|
|
|
|
প্রবন্ধ ২... |
সদাশিব-বিনায়করা তবু বেঁচে থাকেন, লড়াই করেন |
অশোককুমার মুখোপাধ্যায় |
ডাক্তার সদাশিব ভট্টাচার্য, বনফুলের উপন্যাসের সেই ‘ভ্রাম্যমাণ’ চরিত্র, একদা তাঁর স্টেশন ওয়াগন থামিয়েছিলেন হাজিপুরের হাটে। সেখানে রোগী অনেক। কী ধরনের অসুখ? ম্যালেরিয়া, আমাশয়, চোখ-ওঠা, খোস, দাদ এবং যক্ষ্মা। হাটেবাজারে আমজনতার চিকিৎসা করে বেড়ানো এই ডাক্তার সিফিলিস-গনোরিয়া এবং কুষ্ঠরোগের নিরাময়ও করেছেন। বনফুলের অন্য কিংবদন্তি চরিত্র ডাক্তার অগ্নীশ্বর মুখোপাধ্যায় লক্ষ করেছিলেন, “টি বি হয় খুব গরিবদের। এ দুরারোগ্য ব্যাধির চিকিৎসা তারা করাতে পারে না। বড়লোকরা স্যানাটোরিয়মে চলে যায়।’’ তাঁর পরিক্রমণে গ্রামের নিচুতলার মানুষের ওপর ঘটে যাওয়া সামাজিক অন্যায় প্রত্যক্ষ করেছিলেন ডাক্তার সদাশিব। গরিব খেতমজুরটি গ্রামের জমিদারের কাছে ‘কবে নাকি দু’শো টাকা ধার নিয়েছিল তারই সুদের সুদ জমেছে। খেটে শোধ করতে হবে।’ সদাশিব ‘বার বার অনুভব করেছেন যে দাসত্ব-প্রথা এখনও লোপ পায়নি।’ তিনি দেখেছেন ‘ধূর্ত ধনীর কাছে অসহায় দুর্বলরা’ নিজেদের বিক্রি করে দিচ্ছে। অন্যায় দেখে নীরবে শুধু ‘ডাক্তারি’ করে যেতে পারেননি অগ্নীশ্বর, সদাশিব কেউই। তাঁরা নিজেদের সাধ্যমত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। প্রথম জন বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগে এক স্বাধীনতা-যোদ্ধাকে পুলিশের কবল থেকে মুক্ত করেছেন। দ্বিতীয় জন নিজের প্রভাব খাটিয়ে কেবলী-র ‘আদমি’ নারায়ণকে জেল থেকে ছাড়াবার উদ্যোগ নিয়েছেন। গ্রামের ছবিলাল মোড়লের মিথ্যা অভিযোগে পুলিশ গ্রেফতার করেছিল গরিব মজুরটিকে। দুই ডাক্তারই, বিশেষত সদাশিব ক্রমাগত নজর করেছেন আর্থিক ও সামাজিক ব্যবস্থার সঙ্গে জনস্বাস্থ্যের অঙ্গাঙ্গি সম্পর্কটিকে। ডাক্তার দুজনের কথা যাতে আছে সেই ‘অগ্নীশ্বর’ এবং ‘হাটেবাজারে’, বনফুলের এই দু’টি উপন্যাস প্রকাশিত হয় ১৯৫৯-৬১ সময়কালে।
সত্তর সালের কলকাতার ছাত্রযুবদের খুব আলোড়িত করেছিল কানাডার যে ডাক্তারের কর্মকাণ্ড, তাঁর নাম নর্মান বেথুন। ডাঃ বেথুন স্পেনের গৃহযুদ্ধের সময় সেখানে গিয়ে চিকিৎসা করেছেন যুদ্ধে আহত মানুষজনের। আহতকে যাতে চলমান অবস্থায় দ্রুত রক্ত দেওয়া যায়, উদ্ভাবন করেছেন তেমন ব্যবস্থার। এর দু’বছর পরেই, ১৯৩৮ সালে, শল্যচিকিৎসকটি চলে গেলেন চিন দেশে। পাশে দাঁড়ালেন জাপানের আগ্রাসন প্রতিরোধে সচেষ্ট চিনের গণমুক্তিবাহিনীর। আহত এক সৈনিককে চিকিৎসার সময়ে বেথুনের আঙুল কেটে যায়। সেই ক্ষতের দূষণে তিনি মারা যান। রোগের সঙ্গে আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধের কথা বারে বারে বলেছেন তিনি। রণাঙ্গণের অভিজ্ঞতায় তিনি বলেছেন, আগ্রাসী যুদ্ধবাজরা কেউই নীতির কারণে যুদ্ধ করে না, তারা করে আর্থিক লাভের জন্য।
নর্মান বেথুন-অগ্নীশ্বর-সদাশিবের মতোই মাটির কাছাকাছি এক জীবন্ত চরিত্র ডাক্তার বিনায়ক সেন। চার দশক আগে ভেলোরের ক্রিশ্চিয়ান মেডিক্যাল কলেজ থেকে চিকিৎসার পাঠ শেষে তিনি সিদ্ধান্ত নেন ছত্তীসগঢ়ে (তখন মধ্যপ্রদেশের অঙ্গ) গিয়ে থাকবার। সঙ্গে থাকেন সমাজতত্ত্ববিদ সহধর্মিণী ইলিনা সেন। আশির দশকের মধ্যভাগে তাঁরা বসবাস শুরু করেন রায়পুরে। তিন দশক গরিব আদিবাসীদের মধ্যে অধীতবিদ্যা প্রয়োগের অভিজ্ঞতায় ডাক্তার সেন বলেন, ‘জনসাধারণের স্বাস্থ্যের উন্নতির সঙ্গে তাদের পুষ্টির, সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক সমৃদ্ধির সুস্পষ্ট যোগাযোগ।’ |
স্নাতক স্তর থেকে জনস্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেলিত যে মানুষটি, সেই ডাক্তার বিনায়ক সেন কলকাতায় এসে প্রকাশ্য সভায় এবং একান্ত আলাপে আমাদের চোখ ফেরাতে বলেন কিছু তথ্যের দিকে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১৬ শতাংশ বাস করে যে দেশে, সেই ভারতে, পুষ্টির মাপকাঠি ‘বডি মাস ইনডেক্স’ অনুসারে, ৩৭ শতাংশ মানুষ অপুষ্টির শিকার। তফসিলি জনজাতির ক্ষেত্রে এই সংখ্যা ৫০ শতাংশ, তফসিলি জাতির ক্ষেত্রে ৬০ শতাংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মান অনুযায়ী, কোনও গোষ্ঠীর ৪০ শতাংশ মানুষ অপুষ্টিতে থাকলে তাদের ধরতে হবে দুর্ভিক্ষপীড়িত হিসেবে। অতএব, এই সংজ্ঞা অনুযায়ী দেশের গরিব আদিবাসী সমাজ আজ দুর্ভিক্ষের কবলে। দেশের অনূর্ধ্ব পাঁচ বছরের শিশুদের ৪৭ শতাংশ ধারাবাহিক অপুষ্টিতে আক্রান্ত। বিলাসপুরের বেশ কয়েকটি গ্রামাঞ্চলে তাঁর বন্ধু-ডাক্তাররা সমীক্ষা চালিয়ে উদ্ঘাটন করেছেন এক ভয়ংকর তথ্য ফুসফুসের যক্ষ্মারোগীদের এক-তৃতীয়াংশ বাস করে এই দেশে। ২০১০ সালে করা ইউ এন ডি পি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সমীক্ষা অনুযায়ী ভারতের আটটি রাজ্যে যত গরিব মানুষ আছে, তা আফ্রিকার ছাব্বিশটি দেশের গরিব মানুষের মোট সংখ্যার চেয়ে বেশি। এই আটটি রাজ্য হল বিহার, ছত্তীসগঢ়, ঝাড়খণ্ড, মধ্যপ্রদেশ, ওড়িশা, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গ।
এমত অবস্থায় সদাশিব-নর্মান বেথুনের মতোই মানবপ্রেমিক ডাক্তার বিনায়ক নীরব থাকতে পারেননি। প্রতিবাদ করেছেন। মানুষকে তার অধিকার সম্বন্ধে সচেতন করতে চেয়েছেন। তাঁদের সংগঠন পিপলস ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিজ বলেছে, গরিব আদিবাসী যারা জঙ্গল-নদী-ভূমির নির্ভরে জীবন যাপন করে, তাদের যথাযথ পুনর্বাসন না করে, গায়ের জোরে তাদের বাসভূমি থেকে উচ্ছেদ করা অন্যায়। ছত্তীসগঢ়ের হার্মাদবাহিনী সালবা জুড়ুমের অত্যাচারের নমুনা জনসমক্ষে এনেছেন তাঁরা। আদালতে বিচার চেয়েছেন। প্রতিদানে কী পেয়েছেন, সে কাহিনি সর্বজনবিদিত। কিন্তু থামেননি, বলেছেন, ‘যত দিন না প্রমাণিত হবে আমার কাজ দেশের বিরুদ্ধে নয়, প্রতিটি কাজ সামাজিক ন্যায়ের পক্ষে, সাম্যের পক্ষে; তত দিন এ লড়াই চালিয়ে যাব।’
দীর্ঘকায় মানুষটি বলেন, দারিদ্রসীমার নীচে বা উপরে নয়, দেশের প্রতিটি মানুষকে গণবণ্টন ব্যবস্থার আওতায় আনা উচিত। কেন? দেশের সব মানুষ একই ব্যবস্থার মধ্যে থাকলে ওই ব্যবস্থা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ে। তাকে ঠিক রাখার উদ্যোগ নেওয়া হয়। না হলে, দীনজনের জন্য করা ব্যবস্থার তদারকিও হয় দীনহীন ভাবে! এখন ওই ব্যবস্থায় পাঁচ জনের একটি পরিবার সারা মাসে পায় ৩৫ কিলোগ্রাম শস্যদানা, যা দিয়ে পনেরো দিনের বেশি চলে না। বিনায়কের মতে, ‘‘ডাক্তার, বিশেষত শিশু-চিকিৎসক হিসেবে যা আমাকে ভাবায়, তা হল, এত বেশি সংখ্যক মানুষের এই যে চরম দারিদ্র, তার পরিণাম কিন্তু এক ভয়াবহ স্বাস্থ্য-বিপর্যয়, যা এক বিশাল গণহত্যার শামিল।’’
সম্প্রতি এই সংবেদী ডাক্তারের সাহায্য চেয়েছে কেন্দ্রীয় যোজনা কমিশন। তাদের স্বাস্থ্য বিষয়ক একটি পরিচালন কমিটির সদস্য মনোনীত করা হয়েছে ডাক্তার বিনায়ক সেনকে। এই সব মানুষের অভিজ্ঞতা-কণ্ঠস্বর দেশের এবং রাজ্যের জনস্বাস্থ্য পরিকল্পনায় যত স্থান পাবে, ততই মঙ্গল। কিন্তু এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছেন ছত্তীসগঢ়ের রমন সিংহ (আ বা প, ১৯-৫)।
তবে ছবিলাল মোড়লের পোষা গুন্ডারা সদাশিব ডাক্তারকে লাঠির আঘাতে মেরে ফেললেও, সদাশিব-বিনায়কেরা বেঁচে থাকেন। মানুষ যুগে যুগে তাঁদের
স্বাগত জানায়। |
|
|
|
|
|