|
|
|
|
সম্পাদকীয় ১... |
পশ্চিমবঙ্গ শতায়ু হউক |
পশ্চিমবঙ্গের নাম পরিবর্তনের ইচ্ছা প্রকাশ করিয়াছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সঙ্গে সঙ্গে ইহাও বলিয়াছেন যে, এই পরিবর্তন যথেষ্ট বিবেচনাসাপেক্ষ, সময়সাপেক্ষও। অনুমান করা যায়, অতঃপর এই বিষয়ে বিভিন্ন মহলের মতামত বিচার করা হইবে। মতামত মুখ্যত দুইটি প্রশ্নে। এক, পশ্চিমবঙ্গের নাম পরিবর্তনের কোনও প্রয়োজন আছে কি না। দুই, যদি সেই প্রয়োজন থাকে, তবে নূতন নাম কী হওয়া উচিত? প্রশ্ন দুইটি সমান্তরাল নহে, ক্রমান্বয়ী। প্রথম প্রশ্নের উত্তর ‘হাঁ’ হইলে তবেই দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর সন্ধানের প্রয়োজন হইবে, নচেৎ দ্বিতীয় প্রশ্নটিই উঠিবে না। আমাদের মতে, প্রথম প্রশ্নের উত্তর না। পশ্চিমবঙ্গের নাম পরিবর্তন বিধেয় নহে। কেন বিধেয় নহে? উত্তর সহজ এই নামের মধ্যে রাজ্যের ইতিহাস নিহিত রহিয়াছে। দেশভাগের ইতিহাস। ভারতের স্বাধীনতার মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের জন্ম। সেই স্বাধীনতা দেশভাগের মূল্যে অর্জিত। পশ্চিমবঙ্গকে, পঞ্জাবের মতোই, সরাসরি সেই মূল্য চুকাইয়া দিতে হইয়াছিল। বাংলা ভাগ না হইলে ‘পশ্চিম’ বঙ্গের প্রয়োজন হইত না। আজ যদি নামটিকে বিদায় জানানো হয়, তবে সেই ইতিহাসকেও বিদায় জানানো হইবে। বাঙালির আত্মবিস্মৃত জাতি বলিয়া দুর্নাম আছে, দুর্নামের সঙ্গত কারণও আছে, নূতন করিয়া এবং গায়ে পড়িয়া সেই দুর্নামের বোঝা বাড়াইবার প্রয়োজন নাই।
কথাটি কেবল রাজ্যের নাম সম্পর্কে প্রযোজ্য নহে, সাধারণ ভাবেই সত্য। শহর কিংবা রাস্তা, কলেজ কিংবা নাট্যমঞ্চ যে কোনও বস্তু বা প্রতিষ্ঠানের নামের পিছনেই একটি ইতিহাস থাকে। নাম সেই ইতিহাসের ধারক, বাহক এবং প্রতীক। এক একটি নাম এই কারণেই জ্ঞানের এক একটি আকর হিসাবে বাঁচিয়া থাকে। নাম বদলাইয়া দিলে নাম হইতে সেই ইতিহাস অন্তর্হিত হয়, সেই জ্ঞান লুপ্ত হয়। সল্ট লেক বিধাননগর হইলে উপনগরীর জলাভূমিজ জন্মবৃত্তান্ত হারাইয়া যায়, অক্টারলনি মনুমেন্ট শহিদ মিনার হইলে ব্রিটিশ রাজের ইতিহাস শহিদত্ব প্রাপ্ত হয়। পশ্চিমবঙ্গের, বিশেষত কলিকাতার দুর্ভাগ্য, এমন ইতিহাস অবলুপ্তির অগণিত দৃষ্টান্ত তাহার জীবনে তৈয়ারি হইয়াছে। তাহার দায় মুখ্যত গত সাড়ে তিন দশকের বামফ্রন্ট শাসকদের। ইতিহাস পুনর্লিখনের তাগিদে এবং নিজেদের পছন্দ ও বিশ্বাস নাগরিকদের উপর চাপাইয়া দিবার উদ্গ্র তাড়নায় তাঁহারা ক্রমাগত নাম বদলাইয়া গিয়াছেন, বিবিধ স্থানে ঐতিহাসিক মূর্তি অপসারণ করিয়া নিজেদের মনোমত মূর্তি প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন। স্বদেশের ইতিহাস এবং সংস্কৃতির প্রতি ভারতীয়, বিশেষত বঙ্গীয় কমিউনিস্টদের পরিচিত অশ্রদ্ধার ইহাও আর এক প্রকাশ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই অশ্রদ্ধার শরিক নহেন। তিনি স্বভূমি, তাহার সমাজ এবং সংস্কৃতির প্রতি বিশেষ ভাবে শ্রদ্ধাশীল। ইতিহাসের মর্যাদাও তিনি স্বভাবতই রক্ষা করিতে চাহিবেন, এমন আশা নিতান্ত সঙ্গত। সুতরাং তিনি আপন অভিমত পুনর্বিবেচনা করিয়া দেখিবেন, ইহাই প্রত্যাশিত। ইহা আরও জরুরি এই কারণে যে, তাঁহার এবং তাঁহার সরকারের হাতে বিস্তর গুরুত্বপূর্ণ কাজ রহিয়াছে। মুখ্যমন্ত্রী সেই সকল কাজ যথাসম্ভব দ্রুতগতিতে সম্পাদনের চেষ্টাও করিতেছেন, ‘এখনই করুন’ বলিয়া কাজ করিবার দায়িত্ব অন্যের উপর সমর্পণ না করিয়া নিজেও প্রবল পরিশ্রম করিতেছেন, তাঁহার প্রেরণায়, তাড়নায় এবং ব্যক্তিগত দৃষ্টান্তে পশ্চিমবঙ্গে একটি সাড়া পড়িয়া গিয়াছে কাজের সাড়া। ইহাই আবশ্যক। নাম পরিবর্তনের অ-কাজে মুখ্যমন্ত্রীর অমূল্য সময়ের একটি মুহূর্তও ব্যয় করা বিধেয় নহে। W(est Bengal) হইতে B(engal) হইলে বর্ণানুক্রমিক তালিকায় রাজ্যের নাম অনেক উপরে উঠিবে ঠিকই, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ যদি কাজের মধ্য দিয়া ভারতসভায় উপরের সারিতে উঠিয়া আসে, তাহাই হইবে প্রকৃত উত্তরণ। |
|
|
|
|
|