|
|
|
|
আজ বিধানসভায় সিঙ্গুর বিল |
নিজেরটা নয়, সমপরিমাণ
জমি ফেরত অনিচ্ছুকদের
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
|
|
সিঙ্গুরের ‘অনিচ্ছুক’ মালিকদের থেকে যে পরিমাণ জমি নেওয়া হয়েছিল, সেই ‘সমপরিমাণ’ জমিই তাদের ফিরিয়ে দেবে সরকার। অর্থাৎ, কোনও ‘অনিচ্ছুক’ মালিকের থেকে যদি চার কাঠা জমি নেওয়া হয়ে থাকে, তা হলে সংশ্লিষ্ট মালিককে সেই চার কাঠা জমিই ফিরিয়ে দেবে সরকার। তবে তা সেই একই জমি নয়। আজ, মঙ্গলবার রাজ্য বিধানসভায় যে সিঙ্গুর-বিল পেশ করা হবে, তার খসড়াতে এই বিষয়টি স্পষ্ট করে বলে দেওয়া হয়েছে।
খসড়া বিলে বলা হয়েছে, ‘লিজ’ বা ‘বণ্টন-চুক্তি’ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে পুরো জমিটি (৯৯৭.১৭ একর) রাজ্য সরকারের হাতে আসবে। জমির প্রশাসনিক মালিকানা থাকবে হুগলির জেলাশাসকের হাতে। টাটা মোটর্স লিমিটেড এবং ভেন্ডার সংস্থাগুলি জমির মালিকানা দ্রুত না-ছাড়লে জেলাশাসক বা তাঁর মনোনীত কোনও আধিকারিক ‘প্রয়োজনীয় ক্ষমতা’ প্রয়োগ করে তা নিয়ে নিতে পারবেন।
সিঙ্গুর-বিল পেশ হওয়ার এক দিন আগে পর্যন্তও অবশ্য প্রস্তাবিত বিল নিয়ে টানাপোড়েন অব্যাহত। সোমবার সন্ধ্যায়ও রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন প্রস্তাবিত বিল নিয়ে আলোচনার জন্য রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়, আইনমন্ত্রী মলয় ঘটককে ডেকে পাঠান। দীর্ঘ বৈঠক চলাকালীন ডেকে নেওয়া হয় রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল অনিন্দ্য মিত্রকেও। বৈঠক শেষে সরকারি সূত্রে জানানো হয়েছে, মঙ্গলবার বেলা ১টায় নির্ধারিত সময়েই সিঙ্গুর-বিল বিধানসভায় পেশ করা হবে। বিলটি একই দিনে পাশ করানোর বিষয়েও সরকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তবে কেউ কোনও ‘সংশোধনী’ আনলে সেই জন্য প্রয়োজনীয় সময় দিতে রাজি সরকার। সেই বিষয়টি সরকার ‘খোলা মনে’ দেখছে বলেই প্রশাসনিক সূত্রের খবর। |
|
নানা মুহূর্তে । বিধানসভা অধিবেশনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সোমবার অশোক মজুমদারের তোলা ছবি। |
তবে মহাকরণ সূত্রের খবর, রাজ্যপাল খসড়া বিলের কয়েকটি বিষয় নিয়ে ‘জানতে চেয়েছেন’। সে জন্যই তিনি দুই মন্ত্রীকে ডেকে পাঠান। তার পর রাজ্যপাল রাজভবনে ডেকে পাঠান অ্যাডভোকেট জেনারেলকেও। দীর্ঘ চার ঘণ্টা বৈঠকের পর বেরিয়ে শিল্পমন্ত্রী পার্থবাবু জানান, বিল নির্দিষ্ট দিনে এবং নির্দিষ্ট সময়েই পেশ করা হবে।
প্রশাসনিক সূত্রে জানা গিয়েছে, সিঙ্গুর-বিল আইনি দিক দিয়ে ‘মানি-বিল’। অর্থাৎ, বিষয়টির সঙ্গে রাজ্য সরকারের অর্থ দফতরও জড়িত। তাই রাজ্যপাল বিস্তারিত ভাবে সমস্ত ধারা খতিয়ে দেখেন। প্রশাসনের একাংশ জানাচ্ছে, বিলটি কেন রাজ্যের শিল্প দফতর আনছে, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন রাজ্যপাল। কারণ, বিলটিতে বলা রয়েছে, সিঙ্গুরের জমি ‘খাস’ করে নেওয়া হবে। আইনগত দিক দিয়ে যে কোনও জমিই ‘খাস’ করার অধিকার রয়েছে একমাত্র ভূমি দফতরের। বিধানসভার ‘রুল্স অফ বিজনেস’ অনুযায়ী ওই বিল আনার কথা ভূমি দফতরেরই। কিন্তু সিঙ্গুর-বিল ভূমি দফতর নয়, আনছে শিল্প দফতর।
প্রশাসনের এক পদস্থ কর্তা জানিয়েছেন, খসড়া বিলে রাজ্যপাল ‘অনিচ্ছুক’ মালিকদের জমি ‘ফিরিয়ে দেওয়া’ (রিটার্ন) শব্দটির বদলে ‘সেট্ল’ শব্দটি ব্যবহার করার পক্ষে। তেমন হলে সেই বিষয়ে বিলটি পেশের সময়ই একটি সংশোধনী আনতে পারে সরকার পক্ষ। আইনজ্ঞদের মতে, ‘রিটার্ন’ এবং ‘সেট্ল’ শব্দ দু’টির মধ্যে ব্যবহারিক দিক দিয়ে মূলগত তেমন কোনও তফাত না-থাকলেও আইনি পরিভাষায় ফারাক রয়েছে। রাজ্যের এক প্রথম সারির আইনজীবীর কথায়, ‘‘সেট্ল শব্দটি এ ক্ষেত্রে ব্যবহার করে বোঝানো যেতে পারে যে, অনিচ্ছুকদের জমির প্রজাস্বত্ত্ব দেওয়া হল। কিন্তু মালিকানা রইল সরকারের হাতেই। সেটা অবশ্য যে কোনও জমির ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে। বিষয়টা একেবারেই কেতাবি। কিন্তু সিঙ্গুর-বিল নিয়ে যেহেতু বিতর্কের প্রভূত অবকাশ রয়েছে, তাই আটঘাট বেঁধে কেউ এগোতে চাইলে আপত্তির কিছু নেই।” রাজ্যপালের সঙ্গে সরকারের আলোচনার পর প্রাথমিক ভাবে ঠিক হয়েছে, তেমন হলে সরকার পক্ষের তরফে ওই বিষয়ে একটি সংশোধনী দেওয়া হবে।
তবে সোমবার রাত পর্যন্ত সরকারের তরফে ওই বিশেষ সংশোধনীর বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। বস্তুত, রাজ্য মন্ত্রিসভার এক সদস্য বলেন, “যে ভাবে বিলটি বিধায়কদের কাছে বিলি করা হয়েছে, সেই ভাবেই সেটি বিধানসভায় পেশ করা হবে।” কোনও সংশোধনী দেওয়া হবে কি? মন্ত্রীর জবাব, “সে তো দেওয়া হতেই পারে! তাড়াহুড়োয় বিলে কিছু ছাপার ভুল (টাইপোগ্রাফিক্যাল এরর) রয়ে গিয়েছে। সেগুলো নিয়ে সংশোধনী তো কিছু দিতেই হবে।”
প্রশাসনিক মহলের একাংশের আশঙ্কা, যে ভাবে বিলে বলা হয়েছে, টাটারা এবং ভেন্ডার সংস্থাগুলি দ্রুত জমি না-ছাড়লে হুগলির জেলাশাসক বা তাঁর মনোনীত কোনও আধিকারিক ‘প্রয়োজনীয় ক্ষমতা’ প্রয়োগ করবেন, তাতে টাটা গোষ্ঠী ক্ষুণ্ণ হবে না তো? সংঘাতের সম্ভাবনা তৈরি হবে না তো? সরকারের তরফে অবশ্য সেই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। শিল্প এবং আইন দফতরের পদস্থ আধিকারিকদের কথায়, “এই লাইনটা যে কোনও বিলেই থাকে। এটা একেবারেই আইনি ভাষা। এটাকে অত গুরুত্ব দিয়ে দেখার কিছু নেই। জমি অধিগ্রহণ আইনেও এই লাইনটা বলা থাকে। যার আসল অর্থ হল, জমির মালিকানা সরকারের হাতে থাকবে। যার অন্যথা হলে সরকার ব্যবস্থা নিতে পারে।”
|
|
ঘরছাড়াদের ঘরে ফেরানোর দাবি নিয়ে রেজ্জাক মোল্লা। সোমবার বিধানসভায়। নিজস্ব চিত্র |
খসড়া বিলে আরও বলা হয়েছে, ‘অনিচ্ছুক’দের জমি ফিরিয়ে দেওয়ার পর বাকি জমি সরকার আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, কর্মসংস্থান, শিল্প এবং অন্য জনস্বার্থমূলক কাজে ব্যবহার করবে। টাটা মোটর্স এবং ভেন্ডার সংস্থাগুলিকে জমি ফিরিয়ে দিতে হবে হুগলির জেলাশাসককে। তার বিনিময়ে তারা কত ক্ষতিপূরণ পাবে, তা ঠিক করবেন হুগলির জেলা জজ। তবে তা ঠিক করা হবে টাটা মোটর্স-সহ বাকি সংস্থাগুলির আবেদনের ভিত্তিতে। অর্থাৎ, ক্ষতিপূরণ পেতে গেলে বিধিসম্মত ভাবে আবেদন করতে হবে। ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে বার্ষিক ৬ শতাংশ সুদে।
কী কারণে ওই বিল আনা হচ্ছে, তা-ও বিস্তারিত ভাবে খসড়া বিলে জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে, যে কারণে টাটাগোষ্ঠীকে ওই জমি দেওয়া হয়েছিল, তার উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ‘ব্যর্থ’ হয়েছে। জমিটি তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে ‘অব্যবহৃত’ অবস্থায় পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে রয়েছে। ওই জমিকে কেন্দ্র করে কোনও আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন হয়নি, কর্মসংস্থান হয়নি এবং এলাকার মানুষেরও কোনও উপকার হয়নি। যদিও পশ্চিমবঙ্গ শিল্পোন্নয়ন নিগমের তরফে জমিদাতাদের ক্ষতিপূরণ বাবদে ১৩৭ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। এলাকার নিকাশি এবং অন্যান্য পরিকাঠামো তৈরিতে রাজ্য সরকারের ব্যয় হয়েছে আরও ৭৬ কোটি টাকা। বিলে বলা হয়েছে, সে কারণেই পশ্চিমবঙ্গ শিল্পোন্নয়ন নিগম আর জমির মালিকানা রাখতে চায় না। তারা চায়, রাজ্য সরকার জমিটি ‘খাস’ করে নিক। ক্ষতিপূরণ বাবদে যে অর্থ জমিদাতাদের দেওয়া হয়েছিল, রাজ্য সরকার সেই অর্থ নিগমকে দিতে রাজি আছে। আরও বলা হয়েছে, ওই জমি ঘিরে এলাকায় যথেষ্ট অশান্তি ছড়িয়েছিল। ভবিষ্যতেও অশান্তির আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাই এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ করতে হবে। রাজ্য সরকার তাই ‘জনস্বার্থে’ই ওই জমির মালিকানা হাতে নেওয়া দরকার বলে মনে করে।
সিঙ্গুর-বিল পাশ করাতে বিধানসভায় দু’ঘণ্টা সময় বরাদ্দ করা হয়েছে। এ দিন বিধানসভার স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, আপাতত ১৭ জুন, শুক্রবার পর্যন্ত সভা চলবে। রাজ্যপালের বক্তৃতার উপর বুধবার থেকে শুক্রবার পর্যন্ত প্রতিদিন পাঁচ ঘণ্টা করে আলোচনা হবে। ওই দিনগুলিতে প্রশ্নোত্তর পর্ব বা উল্লেখপর্ব থাকবে না। আজ, মঙ্গলবার সভার প্রথমার্ধে থাকবে শোক প্রস্তাব এবং রিপোর্ট পেশ। দ্বিতীয়ার্ধ্বে সিঙ্গুর-পর্ব।
|
এক ঝলক |
• লিজ বা বণ্টন-চুক্তি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে পুরো
জমি রাজ্য সরকারের হেফাজতে আসবে।
• টাটা মোটরস লিমিটেড (টিএমএল) এবং ভেন্ডার সংস্থাগুলিকে জমির মালিকানা ছেড়ে দিতে হবে।
টিএমএল এবং ভেন্ডার সংস্থাগুলি মালিকানা দ্রুত না ছাড়লে হুগলির জেলাশাসক বা
তাঁর মনোনীত কোনও আধিকারিক প্রয়োজনীয় ক্ষমতা
প্রয়োগ
করে তা নিতে পারবেন।
• ভেন্ডাররা যে প্রিমিয়াম দিয়েছে, জমি ফেরত নেওয়ার পর তা তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হবে। তবে ভাড়া বাবদ
সরকারের প্রাপ্য বকেয়া অর্থ কেটে নেওয়া হবে।
• ‘মধ্যস্থতাকারী’ হিসেবে টিএমএলের ক্ষতিপূরণের পরিমাণ ঠিক করবেন জেলাশাসক।
• ক্ষতিপূরণের দাবি পেশ করা থেকে তা মিটিয়ে দেওয়া পর্যন্ত সময়কালের জন্য বার্ষিক ৬ শতাংশ সুদ দেবে রাজ্য।
• ‘অনিচ্ছুকদের’ কাছ থেকে যতটা জমি নেওয়া হয়েছিল, তার সমপরিমাণ জমি তাঁদের ফিরিয়ে দেওয়া হবে। |
|
|
|
|
|
|