দিনভর টানাপোড়েন, রাজভবনে দীর্ঘ বৈঠক
বক্তৃতায় মা, মাটি, মানুষ বলে বিতর্কে রাজ্যপাল
গামী পাঁচ বছর কোন পথে চলবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন জোট-সরকার? ২০ মে শপথ নেওয়ার পর থেকে গত ২৪ দিনে তারা কী কী কাজ করেছে? সোমবার রাজ্য বিধানসভায় প্রায় আধ ঘণ্টার বক্তৃতায় দু’টি বিষয়ই জানিয়ে গেলেন রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন।
কিন্তু সেই ‘ট্র্যাডিশন’ সমানে চলল! রাজ্যে পট-পরিবর্তনের পরেও বিধানসভার প্রথম অধিবেশনেই বক্তৃতা নিয়ে বিতর্কে জড়ালেন রাজ্যপাল!
গত ৩৪ বছরে বামরাজত্বে রাজ্যপালের বক্তৃতা নিয়ে তৎকালীন বিরোধীরা যে বিরোধিতা করতেন, সোমবার ঠিক সে ভাবেই রাজ্যপালের বক্তৃতা নিয়ে সরব হলেন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র। রাজ্যপালের বক্তৃতায় ‘মা-মাটি-মানুষে’র সরকারের প্রসঙ্গ নিয়ে তীব্র আপত্তি তুলেছে সিপিএম। রাজ্যপাল তাঁর বক্তৃতায় জানিয়েছেন, এ বারের ভোটে মানুষের ‘রায় ছিল পরিবর্তনের পক্ষে, মা-মাটি-মানুষের সরকার গড়ার পক্ষে।’ দীর্ঘ ৩৪ বছর পর রাজ্যে ক্ষমতার পরিবর্তনের জন্য রাজ্যপাল ‘মা-মাটি-মানুষে’র সরকারকে ‘সাধুবাদ’ও জানিয়েছেন। রাজ্যপালের ওই বক্তৃতাকে ‘তৃণমূলের নির্বাচনী ইস্তাহার’ বলে অভিহিত করেছেন সূর্যবাবু। তাঁর কথায়, “রাজ্যপালের ভাষণকে আমি তৃণমূল-জোটের ইস্তাহারও বলতে পারছি না! আমার মনে হচ্ছে, এটা শুধু তৃণমূলেরই নির্বাচনী ইস্তাহার। রাজ্যপালকে পড়তে হয়। উনি পড়েছেন।”
রাজ্যপালের বক্তৃতা নিয়ে সমালোচনাতেও সূর্যবাবু কংগ্রেস ও তৃণমূলের মধ্যে যে বিভাজন করার চেষ্টা চালিয়েছেন, তাকে গুরুত্ব না দিয়ে বিরোধী দলনেতার বক্তব্যের কড়া সমালোচনা করেছে তৃণমূলের জোটসঙ্গী কংগ্রেস। দলের নেতা ও রাজ্যের সেচমন্ত্রী মানস ভুঁইয়ার কথায়, “স্বীকার করছি, ‘মা-মাটি-মানুষ’ কংগ্রেসের স্লোগান নয়। কিন্তু সূর্যবাবুরা মা-মাটি-মানুষের কথা শুনলে বিব্রত হন! কারণ ওঁরা মাকে সম্মান দিতে জানেন না। মানুষ ও গণতন্ত্রে ওঁদের বিশ্বাস নেই। তাই রাজ্যপালের বক্তৃতা নিয়ে ওঁদের এত আপত্তি।” কংগ্রেস পরিষদীয় দলের নেতা মহম্মদ সোহরাবের বক্তব্য, “রাজ্যপালের বক্তৃতায় রাজ্যের বাস্তব চিত্রই ফুটে উঠেছে। বিগত সরকারের আমলে আইন-শৃঙ্খলার অবনতির কথা যেমন তিনি তুলে ধরেছেন, তেমনই এই পরিস্থিতিতে আজকের সরকার কী করবে, তা-ও বলেছেন রাজ্যপাল।”
ব্যস্ততাই এখন মুখ্যমন্ত্রীর রোজকার ছবি। সোমবার। রাজীব বসু
প্রত্যাশিত ভাবেই সূর্যবাবুর বক্তব্যের কড়া বিরোধিতা করছেন শাসক তৃণমূলের মুখ্য সচেতক শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। তাঁর বক্তব্য, “গত ৩৪ বছর ধরে সূর্যবাবুদের লিখে দেওয়া বক্তৃতাই তো রাজ্যপালকে পড়তে হয়েছে! সেটাও তা হলে বামফ্রন্টের ইস্তাহার ছিল! এটা ঠিকই, যে সরকার থাকে, সেই সরকারের কথাই রাজ্যপালকে বক্তৃতায় বলতে হয়। কিন্তু এ বার রাজ্যপালের বক্তৃতা যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, রাজ্যপালের বক্তৃতায় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং সর্বস্তরের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা থেকে মুক্তি দিয়ে রাজ্যকে উন্নয়নের পথে নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে।” শোভনবাবুর বরং পাল্টা প্রশ্ন, “যে বক্তৃতায় এমন সমস্ত কথা বলা হয়েছে, সেটা পার্টির ইস্তাহার হল কী ভাবে?”
নতুন সরকার রাজ্যে একটি পরিচ্ছন্ন, নিরপেক্ষ, দক্ষ এবং দুর্নীতিমুক্ত স্বচ্ছ প্রশাসন দেবে বলে রাজ্যপাল জানিয়েছেন। বামফ্রন্ট সরকারের ৩৪ বছরের রাজত্বে রাজ্যে গণতান্ত্রিক শক্তিগুলিকে কঠিন বাধাবিপত্তির মধ্যে দিয়ে কাজ করতে হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন তিনি। পুলিশ-প্রশাসনকে যে গণতান্ত্রিক শক্তিকে অকেজো করার কাজে বামফ্রন্ট সরকার ব্যবহার করছে, তা নিয়ে ক্ষমতায় আসার আগে বহু বার অভিযোগ করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়রা। এ দিন রাজ্যপালের বক্তৃতাতেও তা প্রতিফলিত। রাজ্যপাল বক্তৃতায় পরিষ্কার বলেন, “গণতান্ত্রিক সংগ্রাম ও আন্দোলন দমনের জন্য পুলিশ ব্যবহার করা আমাদের সরকারের নীতি হবে না। পুলিশকে নিরপেক্ষতার সঙ্গে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার ও ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষা করতে নির্দেশ দেওয়া হবে।” রাজ্যে বিনা বিচারে আটক রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির ব্যবস্থা করতে কমিটিও গঠন করা হয়েছে বলে জানান রাজ্যপাল।
বস্তুত, রাজ্যের সর্বস্তরে উন্নয়ন ও পুর্নগঠনই যে ‘তাঁর সরকারের’ মূল লক্ষ্য, তা-ই ছিল এ দিন রাজ্যপালের বক্তৃতার প্রধান বিষয়। প্রায় ১৩ পাতার লিখিত বক্তৃতায় রাজ্যপাল জানিয়েছেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে নতুন কর্মসংস্থানের জন্য রাজ্য সরকার যথাসাধ্য চেষ্টা করবে। তিনি বলেন, “সরকার একটি এমপ্লয়মেন্ট ব্যাঙ্ক তৈরি করতে উদ্যোগী হয়েছে। এর সাহায্যে কর্মসংস্থানের গতি বৃদ্ধি পাবে।” শিল্পের পুনরুজ্জীবনের পাশাপাশি বন্ধ কলকারখানা খোলার ব্যাপারে সরকার যথাসম্ভব উদ্যোগী হবে এবং শিল্প সমস্যার সমাধানে সর্বস্তরে আলোচনাও করবে। তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পে দেশের অন্যান্য রাজ্যের থেকে পশ্চিমবঙ্গ যে পিছিয়ে আছে, তা জানিয়ে রাজ্যপাল বলেছেন, বর্তমান সরকার তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের উন্নয়নে জোর দেবে। তাঁর কথায়, “হলদিয়া, দুর্গাপুর, খড়্গপুর, কল্যাণী, শিলিগুড়ি-সহ বিভিন্ন জায়গায় তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প স্থাপন করা হবে এবং অনেক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে।” এই প্রসঙ্গেই রাজ্যপাল জানিয়েছেন, সরকার যেমন মালিকপক্ষকে সুযোগসুবিধা দেবে, তেমনই সরকার আশা করবে, মালিকপক্ষও শ্রমিকদের আইনসম্মত দাবিদাওয়ার প্রতি সুবিচার করবে। জানিয়েছেন, রাজ্যের প্রতিটি গ্রামে তিন বছরের মধ্যে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া হবে। দারিদ্রসীমার নীচে অবস্থিত (বিপিএল) পরিবারগুলিকে দেওয়া হবে নিখরচায় বিদ্যুৎ।
রাজ্যপালের বক্তৃতায় স্পষ্ট যে, শিল্পের পাশাপাশি কৃষির উন্নয়নেও মমতার নেতৃত্বাধীন সরকার প্রাধান্য দেবে। রাজ্যে জমিনীতি তৈরিতে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন তো বটেই, উন্নতমানের কৃষি প্রক্রিয়া অবলম্বন করে শস্যের উৎপাদন বৃদ্ধি ও ভৌগোলিক অঞ্চল অনুযায়ী কৃষির প্রচলনও করা হবে। শস্য, ফুল, মাছ চাষের সঙ্গে পশুপালন ইত্যাদি বিষয়ে খামার সংরক্ষণ, কৃষিজাত পণ্যের সঠিক মূল্য নির্ধারণের মাধ্যমে কৃষকদের স্বার্থরক্ষা ও কৃষি-নির্ভর মানুষের নিরাপত্তা বাড়ানোর ব্যবস্থাও করা হবে বলে বক্তৃতায় জানিয়েছেন রাজ্যপাল। হিমঘর স্থাপন থেকে শুরু করে ছোট ও প্রান্তিক চাষিদের মালিকানার বিষয়কে কার্যকর করা হবে বলে তিনি জানিয়েছেন। অন্য দিকে সরকারি ও বেসরকারি যৌথ অংশীদারিত্বকে (পিপিপি) উৎসাহিত করে সড়ক ও সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটানো হবে।
যাকে সূর্যবাবু অভিহিত করেছেন ‘তৃণমূলের ইস্তাহার’ বলে। আর মানস-শোভন জানিয়েছেন, রাজ্যপাল ‘নতুন বাংলা’ তৈরির কথাই বলেছেন। এর মধ্যে রাজনীতি নেই।
ঠিক যেমন এত দিন বলতেন সূর্যবাবুরা। সেই ‘ট্র্যাডিশন’ও অব্যাহত।

যা বললেন নারায়ণন
বন্ধ কলকারখানা খুলতে উদ্যোগ।
তিন বছরের মধ্যে সব গ্রামে বিদ্যুৎ।
মূল্যবৃদ্ধির সমস্যা সমাধানে ব্যবস্থা।
জমিনীতি তৈরি, বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন।
সব বেসরকারি মাদ্রাসাকে অনুমোদন।
জঙ্গলমহলে আদিবাসীদের সার্বিক উন্নয়ন।
দার্জিলিং নিয়ে শান্তিপূর্ণ সমাধান সূত্র।
৪৬ হাজার শিক্ষক নিয়োগ।
মেডিক্যাল কলেজগুলিতে ৭০০ আসন বৃদ্ধি।
নিরপেক্ষ পুলিশ-প্রশাসন।
First Page Rajya Next Story



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.