু এই আকারে এই বিল তাঁরা সমর্থন করছেন না। কারণ, সরকার যে নতুন আইন করতে চাইছে, তার সঙ্গে দেশের সংবিধান ও কেন্দ্রীয় আইনের বিরোধ রয়েছে। বস্তুত, বিরোধীদের পক্ষে বিতর্ক শুরু করে প্রাক্তন ভূমিমন্ত্রী আব্দুর রেজ্জাক মোল্লা মুখ্যমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে বলেই বসেন, “ভূমি দফতর তো আপনার হাতে রয়েছে। ওই দফতরের আমলারা আমাদের ডুবিয়েছেন। তাঁদের উপর নজর রাখবেন। ওখানকার আমলারা শিল্পপতিদের সঙ্গে লাইন করে তাদের সুবিধা দেয়। অবসরের পরে আবার তাদের সংস্থায় কাজে যোগ দেয়। ওটা একটা ঘুঘুর বাসা!” মমতা অবশ্য পাল্টা জানিয়ে দেন, আমলাদের উপর তাঁর ‘পূর্ণ বিশ্বাস এবং আস্থা’ রয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, “আমি আমলাদের বিশ্বাস করি। এখন আপনারা হেরে গিয়ে তাঁদের উপর দোষ চাপাচ্ছেন! তাঁরা আমায় ভুল বোঝাবেন না। আমি তাঁদের নিয়েই কাজ করব।”
যে আকারে বিলটি আনা হচ্ছে, তা নিয়ে সোমবারই প্রশ্ন তুলেছিলেন বিরোধীরা। এ দিনও সভায় তাঁরা বলেন, শিল্প দফতর কেন জমি সংক্রান্ত এই বিল আনল। কিন্তু বিরোধীরা আগে এ কথাও জানিয়েছিলেন যে, তাঁরা নীতিগত ভাবে বিলটি সমর্থন করেন। বিতর্কে অংশ নিয়ে রেজ্জাক এ দিন বলেন, “ইচ্ছুক-অনিচ্ছুক ভাগ করবেন না। সব চাষিকেই জমি ফেরত দিন।” যার জবাবে আবার মমতা বলেন, “অনিচ্ছুক-ইচ্ছুক ভাগাভাগি আমি চাইনি। এটা করতে বাধ্য করা হয়েছে! তা সত্ত্বেও অনেক চাষি টাকা নিতে রাজি হননি।” বিলের ভুলত্রুটি নিয়ে বিরোধীরা প্রশ্ন তোলায় মমতা বলেন, “আপনারা টেকনিক্যাল কারণ তুলতেই পারেন। আমি অত ভাল আইন বুঝি না। কিন্তু অনিচ্ছুক কৃষকদের জমি ফিরিয়ে দেওয়াই আমাদের অগ্রাধিকার।” মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেন, “টেকনিক্যাল ও প্র্যাক্টিকাল অবস্থার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। বিলটি শিল্প দফতর এনেছে, কারণ তারাই (শিল্প দফতরের অধীন রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগম) টাটাদের জমিটা দিয়েছিল। জমি ফিরে পেতে তারাই বিল এনেছে। তাদের হাতে জমি এলে তা ভূমি দফতরের হাতে তুলে দেওয়া হবে। তারা ওই জমি চাষিদের ফিরিয়ে দেবে।” প্রসঙ্গত, এ দিন বিধানসভা থেকে মহাকরণে ফিরেই মমতা ভূমি দফতরের সচিবকে ডেকে পাঠিয়ে বিলের বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ করার নির্দেশ দিয়েছেন।
সিঙ্গুরের বিল আনতে সরকার তাড়াহুড়ো করেছে বলেও বিরোধীরা অভিযোগ করেছেন। তাঁদের বক্তব্য, সিপিএমের প্রয়াত বিধায়ক মোস্তাফা বিন কাশেমের জন্য শোকপ্রস্তাব নিয়ে এক দিনের জন্য অধিবেশন ছুটি দেওয়া উচিত ছিল। তা না-করে তাড়াহুড়ো করে সরকার একই দিনে বিল পেশ করল কেন? জবাবে মমতা বলেন, “আমি সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পাই। গত ৩৫ বছরে বাংলায় কিছু হয়নি। আমরাও ঘুমিয়ে কাটাব, আমাদের এই মানসিকতা নেই। তাই দ্রুত কাজ না-করে উপায় নেই।” একই সঙ্গে বিরোধীদের প্রতি মুখ্যমন্ত্রীর পাল্টা আবেদন, “এত তাড়াতাড়ি ধৈর্য হারাবেন না। ধৈর্য তৈরি করুন। এই সরকারের সবে এক মাস হয়েছে। আগে কিছু কাজ করতে দিন! তার পর ভুল ধরবেন।”
আলোচনায় বামেরা সরাসরি বিলের বিষয়বস্তুর বিরোধিতা না-করলেও প্রশ্ন তোলেন, কেন এ জন্য একটি নতুন আইন করা হচ্ছে? বিরোধী দলনেতা সিপিএমের সূর্যকান্ত মিশ্রের বক্তব্য, “প্রথমত, কেন্দ্রীয় জমি অধিগ্রহণ আইন (১৮৯৪) সংশোধন করে একটি ‘নতুন অনুচ্ছেদ’ যোগ করে এ কাজ করা যেত। যেমন করেছে তামিলনাড়ু। দ্বিতীয়ত, নতুন বিলে ‘অনিচ্ছুকদের’ জমি ফেরত দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ, যে কৃষক ‘সুনা’ বা বহু ফসলি জমি দিয়েছেন, তিনি ‘শালি’ জমি (যে জমির উর্বরতা কম) ফেরত পেতে পারেন। এটা সংবিধানের ১৪ নম্বর ধারার বিরোধী। তৃতীয়ত, ‘ট্রান্সফার অফ প্রপার্টি’ আইন মেনে টাটাদের সঙ্গে সহজে লিজ-চুক্তি বাতিল করা যেত।” তাঁর আরও বক্তব্য, “তিন বছরের মধ্যে উৎপাদন শুরু করতে না-পারার জন্য টাটাদের কাছ থেকেই ক্ষতিপূরণ চাওয়া উচিত ছিল। সেখানে টাটাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে বলে সরকার বিলে উল্লেখ করেছে। আগের সরকার জমি ফেলে রাখার জন্য টাটাদের কাছে ক্ষতিপূরণ চেয়েছিল। চতুর্থত, সংবিধানের একাধিক ধারার সঙ্গে সংঘাত বাধবে বিলের।”
বিরোধী দলনেতার মতে, “একাধিক কেন্দ্রীয় আইন সংশোধন করে এই কাজ করা যেত। এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের অনেক রায়ও আছে। তা না-করে নতুন আইন করতে চাওয়ায় জটিলতা তৈরি হতে পারে। কেন্দ্রীয় আইনের সঙ্গে সংঘাত হতে পারে।” এই বিল পাশ করালে তা সংবিধানের পরিপন্থী (আল্ট্রা ভাইরাস) হবে বলেও মনে করেন বিরোধী দলনেতা। ‘নীতিগত ভাবে’ চাষিদের জমি ফেরত দেওয়া নিয়ে আপত্তি নেই জানিয়েও তিনি বলেন, “যে উদ্দেশ্য নিয়ে এই বিল আনা হয়েছে, তাতে সমস্যা মিটবে কি না সন্দেহ!” মুখ্যমন্ত্রীকে লক্ষ্য করে তিনি বলেন, “এই বিল আনতে যাঁরা আপনাকে পরামর্শ দিয়েছেন, তাঁরা আপনাকে ভুল পথে পরিচালিত করেছেন।” বিরোধীদের পক্ষে বলেন আরএসপি-র সুভাষ নস্কর, ফরওয়ার্ড ব্লকের অক্ষয় ঠাকুর এবং সিপিআইয়ের আনন্দময় মণ্ডল। প্রত্যেকেই অবশ্য জানান, জমি ফিরিয়ে দেওয়ার বিষয়ে তাঁদের আপত্তি নেই। কিন্তু বড্ড ‘তাড়াহুড়ো’ করে বিল আনা হল!
যার জবাবে রাজ্যের মন্ত্রী তথা সিঙ্গুরের বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য পাল্টা বলেন, “বিগত সরকারের শপথের দিনই ঘোষণা হয়েছিল, টাটাদের এক হাজার একর জমি দেওয়া হবে। অথচ সেই ঘোষণার আগে স্থানীয় বিধায়ক হিসেবে আমি জানতে পারিনি। সিঙ্গুরের কৃষক, এমনকী, স্থানীয় সিপিএম নেতাদেরও কিছু জানানো হয়নি!” তাঁর পাল্টা প্রশ্ন, “টাটাদের জমি দেওয়ার জন্য এত তাড়াহুড়োর কী ছিল?” সিঙ্গুরের কৃষিজমি রক্ষা কমিটির নেতা তথা অধুনা হরিপালের বিধায়ক বেচারাম মান্না বলেন, “মমতা আর জনতা এই শক্তিকে রোখার ক্ষমতাকারও ছিল না। রাজ্যের মানুষ সিঙ্গুরে যাবতীয় অন্যায়ের জবাব দিয়েছেন।” কংগ্রেসের অসিত মিত্রও বলেন, “এই বিল দ্রুত আনাই উচিত ছিল! সরকার সেটাই করেছে।” কংগ্রেসের রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আবেদন করেন, “সিঙ্গুরে ইচ্ছুক অনেকের কাছ থেকেও হয়তো জোর করে জমি নিয়েছিল সরকার। তাঁদের ক্ষতিপূরণের দিকটিও ভেবে দেখার অনুরোধ করছি।”
নতুন বিলের সূত্রেই রাজ্যের প্রস্তাবিত নতুন জমি-নীতি তৈরির প্রসঙ্গ তুলে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “১৮৯৪ সালের কেন্দ্রীয় জমি অধিগ্রহণ আইনটি একটি কালা কানুন। কেন্দ্রীয় সরকার ওটা ঠিক করছে। কিন্তু আমরা রাজ্যের জন্য আলাদা জমি-নীতি তৈরি করছি। এ জন্য কমিটি করা হয়েছে। জোর করে, বন্দুক দেখিয়ে জমি দখল করবে না আমাদের সরকার। ভাত দেওয়ার ক্ষমতা নেই, কিল মারার গোঁসাই তা হবে না!” বিলটি পেশ করেছিলেন শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। জবাবি বক্তৃতায় তিনি বলেন, “জানতাম, বিরোধীদের থেকে এমন সব প্রশ্ন আসবে। সরকার সব দিক বিবেচনা করে, আইনানুগ বিষয় সম্মিলিত ভাবে দেখে বেশ কয়েকটি সংশোধনী-সহ এই বিল সভায় এনেছে।”
‘সর্বসম্মতিক্রমে’ বিলটি পাশ করার জন্য মুখ্যমন্ত্রী ও শিল্পমন্ত্রী বিরোধীদের কাছে আবেদন জানান। কিন্তু বিরোধী দলনেতা সূর্যবাবু ‘পয়েন্ট অফ অর্ডার’ তুলে বলেন, “আমরা কয়েকটি সাংবিধানিক সমস্যার কথা তুলে ধরেছিলাম। কিন্তু শিল্পমন্ত্রী তার একটিরও জবাব দেননি। মুখ্যমন্ত্রীও সভাকে বিভ্রান্ত করেছেন!” স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় সূর্যবাবুর ‘পয়েন্ট অফ অর্ডার’ খারিজ করে দেওয়ায় বিরোধী দলনেতার নেতৃত্বে ফ্রন্টের বিধায়করা সভাকক্ষ ত্যাগ করেন।
Previous Story South Next Story



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.