প্রবন্ধ ৩...
ওঁরা ক্ষমতা চান না, সেটাই রাষ্ট্রের সমস্যা
বিনায়ক সেনকে ক্ষমতাবানরা ভয় পায়। কেন? তার একটা কারণ সম্ভবত এই যে, তাঁকে ক্ষমতাবানরা তাদের চেনা ছকে মেলাতে পারে না। কথাটা একটু ব্যাখ্যা করা দরকার। আর সে জন্য প্রথমেই খেয়াল করা দরকার যে, বিনায়কের চিন্তাভাবনা এবং কর্মধারা বিশেষ ভাবে শংকর গুহ নিয়োগীর চিন্তাধারার দ্বারা প্রভাবিত। ভিলাই ইস্পাত কারখানার শ্রমিক শংকর গুহ নিয়োগী এক নতুন ধরনের শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। তিনি কেবল বেতনবৃদ্ধির আন্দোলন করেননি, শ্রমিকের সার্বিক উন্নতির কথা ভেবেছিলেন। শ্রমিকের দৈনন্দিন জীবনযাপন কী ভাবে সুন্দর হয়, তারও একটি রূপরেখা তৈরি করেন তিনি। ট্রেড ইউনিয়ন বলতে তিনি কেবল কারখানার ঘণ্টার হিসাব বুঝতেন না, গোটা জীবনটাই বুঝতেন। তাই তাঁর আন্দোলনে মদ্যপান-বিরোধিতা, পরিবেশ তথা জঙ্গলকে জানা, শিক্ষা (বিশেষত মেয়েদের ও বাচ্চাদের), বিনোদন ইত্যাদি মানুষের জীবনের নানান দিকের ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল। তার সঙ্গে অবশ্যই বেতনবৃদ্ধি বা বোনাসের জন্য আন্দোলন হয়েছে, তবে সেটাই ট্রেড ইউনিয়নের মুখ্য কাজ হয়ে দাঁড়ায়নি।
আশির দশকের শুরুতে তাঁর এই কর্মযজ্ঞে পশ্চিমবঙ্গ থেকে এক ঝাঁক তরুণ ডাক্তার শামিল হন। নকশাল আন্দোলন তখন পশ্চিমবঙ্গে শেষ অবস্থায়। চতুর্দিকে ভাঙার আওয়াজ। কেবল ভেঙে যে কিছু হবে না, এই ধারণা তখন শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের অনেককেই চিন্তিত করেছে। শংকর গুহ নিয়োগীর মর্যাদার সঙ্গে ‘নির্মাণ’-এর এই আহ্বান তাই অনেকেরই গ্রহণযোগ্য মনে হয়। এক জন প্রসূতির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে শ্রমিকরা তাঁদের নিজস্ব স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন খুব তীব্র ভাবে। ট্রেড ইউনিয়নের মদতে তাঁরা নিজেরাই নিজেদের শ্রম আর অর্থ দিয়ে তৈরি করেন ‘শহিদ হাসপাতাল’।
সেখানেই চিকিৎসক ছিলেন বিনায়ক সেন। তিনি ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েননি। বস্তুত ডাক্তার হওয়ার পর শিশুরোগ নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে এক গভীরতর অসুখের সন্ধান পান তিনি দারিদ্র, অপুষ্টি, অশিক্ষা। সেখান থেকে আর ফিরে আসতে চাননি। দরিদ্র মানুষের সহায় হয়েই থেকে যান। এক বার একটি বিশেষ মহল্লায় বার-বার শিশুদের পেটের অসুখের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে বোঝা যায় যে, একটি বিশেষ ঝর্নার জল ওই অসুখের মূল। তখন শ্রমিকেরা একটি টিউবওয়েলের দাবি তুলে আন্দোলন শুরু করেন। এক বার গ্রামীণ মানুষ একটি সেতুর প্রয়োজনীয়তা খুব বেশি করে অনুভব করেন। অনেক বার সরকারকে জানিয়েও লাভ হয়নি। স্থানীয় শ্রমিক-কৃষকরা শ্রম ও অর্থ দিয়ে সেতুটি তৈরি করেন। তার পর যত টাকা খরচ হয়েছে, তার হিসাব দিয়ে সরকারের কাছে অর্থ আদায় করেন। অর্থ আদায়ের জন্য মহকুমা শাসককে ঘেরাও করাও হয়েছে।
এমন আন্দোলনের সঙ্গে ভারত-রাষ্ট্রের তেমন পরিচয় নেই। আমাদের দেশের শ্রমিক আন্দোলনকে হাতিয়ার করে সব দলই ক্ষমতা চেয়েছে। রাষ্ট্রক্ষমতা। আর তাই রাষ্ট্রের পক্ষেও তাকে মোকাবিলা করাটা সহজ হয়ে যায়। প্রয়োজন মতো, হিংস্র হয়ে বা নরম হয়ে, কখনও কিছু দিয়ে শ্রমিক আন্দোলনকে নানা ভাবে বাগে আনতে হয়েছে। কিন্তু শংকর গুহ নিয়োগী বা বিনায়ক সেনরা ক্ষমতা হস্তান্তরের খেলায় নেই। ‘জল-জমি-জঙ্গল’-এর অধিকার তাঁরা আদিবাসীদেরই দিতে চান, বিনিময়ে রাষ্ট্রক্ষমতার অংশীদারি চান না। এই কারণেই তাঁদের নিয়ে রাষ্ট্রের, বস্তুত সাধারণ ভাবে ক্ষমতাবানদের এত সমস্যা। তাঁদের চিন্তা ও কাজ রাষ্ট্রের হিংস্রতাকে উন্মোচিত করে দেয়। একটি পানীয় জলের টিউবওয়েলের জন্য যখন শ্রমিকরা আন্দোলন করেন, তখন প্রকাশিত হয়ে পড়ে যে, রাষ্ট্র পানীয় জলটুকুরও ব্যবস্থা করতে চায় না।
কোনও ধারাপাতে পড়ে না, এমন অঙ্ক কী করে মেলাবে রাষ্ট্র?

Previous Item Editorial First Page



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.