|
|
|
|
সম্পাদকীয় ২... |
ভুল দাবি |
ঔপনিবেশিক সংস্কৃতি নিপাত যাক এই দাবিতে সহসা মহানগর উত্তাল। কলিকাতার একটি অভিজাত ক্লাবে প্রবেশ করিবার জন্য বিধিবদ্ধ পোশাকের নিয়ম লইয়া ধুন্ধুমার বিতর্ক, বিক্ষোভ, আন্দোলন। এই বিতর্ক নূতন নহে, আগেও হইয়াছে। তবে এ বার তাহাতে ঝাঁঝ কিঞ্চিৎ অধিক, হয়তো পরিবর্তন-এর প্রভাবেই। প্রতিবাদীদের বক্তব্য, কেন বিধিবদ্ধ পোশাক না পরিলে ক্লাবে প্রবেশ করা যাইবে না? কেন ব্রিটিশ আমলের পুরনো কিছু ঐতিহ্য এখনও ক্লাবগুলি বহন করিবে? এই তর্কের বিসমিল্লায় গলদ। প্রতিবাদীরা ভুলিয়া যাইতেছেন যে, ক্লাব কোনও সর্বজনীন প্রতিষ্ঠান নয়, মুক্ত পরিসর নয়, তাহার পরিসরটি তাহার নিজস্ব। ক্লাব একটি স্বেচ্ছা-সংগঠন। সেই সংগঠনের নিজস্ব নিয়ম থাকে, থাকিবে। কোনও ব্যক্তি যখন ক্লাবের সদস্য পদ গ্রহণ করেন, তখন তিনি স্বেচ্ছায় ওই নিয়মগুলি মানিয়া লন। কেহ জোর করিয়া ব্যক্তির উপর ক্লাবের নিয়মাবলি চাপাইয়া দেয় না। সুতরাং ওই নিয়ম মানিয়া ক্লাবে যোগদান ব্যক্তির ব্যক্তিগত স্বাধীনতার একটি অঙ্গ, স্বাধীন চিন্তারও। কারণ তিনি চিন্তা করিয়াই এই ক্লাবের সদস্যপদে যোগদান করিয়াছেন। আবার, ক্লাব-সদস্য যদি অন্য কাহাকেও নিমন্ত্রণ জানাইয়া থাকেন, তাহা হইলে তাঁহারই অতিথিকে অবহিত করা উচিত যে, ক্লাবের কিছু নিয়ম রহিয়াছে যাহা মানিতে হইবে। প্রতিবাদীরা ইহার পরেও প্রশ্ন তুলিতে পারেন, নিমন্ত্রিতের উপর ক্লাবের নিয়ম মানিবার দায় চাপাইয়া দেওয়া যায় কি না? ইহাও ভুল প্রশ্ন। নিমন্ত্রিত ব্যক্তি যদি মনে করেন তাঁহার নিকট তাঁহার ব্যক্তিগত মতামত বা আচরণের স্বাধীনতা গুরুত্বপূর্ণ, তিনি যে পোশাক পরিয়া স্বছন্দ বোধ করেন তাহাই পরিবেন, কোনও অবস্থাতে তাহা ভিন্ন অন্য পোশাক পরিবেন না, তবে তাঁহার পূর্ণ স্বাধীনতা রহিয়াছে নিমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করিবার। কিন্তু নিমন্ত্রণ গ্রহণ করিয়া ক্লাবের নিয়ম অমান্য করিবার দাবি জানানো উচিত কাজ নহে। ইহা অন্যায় আবদার মাত্র। ঔপনিবেশিক সংস্কৃতি হইতে স্বাধীনতার দাবি নহে, নির্ভেজাল জবরদস্তি।
এই জবরদস্তি সম্ভবত বাঙালির মজ্জাগত। নিয়ম ও শৃঙ্খলা ভাঙিবার যথা-ইচ্ছা-আচারকে সে বৈপ্লবিকতা জ্ঞান করিয়া থাকে। নিয়ম না মানিয়া সে বড় গবর্বোধ করিয়া থাকে। ইহাকেই এক প্রকার স্বাধীনতা অনুশীলন বলিয়া মনে করে। এই স্বভাব তাহার আচরণে অহরহ প্রকট। যে নিয়ম স্বতঃসিদ্ধ, তাহাও ভাঙিবার মধ্য দিয়া সে আপন সার্বভৌমত্ব জাহির করিয়া থাকে। তাহার দাবি: রাস্তায় যান চলাচলের বিধি মানিব না, গাড়িঘোড়া আমায় দেখিয়া থমকাইয়া যাইবে, যদি না যায় তাহা হইলে চালকের দোষ; সিনেমা হলে মোবাইল ফোন বাজাইব, আমার জরুরি ফোন আসিতে পারে, অন্যের অসুবিধা হইলে হল ছাড়িয়া যাইতে পারে; আমার ইচ্ছা বা প্রয়োজন অপেক্ষা জরুরি জগতে আর কিছুই থাকিতে পারে না। নিয়ম মানিলে তবেই যে সমাজের প্রতি দায়িত্ব মান্য হয়, অন্যের স্বাধীনতাকে মর্যাদা দিলে তবেই যে আপন স্বাধীনতার মর্যাদা রক্ষিত হয়, এই ধারণা হইতে সে বিচ্যুত হইয়াছে। একটি সমাজের বিদ্বজ্জনের কাজ তাহাকে ঠিক পথে চালিত করা। ক্লাবের নিজস্ব পরিসরে তাহার নিজস্ব স্বাধীনতাকে মান্য করিতে শেখানো সেই সদাচরণের একটি দিক মাত্র। বাঙালির দুর্ভাগ্য, বিদ্বজ্জনরাও বিপথে চলিতে ব্যস্ত। তাঁহারা অগ্রপশ্চাৎ না ভাবিয়া অন্যায় দাবি তোলেন, অগ্রপশ্চাৎ না ভাবিয়া তাহাতে সমর্থন জানান। |
|
|
 |
|
|