ব্যাগ গুছিয়ে...

সুবর্ণরেখার হাতছানি
ড় উঠতেই লোডশেডিং হয়ে গেল। চৌকিদার হ্যারিকেনটা দেওয়ায় কোনও রকমে ভিজে জামাকাপড় ছেড়ে একটা ঘরে সবাই জড়ো হয়ে চা-পকোড়া সহযোগে চলল জম্পেস আড্ডা।
ক্ষণিক ছুটির তালিকায় এ বার তালসারি। গোপাল মাঝি তাঁর বাহনে দিঘা থেকে তালসারির পান্থনিবাসে পৌঁছে দিয়েছেন। এখানে থাকার মেয়াদ ২৪ ঘণ্টা। দিঘা থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে ওড়িশা সীমানা। পশ্চিমবঙ্গের শেষ গ্রাম কিয়াগেড়িয়া গ্রাম। পিচ ঢালা সোজা রাস্তার বাঁ দিক চলে গিয়েছে উদয়পুরে। দূরত্ব তিন কিলোমিটার। এই পথের ডান দিক ওড়িশা, বাঁ দিক পশ্চিমবঙ্গ। এখানকার বৈশিষ্ট্য সমুদ্রসৈকত। এ সৈকত জেলেদের। সামুদ্রিক মাছের ব্যবসায় সদা ব্যস্ত জেলেরা। মনে রাখলাম, সখ্য হবে ফেরার পথে।
সকালে এসেছি পুরনো দিঘায়। কিন্তু গন্তব্য তালসারি। কিয়াগেড়িয়া থেকে সোজা পথে কিছুটা গেলেই চন্দনেশ্বর। এখান থেকে ডান দিকে পড়বে চন্দনেশ্বর শিবের মন্দির। ইচ্ছে হলে দেখা হবে, কারণ তখন তালসারি ডাকছে। এখান থেকে গাড়ি চলল বাঁ দিকের পথ ধরে আরও চার কিলোমিটার। সঙ্কীর্ণ রাস্তায় মনে হল ভ্যানরিকশাই ভাল। পথের দু’পাশে ঘর-গেরস্থালি। কখনও কখনও পথই বাড়ির উঠোন। সেই উঠোন কখনও ধান শুকোনোর জায়গা, কখনও বা চু-কিত-কিত, কাবাডি, আইস-পাইস খেলার ময়দানও। এঁকেবেঁকে এগিয়ে গিয়েছে পথ, যত এগিয়েছে ততই নির্জনতা আপন হয়েছে। হারিয়ে গিয়েছে গাঁ-ঘর।
পিচ রাস্তা যেন থমকে গেল হঠাই। দেখা গেল ওড়িশা ট্যুরিজমের পান্থনিবাস-চন্দনেশ্বর। ফটক দিয়ে গাড়ি সোজা দাঁড়াল গাড়ি-বারান্দায়। আগাম সংরক্ষণের জন্য দোতলার ঘর মিলল। পান্থনিবাসের একতলায় রেস্তোরাঁ, ডর্মিটরি। আশ মিটিয়ে খাবার জন্য আগেভাগে অর্ডার দিলে সবই মিলবে। আনতে হয় চন্দনেশ্বর থেকে। সব দায়িত্ব পান্থনিবাসের।
মাসটা শ্রাবণ হলেও আবহাওয়ার মেজাজ কিন্তু ভাদ্রের মতো। শ্রাবণকালো রাত হলেও দিনে ছিল ভাদ্রের জ্বালা ধরানো তেজ। দুপুরে খাওয়ার পরে বন্ধুত্ব করা যেতে পারে সৈকতের পথের সঙ্গে। একটু ভাবনা, বেরিয়ে পড়লাম হারিয়ে যাওয়ার জন্য। ফটক থেকে পথের দু’ভাগ। একটি পথ হারিয়েছে জঙ্গলে। অন্যটি ঢালু, এলোমেলো গড়িয়েছে সৈকতে।
নদী সুবর্ণরেখা। এরই হাতছানিতে ঘরছাড়া ক’জন। কয়েকদিন ধরে মন বলছিল, চলো ঘুরে আসি। কিন্তু হাতে সময় মাত্র দু’দিন। তাই বলে দিঘা! ধ্যাৎ। দিঘা থাকুক, আমরা শুধু সমুদ্রের গর্জন কানে নিয়ে চলে যাব নির্জন সুবর্ণরেখায়, একাকী পান্থনিবাসে। নিস্তরঙ্গ সুবর্ণরেখার মাদকতা নিয়ে কর্মক্লান্ত শরীরে মনের সঙ্গে কথা বলা, নিজেকে খুঁজে পাওয়া...।
তালসারিতে বছরভরই জেলেরা সক্রিয়। মৎস্যবন্দরও গড়ে উঠেছে। নিরিবিলি সৈকতবেলার খানিক জুড়ে গড়ে উঠেছে কংক্রিটের কিছু ঘরবাড়ি, জেটি। বর্ষায় মাছধরার কাজও কার্যত বন্ধ। পর্যটকের ভিড় একেবারেই নেই। সুতরাং তালসারি ধরা দিল পুরনো চেহারাতেই। নির্জনতায় নিমগ্ন। শুধুই আমরা ক’জন। সুবর্ণরেখার যে শাখা-নদীটি এখানে সাগরের সঙ্গে মিশেছে তার হাঁটু জলে দাপাদাপি, কিছু সময় জলে বসে থাকার স্বাদ চৌকাঠ পার হওয়া পিপাসুদের মনে থাকবে দীর্ঘ দিন, চ্যালেঞ্জ রইল। তালসারির সমুদ্র ছুঁতে হলে ছোট্ট নদীটা নৌকায় পার হতে হয় জোয়ারের সময়। সমুদ্রের উদ্দামতায় নিজেদের বিলিয়ে দিলাম।
বালুকাবেলার রাজ্যে যারা ‘সবাই রাজা’ সেই সন্ন্যাসী কাঁকড়ার পিছনে ছুটে হতোদ্যম হতে ভাল লাগবে। কারণ এর পরেই আছে ‘সূর্য ডোবার পালা’। রাঙা আলোয় অবগুণ্ঠিতা সুবর্ণরেখা। ভাগ্য ভাল বলতেই হবে আমাদের, তাই দেখা গেল ‘শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা’। হঠাৎ ঝড়। সেই তটভূমি থেকে বালুরাশি ছেয়ে ফেলল চোখমুখ।

ঝড় উঠেছিল সেই সন্ধেয়। বেদম ঝড়। সঙ্গী উথালিপাথালি বৃষ্টি। নিষ্প্রদীপ রাত। শাল-পিয়াল-ঝাউয়ের পাতার শনশনানি, ডালে ডালে ঠোক্কর। বাইরে অবিশ্রান্ত শ্রাবণধারা, ভিতরে আমরা। অবিরাম চলছে মুখ, গরম পকোড়ায় রসনার তৃপ্তি, ধোঁয়া ওঠা চায়ের পেয়ালায় হুশ হুশ টান। হ্যারিকেনের টিমটিমে আলোয় গা ছমছমে পান্থনিবাস।
ঝড়-বৃষ্টিতে রাত কেটে গেলেও পাওনায় কমতি নেই একটুও। বালুকাবেলা, সুবর্ণরেখার শান্ত দৃশ্যকে অভিবাদন। বিদায় তালসারি। ফিরে এলাম চন্দনেশ্বর মন্দিরে। সামান্য জলযোগ সেরে গাড়ি চলল উদয়পুরে। দূর থেকে সমুদ্রের ডাক আর জেলে-নৌকার সারি দেখে মনে হল এসে গিয়েছি। মাছের গন্ধ উপেক্ষা করলাম, যখন দেখা গেল সোনারোদে জালের মধ্যে রুপোলি শস্য ছটফট করছে। জেলেজেলেনিদের কাজের মধ্যে কিছু সময় কাটিয়ে ফিরে এলাম পুরনো দিঘায়।
মেয়াদ শেষ। হরেক হোটেল, দুপুরের আহার সেরে কলকাতার বাসে উঠে পড়া।
মন বলল, ফিরে চল কাজের টানে।
কী ভাবে যাবেন
ধর্মতলা/হাওড়া স্টেশন থেকে ঘন ঘন দিঘার বাস পাওয়া যায়। এ ছাড়াও হাওড়া/শালিমার থেকে ট্রেন আছে।
টানা গাড়িতেও যাওয়া যায়। পুরনো দিঘার বাসস্ট্যান্ড থেকে ভ্যানরিকশা বা গাড়িতে প্রায় ১২ কিলোমিটার
দূরত্বে তালসারি। ফেরার দিনক্ষণ জানিয়ে রাখলে তালসারির পান্থনিবাস থেকে গাড়ি নিয়ে আসবে।
কোথায় থাকবেন
তালসারিতে থাকার জায়গা ওড়িশা ট্যুরিজমের পান্থনিবাস।
বুকিং: গভর্নমেন্ট অফ ওড়িশা ট্যুরিস্ট অফিস, উৎকল ভবন, কলকাতা।
সঙ্গে রাখবেন
টর্চ, প্রয়োজনীয় ওষুধ, টুপি ও ছাতা।
Previous Item

Kolkata

Next Item

 



অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.