|
|
|
|
চিরছাতা হে |
এই মুহূর্তে সর্বত্র লম্বা-বেঁটে হাতলওয়ালা, লাল-নীল-হলুদ-সবুজ বিচিত্র বর্ণের ছাতা।
গরম-বর্ষার মাহেন্দ্রক্ষণে বড় ভরসার সাথী। গৌতম চক্রবর্তী |
ছাতা
ধরো হে দেওরা! গনগনে রোদ আর তার পরে ঝরঝর বারিধারার এই সিজনে দেওর-বউদি-ভাশুর-ভাদ্দরপো নির্বিশেষে সকলে ফের ছত্রধর বনে গিয়েছেন। শপিং মল থেকে ফুটপাথ, সর্বত্র লম্বা হাতলওয়ালা, লাল-নীল-হলুদ-সবুজ বিচিত্র বর্ণের ছাতা। বাঙালি জীবনে এখন শুধুই ছাতার উৎসব!
ছাতা জিনিসটা ঢাউস, কিন্তু আকারে একটু ছোট হলে, আদরের নাম ছাতি। কোন সময়ে হাতের কাছে কী মহৌষধ রাখা উচিত, ডাকের বচনে অনেক দিন আগেই তা বলা হয়েছিল। ‘অরুচির অম্বল, শীতের কম্বল/বর্ষার ছাতি, ভট্টাচার্যের পাঁতি।’ আত্মঘাতী বাঙালি সেই বচন-টচন ভুলে গিয়েছে বলেই বলে বাসে কিংবা মেট্রো রেলের সিটে বসে ছত্রধারীদের সঙ্গে ফাটিয়ে ঝগড়া করে, ‘দুর মশাই! জল পড়ছে, দেখে দাঁড়াতে পারেন না?’
অভিজ্ঞতায় দেখেছি, পুরুষের ছাতা জন্ম-অপরাধী। জল ঝরলে বা বেকায়দায় শিকটা কাউকে খোঁচালেই হাউহাউ। অথচ মেয়েরা? ভিজে শাড়ি বেয়ে টপটপে জল, ভিজে ছাতা ভাঁজ করে ব্যাগে ঢোকাতে ঢোকাতে জলের ফোঁটা ছিটকে এর হাতে, ওর চোখে পড়লেও কেউ ভ্রুক্ষেপ করে না। |
|
‘শেষের কবিতা’ মনে করে দেখুন। ঘুম থেকে উঠে অমিত দেখে, ‘ডান হাতে ছাতা দোলাতে দোলাতে উপরের রাস্তা দিয়ে আসছে লাবণ্য।’ এই একটা উপন্যাসই বুঝিয়ে দেয়, প্রৌঢ়ত্বেও মেয়েদের অ্যাকসেসরিজের দিকে কী তীক্ষ্ণ নজর রাখতেন রবীন্দ্রনাথ! লাবণ্যের হাতে যে ছাতা চলবে, আধুনিকা সিসি-লিসির হাতে মানাবে না। অতএব অমিত যখন শিলঙে, ‘বাঁ হাতে হাল কায়দার বেঁটে ছাতা, ডান হাতে টেনিস ব্যাট’ নিয়ে সিসি-লিসিরা গেল দার্জিলিঙে। ছোটবেলায় অঘোর মাস্টারমশাইয়ের কালো ছাতার অত্যাচার সইতে হত বলেই কি প্রৌঢ়ত্বেও রবীন্দ্রনাথ মেয়েদের স্টাইলিস্ট ছাতার দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখতেন?
তবে, বাঙালি আর ছাতা-মাহাত্ম্য বুঝল কোথায়? সবুজ লনে গার্ডেন চেয়ারের ওপরে বা গোয়ার সি-বিচে যাহা পোঁতা থাকে, তাহাও ছাতা! ইংরেজিতে চমৎকার একটি বিভাজন আছে। কেতাদুরস্ত বাগানে বা সমুদ্রতটে লম্বা ছাতাটির নাম ‘প্যারাসল’। আর বৃষ্টি থেকে বাঁচতে হাতে যা নিয়ে ঘুরতে হয়, তার নাম ‘আমব্রেলা’। ব্রিটিশ কেতা ভুলে গেলে, পোকোপোমো জাতির এই দুর্দশাই হয়। প্যারাসল, আমব্রেলা সব এক ছাতার নীচে একাকার।
বৃষ্টি-ফিস্টি নয়, রোদ থেকে বাঁচতেই ছাতা। অন্তত মহাভারতে তা-ই বলে। পরশুরামের বাবা জমদগ্নি রোজ তির ছুঁড়ে সূর্যকে আড়াল করতেন, তাঁর স্ত্রী রেণুকা ঘাটে জল আনতে যেতেন। এক দিন দেরি দেখে জমদগ্নি রেগে আগুন। রেণুকা বললেন, রোদের তাতে দেরি। জমদগ্নি রেগে সূর্যের দিকে বাণ ছুড়তে যাবেন, বিবস্বান সহসা নেমে এসে জমদগ্নির হাতে ধরিয়ে দিলেন ছাতা। |
|
এ কালের ছাতি? বড় গ্যাদগেদে, বড় শরীরী। উনিশ শতকে বাঙালির নবনাটকে সংলাপ, ‘যে দিগে পড়ে জল সেই দিগে ধরি ছাতি/তা নৈলে লোকে কেন বলবে মোরে রসবতী।’ ছাতির মধ্যে কী ভাবে যে এত অন্তর্গূঢ়, শরীরী অর্থ পায় বাঙালি!
‘পথের পাঁচালী’ সিনেমায় অপুর বড় হয়ে যাওয়াটা মনে আছে? দুর্গা মারা গিয়েছে, অপু পাঠশালায় যাবে। আকাশে মেঘ। বেরোতে গিয়ে অপু ফের ঘরে ঢুকে আসে, হরিহরের ঢাউস কালো ছাতাটা নিয়ে রওনা হয়। যে বালকের পিছনে এত দিন মাকে ঘুরে বেড়াতে হত, দিদির মৃত্যু তাকে বড় করে দিয়েছে।
আর ছাতার বিপ্লব? চমৎকার এক সিকোয়েন্স আছে গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের ‘কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না’ উপন্যাসে। বুড়ো কর্নেলের নজরে পড়ে ট্রাঙ্কের নীচে রাখা ভাঙাচোরা, পুরনো কালো ছাতা। মনে পড়ল, বহু বছর আগে ছেলেকে নিয়ে ওই ছাতার নীচে বসে একটা শো দেখতে গিয়েছিল কর্নেল। কয়েক বছর আগে খুন হয়ে গিয়েছে সেই পুত্র। ওদের দলের আর এক বন্ধু গত রাতে খুন হয়েছে, মরদেহ দেখতে বৃষ্টির মধ্যে ছাতা ছাড়াই রওনা হয় কর্নেল। রাস্তায় এ ডাকে, সে ডাকে। কর্নেল কারও ছাতার নীচে যায় না। শেষে সাবাস নামে এক বন্ধুর ডাকে সাড়া দেয় সে। ততক্ষণে খবর আসে, পুলিশ ব্যারাকের সামনে দিয়ে শোকমিছিল যাবে না। ছাতায় অঝোরে বৃষ্টি পড়ে, কর্নেল বিড়বিড় করে সাবাসকে বলে, ‘আমরা যে একনায়কতন্ত্রে বাস করি, মাঝে মাঝেই খেয়াল থাকে না।’
এই বঙ্গের মার্কেসপ্রেমী নেতারা এখন কোন ছাতার নীচে ঢুকবেন, পুরনো ছেঁড়াফাটা ছাতা আদতে সারাই করে নিতে পারবেন কি না সেটাই লাখ টাকার প্রশ্ন! |
|
|
|
|
|