প্রবন্ধ ২...
চাই নিয়ন্ত্রণমুক্ত জমির বাজার
য়েক বছর আগে অমিতাভ বচ্চন তাঁর চল্লিশ বছরের কর্মভূমি মুম্বইয়ের উপান্তে এক টুকরো কৃষিজমি কিনতে পারেননি, যতক্ষণ না তিনি প্রমাণ করেছেন যে উত্তরপ্রদেশে তিনি ও তাঁর পরিবার চাষবাস করেন। উত্তরাখণ্ডে এক ব্যবসায়ী একই জমি কেনার জন্য দু’বার দাম দিয়েছেন, কেননা বিক্রেতা আদি মালিক নয়, দিল্লিস্থ পরিবারের অমতে সে পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করেছিল। এগুলো বিচ্ছিন্ন দৃষ্টান্ত নয়, দেশের জমি আইন এবং জমির সরকারি নথিভুক্তির দৈন্যদশাই এতে প্রকট। এর জন্য দায়ী রাজনীতি। স্বাধীনতার পর থেকে এ দেশের রাজনীতিকরা বণ্টনের সাম্য এবং দরিদ্রদের সুরক্ষার নামে ক্রমাগত জমি ও সম্পত্তির অধিকারের উপর আক্রমণ শানিয়েছেন। আজ আমলাতান্ত্রিকতার জাঁতাকলে জমি-মালিকরাও তাঁদের সম্পদের প্রকৃত মূল্য থেকে বঞ্চিত। তাঁরা গরিব হয়ে গিয়েছেন, জমিকে কৃত্রিম ভাবে অ-পর্যাপ্ত করে তোলা হয়েছে। জমি সংক্রান্ত জালিয়াতিও বেড়েছে বহু গুণ। জমি-মাফিয়া, অসাধু প্রোমোটার ডেভেলপাররা রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় প্রাধান্য বিস্তার করেছে।
সৌভাগ্য, গণতন্ত্র ভারতের গভীরে শিকড় চারিয়েছে এবং নাগরিকরা ক্রমেই গণতন্ত্রের সঙ্গে সম্পত্তির অধিকারের প্রতীকী সম্পর্কটির গুরুত্ব বুঝছেন। গত এক দশক ধরে দেশের নীতি-নির্ধারকরা জমি থেকে উচ্ছেদজনিত প্রতিবাদের মুখোমুখি হতে বাধ্য হয়েছেন। ২০০৬ সালের অরণ্য অধিকার আইনে বনভূমির সংলগ্ন অঞ্চলে বসবাসকারী ৯ কোটি জনজাতীয় ভূমিপুত্রের বনের জমির উপর অধিকার মেনে নিয়েছে। আইনটির প্রয়োগ এখনও সে ভাবে শুরু হয়নি। অন্য একটি প্রস্তাবিত আইনে গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক জমি মালিকদের সুস্পষ্ট মালিকানার দলিল হাতে দেওয়ার কথা বলছে। চলতি আইনে উকিলরা জমি-বিবাদের সময় বর্তমান দলিলের আগের সব দলিল খুঁজে বের করতে বাধ্য ছিলেন। ভূমি দফতরের দুর্নীতি ও দীর্ঘসূত্রিতার মধ্যে এ কাজ প্রায় দুঃসাধ্য। প্রস্তাবিত আইনে সরকার যাকে একবার জমির মালিক বলে মেনে নিচ্ছে, তাকে মালিকানার আর কোনও প্রমাণ দিতে হবে না। যদি কেউ নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে বিপরীত প্রমাণ নিয়ে হাজির হয়, তবু মালিকানার পরিবর্তন হবে না, দাবিদারকে ক্ষতিপূরণ দিয়ে দেওয়া হবে। এই আইনের লক্ষ্য একটাই, জমির মালিকানা সংক্রান্ত সরকারি নথির মহাফেজখানা সাফ করা।
পাঁচ বছরের মধ্যে জমি-সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য যন্ত্রগণকে পুরে ফেলা হবে। কিন্তু তার সঙ্গে পুরনো দলিলকেও নথিভুক্ত করলে সমস্যা। যন্ত্রগণকের তথ্যপঞ্জির সঙ্গে কাগজের দলিল-দস্তাবেজও সমান গুরুত্ব পেলে জালিয়াতি ও কারচুপির সম্ভাবনাও রয়ে যাবে। তা ছাড়া দেশে ৪০ থেকে ৮০ কোটি পৃথক জমি মালিকানা রয়েছে। কেবল প্রশাসনিক দক্ষতা দিয়ে এই বিপুল দাবির নিষ্পত্তি অসম্ভব। এতে জনতার অংশগ্রহণ জরুরি। দুর্নীতি রোধ করাও প্রয়োজন। জমি কেনাবেচার রেজিস্ট্রেশন ফি এবং স্ট্যাম্প ডিউটি মারফত এই দুর্নীতি চলে। রাজ্যগুলিও এ বাবদ প্রাপ্ত রাজস্ব ছাড়তে নারাজ। কিছু বিশেষজ্ঞ কমিটি কিন্তু পরামর্শ দিয়েছে, এই ডিউটি বা ‘ফি’ রদ করে দিলে এমন কিছু রাজস্ব ক্ষতি হবে না। ডিউটি কমাতে জমির দাম কমিয়ে দেখানো, পাওয়ার অব অ্যাটর্নি নিয়োগ করে কেনাবেচা বহুমুখী করে তোলা, কর ফাঁকি দিতে বিক্রয়লব্ধ অর্থ ঋ ণ হিসাবে দেখানো, ৬০ শতাংশ নগদে লেনদেন করে বাকিটা আয়কর কর্তৃপক্ষকে দেখানো এ সব সমস্যার সমাধান কঠিন।
ক্ষমতায়ন! লালগড়, ২০১০।
২০০৬-এর এক সমীক্ষা দেখাচ্ছে, ভারতীয় চাষিদের অন্তত ৪০ শতাংশ জমি বেচে অন্য পেশায় যেতে আগ্রহী, কিন্তু তাঁরা কৃষিজমি-সংক্রান্ত কানুনি জটিলতায় ক্রেতা পান না। আবার এ বছরই এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, শহরবাসীদের ৪০ শতাংশ বস্তিবাসী। জমির অপ্রতুলতা এখানে গরিবদের জন্য সস্তার আবাসন ও আর্থিক রুজির সুযোগ কমিয়েছে। পরিবেশবিদদের সরব আপত্তি অগ্রাহ্য করে ২০০৬ সালে আদিবাসীদের জমি-মালিকানা শিরোধার্য করে অরণ্য অধিকার আইন পাশ হয়। এই আইন অনুযায়ী এক বছর আগে পর্যন্ত ব্যবহার করা বনের জমির চার হেক্টর পর্যন্ত প্রতিটি আদিবাসী পরিবার দাবি করতে পারবে। কিছু ত্রুটি থাকলেও এই আইন ভারতীয় সমাজের সবচেয়ে প্রতারিত অংশটির ক্ষমতায়নে সহায়ক হতে পারে। এদের আর্থিক উন্নতি হলে রাজনৈতিক সমীকরণ পাল্টাতে পারে, মাওবাদীদের জনসমর্থনের ভিত নড়ে যাওয়া অসম্ভব নয়।

উদ্যোগ কার?
মুশকিল হল, রাষ্ট্র এই সব আইনের কার্যকারিতা বুঝতে বড় বেশি সময় নেয়। কিছু অসরকারি সংস্থা এগিয়ে এসেছে। গুজরাতের এ আর সি এইচ বাহিনী যেমন। অত্যাধুনিক জি পি এস প্রযুক্তি ব্যবহার করে স্থানীয় কৃষকদের সহায়তায় ওরা গুগ্ল ম্যাপ-এ মালিকানা সংক্রান্ত তথ্য স্থানান্তরিত করছে। স্থানীয় চাষিরাও মহা উৎসাহে নিজেদের বিরোধ মিটিয়ে এই প্রথম বাপ-দাদার চষা জমির দলিল হাতে পেতে উন্মুখ। সারা দেশেই এ ধরনের অসরকারি উদ্যোগ ছড়িয়ে পড়া উচিত। সরকার যদি সম্পত্তির অধিকার রক্ষার প্রাথমিক কাজটায় আরও গুরুত্ব দিত, মাওবাদী আন্দোলনের গণভিত্তিই ধসে যেত।
জমির বিষয়টি ভারতীয় সংবিধানের রাজ্য তালিকাভুক্ত। তাই রাজ্যগুলিকে আইন প্রণয়নে উৎসাহিত করতে রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রয়োজন। ভারতের দারিদ্রের কারণ পুঁজির ঘাটতি নয়, জমিকে সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ রূপে গণ্য করার এবং তার যথার্থ উপযোগ করায় ব্যর্থতা। এই সংস্কার ব্যয়বহুল নয়, চাই নতুন উপলব্ধি। মালিকানার দলিল এক টুকরো কাগজের বেশি কিছু নয়, যদি তাকে সম্পদের মালিকানা রূপে সম্মান করা না যায়। প্রাচীন গ্রিক নগর-রাজ্য থেকে শুরু করে গত দু হাজার বছরের সভ্যতার ইতিহাস দেখায়, সম্পত্তির মালিকানার উপরেই তৈরি হয়েছে নাগরিকত্বের ভিত। অন্য দিকে ভারত একটি গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হয়ে ওঠে প্রাপ্তবয়স্কের সর্বজনীন ভোটাধিকারে ঋদ্ধ হয়ে। ভারতীয় সংবিধান সম্পত্তির অধিকারকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দিলেও তার রাজনৈতিক স্বীকৃতি সর্বদাই দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। ১৯৭৮ সালে তো মৌলিক অধিকারের ফর্দ থেকে এই অধিকার রদ করেই দেওয়া হয়।
আজ দেশের নানা স্থানে জমির অধিকার নিয়ে প্রতিবাদের বহর দেখিয়ে দিচ্ছে, ভারতবাসী সম্পত্তির অধিকার পুনরুদ্ধার করতে বদ্ধপরিকর। আদালতগুলি সাম্প্রতিক কালে জমি অধিগ্রহণের পক্ষেই রায় দিয়েছে, তা সে উত্তরপ্রদেশের যমুনা এক্সপ্রেসওয়ে হোক, বা সিঙ্গুরের টাটা ন্যানো প্রকল্প। কিন্তু অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে জনরোষের সামনে রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ অনেক ক্ষেত্রেই আইনি সম্মতির সুযোগ নিতে পারেনি। জমির জন্য বাজার চাই-- নিয়ন্ত্রণমুক্ত ও করের বোঝামুক্ত বাজার, যে বাজারে ব্যক্তিরা অবাধে দরকষাকষি করতে পারে, সম্পত্তির কেনাবেচা করতে পারে। ভারতীয় গণতন্ত্র ও উন্নয়নের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে জমি ও সম্পত্তির বাজারকে আমরা রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করতে পারছি কি না, তার উপর।

লেখক দিল্লিতে লিবার্টি ইনস্টিটিউট-এর অধিকর্তা

(শেষ)
Previous Item Editorial Next Item



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.