বুদ্ধের পরামর্শ
‘প্রকৃত কৃষকদের’ জমি ফেরতের দাবি বামেদের
সিঙ্গুরে জমি ফেরতের বিল নিয়ে ‘নীতিগত’ আপত্তি না-তুললেও সেখানে যাতে ‘প্রকৃত কৃষকরা’ জমি ফেরত পান, বিধানসভায় বাম বিধায়কদের সেই দাবি তোলার পরামর্শ দিলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তাঁকে সমর্থন করেছেন প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেনও।
সিপিএমের এই দুই পলিটব্যুরো সদস্যই সিঙ্গুরে টাটাদের কারখানা গড়ার ব্যাপারে প্রধান উদ্যোগী ছিলেন। সিঙ্গুর-বিল নিয়ে বিধানসভায় বাম বিধায়কদের ভূমিকা ঠিক করতে সোমবার সন্ধ্যায় আলিমুদ্দিনে বৈঠক ডাকা হয়েছিল। সেখানেই বুদ্ধবাবু এ কথা বলেন।
‘অসুস্থতার কারণে’ বুদ্ধবাবু হায়দরাবাদে দলের পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে যাননি। কিন্তু এ দিনের বৈঠকে তিনিই মুখ্য ভূমিকা নেন। দলের তরফে বিল আনার পদ্ধতির বিরোধিতা করা হলেও বিলের মূল বক্তব্যের বিরোধিতা করা হবে না বলে আগেই ঠিক হয়েছিল। বৈঠকে বুদ্ধবাবু বলেন, ‘ইচ্ছুক-অনিচ্ছুক’ প্রসঙ্গে না-গিয়ে বিল-বিতর্কে অংশ নিয়ে বাম বিধায়কদের বলা উচিত, ‘প্রকৃত কৃষকরা’ যাতে জমি ফেরত পান, তা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। জমি ফেরত প্রক্রিয়ায় মাঝপথে দালাল বা প্রোমোটাররা যাতে লাভবান না হয়, সে বিষয়টিও বিধানসভায় তোলার পরামর্শ দেন বুদ্ধবাবু।
প্রসঙ্গত, মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন বুদ্ধবাবু বারবার বলেছেন, সিঙ্গুরে সাড়ে ১২ হাজার কৃষকের মধ্যে সিংহভাগ, প্রায় ১১ হাজার কৃষক ‘স্বেচ্ছায়’ জমি দিয়েছেন। তাঁরা শিল্পস্থাপনের জন্যই জমি দিয়েছেন। সুতরাং সেই জমি ফেরতের প্রশ্নই ওঠে না। বিধানসভার ভোটে জিতে ক্ষমতায় এলে সিঙ্গুরে শিল্প করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন তিনি।
এ দিনের বৈঠকে বিধানসভার বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র, প্রাক্তন ভূমিমন্ত্রী রেজ্জাক মোল্লা ছাড়াও ছিলেন কৃষক নেতা বিনয় কোঙার, বিধানসভার প্রাক্তন স্পিকার হাসিম আব্দুল হালিম, দুই প্রাক্তন আইনমন্ত্রী রবিলাল মৈত্র ও নিশীথ অধিকারী, দলের প্রবীণ নেতা দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রাক্তন মেয়র বিকাশ ভট্টাচার্য এবং একাধিক বিধায়ক। দলের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু হায়দরাবাদ থেকে না ফেরায় তিনি বৈঠকে ছিলেন না।
বৈঠকে হালিম সাহেব বলেন, বিলে কোথাও স্পষ্ট করে বলা নেই যে, ওই জমি ফিরিয়ে দেওয়ার পর তাতে কৃষিকাজ করতে হবে। কী পদ্ধতিতে ফেরত প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে, তা-ও উল্লেখ করা নেই। আরও বহু আইনি ফাঁক রয়েছে। ফলে এই বিলকে কার্যকর করার ক্ষেত্রে নানা আইনগত বাধা আসবে। বিকাশবাবুও একই মত দেন। সিঙ্গুরের জমি নেওয়ার প্রক্রিয়ায় প্রথম থেকেই বিনয়বাবু তৃণমূলের আন্দোলনকে তীব্র কটাক্ষ করেছেন। এ দিনও তিনি বলেন, এটা যে বিলের নামে ‘চমক’ হচ্ছে এবং কৃষকদের ‘প্রতারণা’ করা হচ্ছে, তা তুলে ধরতে হবে। কারণ, এ ভাবে কৃষকরা কেউ জমি ফেরত পাবেন না! মানুষকে তা বোঝাতে হবে।
কিন্তু বিনয়বাবুকে কার্যত থামিয়ে বুদ্ধবাবু বলেন, এখন এমন কোনও কথা বলা হলে ‘ভুল বার্তা’ যাবে। বরং বিলের ক্ষেত্রে বামেরা যদি কোনও কার্যকর সংশোধনী দিতে পারে, যা কৃষকদের স্বার্থের পক্ষে, তা হলে ভাল হবে। বৈঠকে বুদ্ধবাবু বারবার জোর দিয়ে বলেন, প্রকৃত কৃষকদের স্বার্থ যাতে ক্ষুণ্ণ না হয়, তাঁরা যাতে বঞ্চিত না হন, সরকার যাতে তা সুনিশ্চিত করে, সেটাই তাঁদের দেখা উচিত। বুদ্ধবাবুর কথাই গৃহীত হয়।
এ দিন সকালে বিধানসভায় সর্বদলীয় বৈঠকে সূর্যবাবু প্রস্তাব দেন, মঙ্গলবার সিঙ্গুর-বিল পেশ না-করে সিপিএম বিধায়ক মোস্তাফা বিন কাশেমের মৃত্যুতে শোকপ্রস্তাব গ্রহণ করে সভা মুলতুবি করে দেওয়া হোক। তার পর তিন-চার দিন ধরে রাজ্যপালের বক্তৃতার উপর বিতর্কের পর সিঙ্গুর বিলটি ধীরেসুস্থে পেশ করা হোক। তাতে বিতর্কে অংশ নিতে সুবিধা হবে। কিন্তু তা মানা হয়নি। বরং পরিষদীয় মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় পাল্টা বলেন, কোনও বর্তমান বিধায়কের মৃত্যুতে শোকপ্রস্তাব গ্রহণ করে সে দিনই আবার সভা শুরুর বহু নজির অতীতে রয়েছে। পরে সাংবাদিক বৈঠক করেও সূর্যবাবু বলেন, “গণতন্ত্র মানা হচ্ছে না। সভার অধিবেশনের জন্য আমাদের নোটিস দেওয়া হয়নি। ফোন করে পরিষদীয় মন্ত্রী অধিবেশনের কথা জানান। কার্য উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে বিলের খসড়া দেওয়া হলেও তা ঠিক মতো পড়ার সময় না দিয়েই মঙ্গলবার বিলটি পেশ করা হচ্ছে।” স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য জানিয়েছেন, সবাইকে যথারীতি নোটিস দেওয়া হয়েছিল।
নীতিগত ভাবে জমি ফেরতে আপত্তি না-থাকলে তাঁরা কেন ক্ষমতায় থাকার সময় জমি ফেরত দিলেন না? সেই প্রশ্নের সরাসরি জবাব এড়িয়ে গিয়ে কিছুটা উত্তেজিত ভাবে সূর্যবাবু বলেন, “যা বলার বিধানসভায় বলব! জমি ফেরত দেওয়া নিয়ে
আপত্তি নেই। কিন্তু বিলের নামে এমন কোনও চমক না হয়, যা বাস্তবে কার্যকরী হবে না।” সূর্যবাবু এ কথা বললেও তাঁর দলীয় সহকর্মী রেজ্জাক কিন্তু সাফ বলেন, “এরা যদি পারে, তা হলে ওরাও (বামফ্রন্ট সরকার) পারত।”
কিন্তু ‘ওরা’ করল না কেন? রেজ্জাকের জবাব, “দল আছে। বামফ্রন্ট আছে। মন্ত্রিসভাও আছে। আমি তো নাট-বল্টু ছিলাম! অনেক কিছু করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পারিনি!”
রেজ্জাকের কথা থেকে স্পষ্ট, তিনি জমি ফেরতের কথা তুললেও তখন বুদ্ধ-নিরুপম-সূর্যরা তা মেনে নেননি। প্রশ্নের জবাবে রেজ্জাক আরও জানান, প্রোমোটাররা যাতে কৃষিজমি কিনতে না পারে, তার জন্য তিনি একটি আইন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বামফ্রন্ট তাঁকে সেই আইন করতে দেয়নি। রেজ্জাকের কথায়, “আমি বলেছিলাম, কৃষিজমি কৃষকরা ছাড়া অন্য কেউ কিনতে পারবে না। তবে সরকার শিল্প বা উন্নয়নের জন্য জমি কিনলে সমস্যা নেই। তাতে প্রোমোটারদের ঢালাও ভাবে জমি কেনা আটকানো যাবে। কিন্তু বামফ্রন্ট সে কাজে রাজি হয়নি।”
দলের মধ্যে সূর্য-রেজ্জাকের কথায় পরস্পর-বিরোধিতা থাকলেও একটি বিষয়ে দলের নেতারা একমত। যে বিলটি আনা হচ্ছে, তা আইনগত ভাবে ‘দুর্বল’। রেজ্জাকের কথায়, “বিল পেশ করলেই হবে না। যে ভাবে বিল পেশ হচ্ছে, কেউ মামলা করলে তা আটকে যাবে!” একই কথা বলেন পেশায় আইনজীবী বিকাশবাবুও। তাঁর কথায়, “সরকার জমি অধিগ্রহণ করার পরে ইচ্ছুক-অনিচ্ছুক বলে কিছু হয় না। সে ক্ষেত্রে যিনি জমি দিয়ে চেক নিয়েছেন, তিনিও জমি ফেরত চাইতে পারেন। ৪০০ একরের বাইরে আরও বেশি জমি ফেরতের দাবি উঠতে পারে। এমনকী, পুরো ৯৯৭ একর জমি ফেরতেরও দাবি উঠতে পারে।” তিনি কি সেই মামলা লড়বেন? বিকাশবাবু বলেন, “আমি পেশাদার আইনজীবী। কেউ যদি বলেন, টাকা ফেরত দেব। জমি ফেরত দাও। তা হলে তাঁর হয়ে মামলা লড়ব!” তবে, আইনগত ‘ফাঁক’ থাকলেও বামেরা বিধানসভায় ‘কৃষকস্বার্থে’ই কথা বলবেন বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে। বিধানসভার ভোট তাঁদের সেই শিক্ষা দিয়ে দিয়েছে।
Previous Story Rajya Next Story



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.