প্রবন্ধ ১...
জমি আইনে চাই মৌলিক পরিবর্তন
দেশের রাজনৈতিক এজেন্ডায় জমির প্রশ্নটা সবচেয়ে জ্বলন্ত প্রশ্ন হিসাবে সামনে এসেছে। দেশের কোটি কোটি মানুষের, বিশেষত গরিব মানুষের প্রাথমিক সম্পদ জমিই। এই সম্পদের মধ্যে যে অর্বুদ-কোটি টাকা আটকে রয়েছে, জমি-আইন সংশোধন করে জমি-মালিকদের সম্পত্তির অধিকার স্বীকার করলেই সেই টাকা বাজারে আসতে পারে। জমি-মালিকরা তখন নিজে থেকেই উন্নয়নের প্রক্রিয়ায় সরাসরি অংশগ্রহণ করবেন। আইন সংশোধন করে কৃষিজীবী জনতার এই ক্ষমতায়ন ঘটাতে পারলে পরিবর্তনের স্লোগান সার্থক হবে।
গত বছর প্রধানমন্ত্রী তাঁর এক ভাষণে সতর্ক করেছিলেন, পরিবেশ-সচেতনতা যেন উন্নয়নকে ঠেকানোর হাতিয়ার হয়ে না ওঠে। এক দিন পর সনিয়া বলেন, উন্নয়ন ও পরিবেশের মধ্যে একটা সামঞ্জস্য রক্ষা করে চলতে হবে। মিডিয়া দুই নেতার মতপার্থক্য নিয়ে প্রচুর সময় ও জায়গা অপব্যয় করে। অথচ দু’জনের বক্তব্যের মধ্যে তেমন কোনও দ্বন্দ্বই নেই। বিশ্বের অপেক্ষাকৃত ধনী দেশগুলির পরিবেশ অনেক পরিচ্ছন্ন। ওড়িশার নিয়মগিরি পাহাড়ের সানুদেশে প্রাকৃতিক পরিবেশে বসবাসকারী জনজাতীয়দের চেয়ে নিউ ইয়র্ক বা ফ্রাঙ্কফুর্টের বাসিন্দারা অনেক বেশি পরিশ্রুত পরিবেশে বাস করে, অর্থনৈতিক ভাবেও অনেক বেশি উৎপাদনশীল। ভারতের মতো দরিদ্র দেশে মানুষ অনেক বেশি পরিবেশগত বিপত্তির মধ্যে বাস করে। অথচ প্রকৃতি তো আর গরিবদের বিরুদ্ধে পক্ষপাতদুষ্ট নয়। সমস্যাটা অবশ্য দরিদ্রদের নিয়ে নয়, দারিদ্র নিয়ে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধীকে অনেক বিষয়েই সমালোচনা করা যায়। কিন্তু ১৯৭২ সালে স্টকহল্ম-এ পরিবেশ ও উন্নয়ন বিষয়ক রাষ্ট্রপুঞ্জের সম্মেলনে এই ইন্দিরাই সমবেত বিশ্বনেতাদের বলেছিলেন দারিদ্রই পরিবেশের সবচেয়ে বড় দূষণকারী।
সেই থেকে গত চার দশকে বিশ্বের কত পরিবর্তন হয়ে গেল। বর্তমান সামাজিক প্রতর্কের মুখ্য প্রতিপাদ্য দারিদ্র দূরীকরণ নয়, বরং তাকে জিইয়ে রাখা এবং যাবতীয় বিপর্যয়ের জন্য হয় প্রকৃতি, নয়তো মানুষের লোভকে দায়ী করা। স্বাধীনতার পরবর্তী ষাট বছর ধরে ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিয়মগিরির জনজাতিদের জীবনকে পাশ কাটিয়ে গেছে। এই অনুন্নত এলাকায় এমন গ্রাম আছে, যেখানে কেউ কখনও কোনও ‘মাইনে-পাওয়া চাকরি’ করেনি। জ্বর এবং পেটের অসুখ ব্যাপক। দশ-কুড়ি কিলোমিটারের মধ্যে কোনও স্কুল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই। বিজলির আলো স্বপ্নেরও অতীত, এমনকী সর্বত্রগামী মোবাইল ফোনের টাওয়ারও সেখানে কেউ দেখেনি। অথচ ওখানে প্রস্তাবিত খনি প্রকল্পকে হেয় করার জন্য মিডিয়া ও সমাজকর্মীদের একাংশ এমন একটা চিত্র তুলে ধরেন যেন, নিয়মগিরির আদিবাসীরা স্বর্গসুখে প্রকৃতির কোলে বিচরণ করছেন। এটা আমাদের অজ্ঞতাই প্রকট করে।
অগ্নিগর্ভ। ওড়িশায় পস্কো-র প্রস্তাবিত প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে ক্ষোভ।
পরিবেশের বিরুদ্ধে উন্নয়নকে লড়িয়ে দেওয়া ভুল। পরিবেশগত সম্পদের প্রাচুর্যের মধ্যেও অসহনীয় দারিদ্রই প্রজন্ম-পরম্পরায় জনজাতীয়দের নিয়তি থেকেছে। আজ ভারতে প্রায় ৯ কোটি জনজাতির বাস, যাদের ৮০ শতাংশই পুবে ওড়িশা থেকে পশ্চিমে গুজরাত ও উত্তরে মধ্যপ্রদেশ থেকে দক্ষিণে অন্ধ্রপ্রদেশ পর্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে। এদের অধিকাংশই তীব্র দারিদ্রের মধ্যে অরণ্যের সংলগ্ন অঞ্চলে বাস করে। এবং আরও অনেক দিন যে তারা ও ভাবেই বেঁচে থাকবে, একটি ব্রিটিশ কোম্পানিকে ওখানে লগ্নি করতে না-দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্ত সেটা নিশ্চিত করেছে।
গত মাসেই লন্ডনের বেদান্ত কোম্পানিকে বক্সাইট তোলার অনুমতি ওড়িশা সরকার সাময়িক ভাবে বাতিল করেছে এবং বন-আইন ভাঙার দায়ে শো-কজ করেছে। আটশো কোটি ডলারের এই মাইন প্রকল্পটি পর্যালোচনা করার যে কমিটি গড়া হয়, তার বক্তব্য প্রকল্পটি তৈরি হলে ডোঙরিয়া কোন্ধ ও কুটিয়া কোন্ধ উপজাতির প্রথাগত জীবনধারা বিপর্যস্ত হবে, তাদের জল ও প্রাকৃতিক সম্পদের সরবরাহ বিঘ্নিত হবে। পাহাড়টিকে জনজাতিরা ‘পবিত্র’ গণ্য করে, এ কথাও বলা হয়, যদিও সেখানে কোনও পবিত্র পূজাস্থান নির্দিষ্ট করা যায়নি। বেদান্ত’র সহ-বিনিয়োগকারীরা মানবাধিকার লঙ্ঘনের আশঙ্কায় প্রকল্প থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে।
জনজাতিরা প্রকল্পটিতে আপত্তি জানাবে কিনা, সেটা সমস্যা নয়। সমস্যা হল সম্পদের মালিকানা সুস্পষ্ট ভাবে নির্ধারিত না-হওয়া। আপত্তি জনজাতিদের, নাকি তাদের আড়ালে থাকা কোনও কায়েমি স্বার্থচক্রের, সেটা স্পষ্ট হওয়া চাই। এই অস্পষ্টতাই সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় অসৎ পুঁজিপতিদের অনুপ্রবেশের ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে। এ সবের একটা পরিণাম হল, বেদান্ত’র মতো বিনিয়োগ-প্রকল্প সহজেই রাজনৈতিক চাপান-উতোরের উপলক্ষ হয়ে ওঠে। মাইন প্রকল্প সর্বদাই খনিজ সম্পদের কাছে সরাসরি পৌঁছতে চাইবে, কর্পোরেট-বিরোধীরা যার বিরুদ্ধে খনিজ লুণ্ঠনের প্রচার চালাবে। কিন্তু যদি আদিবাসীদের জনে-জনে জমির মালিকানা মঞ্জুর করা হত, তারা নিজেরাই স্থির করতে পারত, কোনও প্রকল্প তারা করতে দেবে কি না। বৃহত্তর রাষ্ট্রীয় স্বার্থের নামে তাদের উচ্ছেদ করা যেত না, নিজেদের ভাগ্য তারা নিজেরাই গড়তে পারত। কোনও উন্নয়ন প্রকল্প তাদের পছন্দ হলে তারা তাকে জায়গা করে দিত। একমাত্র এ ভাবেই জমি-মালিক ও পুঁজি লগ্নিকারীরা সমানে-সমানে দরকষাকষি করতে পারে।
কেন্দ্রীয় সরকার উভয়ের মধ্যে একটা ভারসাম্য রাখতে চাইছে, কিন্তু যথারীতি রাজনীতিকরা বাগড়া দিয়ে যাচ্ছেন। সরকার একটা খসড়া খনি আইন তৈরি করতে চাইছে, যাতে স্থানীয় জনসাধারণকে খনি প্রকল্পের লভ্যাংশের ২৬ শতাংশ দেওয়া হবে। মাইন শিল্পের কর্ণধাররা এর ঘোর বিরোধী। তাঁদের আশঙ্কা, এতে প্রকল্প পরিচালনায় অনিশ্চয়তা দেখা দেবে। পণ্যের দরের ওঠা-নামার ফলে লভ্যাংশের প্রাপ্যে যে হের-ফের ঘটে, আদিবাসীরা তার ঝুঁকি নিতে চাইবে কেন? সর্বোপরি, আদিবাসী মালিকানায় থাকা সম্পদের বস্তুগত মূল্য যাচাই করা না গেলে হস্তান্তরিত সেই সম্পদের বিনিময়ে প্রাপ্য লভ্যাংশের মূল্যও যথাযথ ভাবে নির্ধারণ করা যাবে না, আইনগত জটিলতাও দেখা দেবে।
এ ভাবে জল ঘোলা না করে সরকার বরং আরও মৌলিক পরিবর্তনের কথা ভাবুক। এখন কেবল ব্যক্তি বা যূথের মালিকানাধীন সম্পদ নয়, সময় এসেছে ভূগর্ভস্থ খনিজের মালিকানা নির্ণয়েরও। একই সঙ্গে গ্রামের যৌথ মালিকানাধীন চারণভূমি কিংবা আদিবাসীরা যার উপর নির্ভরশীল সেই লাগোয়া বনভূমির মালিকানাও নির্ধারণ করা দরকার। এর নজিরও রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস সহ যাবতীয় খনিজের মালিকানা জমি-মালিকের। এই মালিকানা সে বিক্রি করতে পারে, ভাড়া দিতে পারে, ভাগ করে বিক্রি করতে পারে, এক-একটা খনিজের জন্য এক-এক রকম দাম হাঁকতে পারে। আমেরিকায় এ রকম দশ লক্ষ জমি-মালিক আছেন।
সিঙ্গুরের সমস্যাটার কথাই ধরা যাক। ওখানে টাটারা ন্যানো প্রকল্পের জন্য ১৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে চেয়েছিল এবং গাড়ি কারখানার জন্য ৫০০ একর আর সহযোগী শিল্পের জন্য আরও ৫০০ একর জমি চেয়েছিল। মাইন শিল্পের মতো এ ধরনের শিল্পে জমি প্রধান সম্পদ নয়, তাই তার জন্য প্রকল্পব্যয়ের ১০ শতাংশের বেশি বরাদ্দ থাকে না। সেই হিসাবে সিঙ্গুরে একর-পিছু জমির দাম ৩০ লাখ টাকার বেশি হয় না এবং জমি-মালিকদের ১৫ লাখের বেশি পাওনা হয় না। পরবর্তী ২০-৩০ বছরের জন্য জমি-মালিককে আরও ২-৩ লাখ করে দেওয়া যায় তার লগ্নিকৃত সম্পদের (এ ক্ষেত্রে জমির) উপর জমা সুদ হিসাবে। এ বাবদে যে অতিরিক্ত অর্থ থাকবে, তা দিয়ে স্থানীয় এলাকার উন্নয়ন করা যায়, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য পরিকাঠামোগত সুবিধা জমি-দাতাদের নাগালে এনে দেওয়া যায়। এতে কেবল ওই প্রকল্পের মূল্যই নয়, আশপাশের জমির দামও বেড়ে যাবে।
জমির মূল্য নির্ভর করে জমি কী উপযোগে ব্যবহৃত হচ্ছে, তার উপর। যদি কৃষক চাষবাস ছাড়া অন্য কোনও কাজে তার জমিকে ব্যবহার করতে না পারে, তবে তার দাম কম হবে। সিঙ্গুরে ২০০৬ সালে কৃষিজমির দাম ছিল একর-পিছু ৩ লাখ টাকা। কিন্তু টাটার প্রকল্প ঘোষিত হওয়ার পরেই আশপাশের জমির দাম এক লাফে ৩০ লাখে পৌঁছয়। ওই দামে টাটারা ইচ্ছা করলে সহজেই জমি-মালিকদের সম্মতি নিয়েই প্রয়োজনীয় জমি কিনতে পারত, সিঙ্গুর না হোক, দেশের অন্য যে-কোনও জায়গায়। কিন্তু এ দেশে জমির বাজার ভয়ানক রকমের সঙ্কুচিত, নিয়মকানুন জটিল এবং ব্যবহার্যতার ভিত্তিতে জমির দরও ‘বিকৃত’। তাই অধিকাংশ জায়গায় আইনি পথে জমি সংগ্রহ করা কঠিন। অন্য সমস্যাটি হল, বিনিয়োগকারীরা যদি মনে করে, সরকারকে দিয়ে শস্তায় জমি কিনিয়ে তাতে প্রকল্প গড়বে, তা হলে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে প্রয়োজনের অতিরিক্ত জমি সংগ্রহ করার প্রবণতাও বাড়বে। সরকার ১৮৯৪ সালের জমি অধিগ্রহণ আইনে সংশোধন আনতে উদ্যোগী হয়েছে। শিল্পোদ্যোগীরা ৭০ শতাংশ জমি সরাসরি মালিকদের কাছ থেকে কিনলে বাকি ৩০ শতাংশ সরকার সংগ্রহ করে দেবে। কিন্তু এই সব শতাংশের হিসেবের
চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল ‘জনস্বার্থ’ কাকে বলা হবে, তা নিয়ে প্রকাশ্য বিতর্ক। এখন কিন্তু এ দেশে ব্যক্তিমালিকানাধীন যে কোনও ব্যবসায়িক উদ্যোগকেই জনস্বার্থ-সহায়ক বলে চালানো হয়।
(চলবে)
লেখক দিল্লিতে লিবার্টি ইনস্টিটিউট-এর অধিকর্তা
Previous Item Editorial Next Item



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.