দেশ জুড়ে প্রচারে নামবে ‘আক্রান্ত’ সিপিএম
‘দায়-বিমুখ’ কারাটের জন্য অস্বস্তির জোড়া কাঁটা
দু’জনের কেউই সিপিএমের পলিটব্যুরো বৈঠকে নেই। কিন্তু দলের একাংশের মতে, অদৃশ্য থাকলেও তাঁরা ভীষণ ভাবে ‘উপস্থিত’ হায়দরাবাদে।
এক জন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। বিধানসভা ভোটে বিপর্যয়ের পরে এই নিয়ে পরপর দু’বার যিনি পলিটব্যুরোর বৈঠকে অনুপস্থিত থাকলেন। প্রথম প্রথম কিছু লোকের ধারণা হয়েছিল, বুদ্ধবাবু হায়দরাবাদ না-আসায় পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটিতে সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাটের ‘সুবিধা’ হবে। এখন কিন্তু সুচিন্তিত বিবেচনার পর তাঁদের বক্তব্য, তেমনটা না-ও হতে পারে। বরং পলিটব্যুরো এবং কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে বুদ্ধবাবুর ‘অনুপস্থিতি’-কে দেখা হতে পারে তাঁর ‘নীরব প্রতিবাদ’ হিসেবে। তবে একই সঙ্গে সিপিএমের অন্দরে এমন অভিমতও রয়েছে যে, হায়দরাবাদে না-এসে বুদ্ধবাবু প্রকারান্তরে ওই হারের জন্য তাঁর নিজের ‘দায়’ স্বীকার করে নিয়েছেন।
পশ্চিমবঙ্গে নজিরবিহীন ভোট-বিপর্যয় এবং কেরলে হারের পর দলের সাধারণ সম্পাদক কারাট অবশ্য জানিয়েছিলেন, ওই হারের ‘দায়’ সকলেরই। কোনও ব্যক্তি বিশেষের নয়। কমিউনিস্ট পার্টিতে কখনও ব্যর্থতার দায় কারও একার হয় না। সেটা হয় বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলে। ফলে সকলে মিলেই এই বেনজির বিপর্যয়ের সমাধান খুঁজতে হবে। সেই লক্ষ্যেই হায়দরাবাদে শুক্রবার হল পলিটব্যুরো বৈঠক। আজ, শনিবার এবং কাল, রবিবার হবে কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক।
তবে সিপিএমের একাংশের অভিমত, বিধানসভা ভোটে যে ধস নেমেছে, তাতে দলের সকলেই চিন্তিত এবং উদ্বিগ্ন। ফলে এই সংকট সময়ে কেউই প্রকাশ্যে কারাটের বিরুদ্ধে যাবেন না। এমনকী, দলের অন্দরে যাঁরা ‘কারাট-হটাও’ উদ্যোগে সামিল হয়েছেন, তাঁরাও এই সময়ে দলকে ‘শক্তিশালী’ করার বিষয়েই বেশি মনোনিবেশ করবেন। বস্তুত, আব্দুর রেজ্জাক মোল্লার মতো নেতা ছাড়া এখনও পর্যন্ত দলের বিপর্যয় নিয়ে প্রকাশ্যে কেউই মুখ খোলেননি। দলের অন্দরে বিতর্ক এবং চাপানউতোর যতই চলুক না কেন! কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্যের কথায়, “দলের অস্তিত্বই যখন সঙ্কটে, তখন নিজেদের মধ্যে দোষারোপ বা পাল্টা দোষারোপ করে লাভ নেই। এখন এককাট্টা হয়ে বিপর্যয় মোকাবিলা করাই প্রধান কাজ।”
হায়দরাবাদে সাংবাদিকদের মুখোমুখি বিমান বসু। শুক্রবার দেশকল্যাণ চৌধুরীর তোলা ছবি।
দলের একাংশের মতে, বেশ কিছু বিষয়ে বুদ্ধবাবু কারাটের সঙ্গে একমত নন। তবে সে বিষয়টি তিনি কখনওই প্রকাশ্যে আনেননি। বরং কেরলের সংবাদপত্রে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে পাল্টা বলেছিলেন, কারাটের সঙ্গে তাঁর কোনও ‘সমস্যা’ নেই। পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি খবরের কাগজে এটা বলা হয়। দলের তরফে তাঁর অসুস্থতার কথা বলা হলেও বুদ্ধবাবু নিজে হায়দরাবাদ না-যাওয়া নিয়েও প্রকাশ্যে কোনও মন্তব্য করেননি। কিন্তু মানুষ হিসেবে ‘আবেগপ্রবণ’ হওয়ায় রাজ্যে বিপর্যয়ের পর হায়দরাবাদের বৈঠক তিনি এড়িয়ে যেতে চেয়েছেন বলেই দলের একাংশ মনে করছেন। দলের এই অংশের মতে, হায়দরাবাদ-সফর বাতিল করার মধ্য দিয়ে বুদ্ধবাবু বোঝাতে চেয়েছেন যে, ভোটে বিপর্যয়ের ‘দায়’ নিয়ে তিনি এখনও পলিটব্যুরো এবং কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে ইস্তফার বিষয়ে ‘অনড়’। শেষ পর্যন্ত তিনি সেই সিদ্ধান্ত বদলান কিনা, সেটাই দেখার।
পলিটব্যুরোর বৈঠকে এ দিন প্রত্যাশিত ভাবেই বুদ্ধ-প্রসঙ্গ এসেছিল। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু বুদ্ধবাবুর ‘শারীরিক দুর্বলতা’র কথাই জানিয়ে বলেছেন, এখন বাড়ি থেকে দলের রাজ্য দফতর ছাড়া বড় সফর করা প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষে সমস্যাজনক।
কারাটের ‘অস্বস্তি’র দ্বিতীয় কারণ ভি এস অচ্যুতানন্দন। ২০০৯-এর জুন মাস থেকে তিনি পলিটব্যুরোয় নেই। এর মধ্যে যত বারই তাঁকে ফেরানোর চেষ্টা হয়েছে, পলিটব্যুরোয় বাধা দিয়েছেন কেরল সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক পিনারাই বিজয়ন, তাঁর ‘ঘনিষ্ঠ’ কোডিয়ারি বালকৃষ্ণেরা। কারাটও বরাবরই বিজয়নদের কথাই শুনে এসেছেন। কিন্তু এ বার ভি এসের নেতৃত্বে কেরলে এলডিএফের দুর্দান্ত লড়াই এবং ‘নৈতিক জয়ে’র পরে রাজ্যের অশীতিপর প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা অধুনা বিরোধী দলনেতাকে পলিটব্যুরোয় ফিরিয়েনেওয়ার দাবি জোরালো গতি পেয়েছে। পলিটব্যুরো এবং কেন্দ্রীয় কমিটিতে পেশ-করা বিজয়নের রিপোর্টে প্রশংসাসূচক উল্লেখ পেয়েছে ভি এসের ভূমিকা। কেরল সিপিএম সূত্রের খবর, এই পরিস্থিতিতে ভি এস-কে পলিটব্যুরোয় ফেরানোর প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হতে পারে কেন্দ্রীয় কমিটিতে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়তো আসন্ন পার্টি কংগ্রেসের জন্য স্থগিত রাখা হতে পারে। কিন্তু জমি তৈরি হয়ে যেতে পারে হায়দরাবাদেই।
ভি এস শেষ পর্যন্ত পলিটব্যুরোয় ফিরে এলে বিজয়নদের মতোই কারাটের কাছেও তা খুব ‘স্বস্তিদায়ক’ অভিজ্ঞতা হবে না!
এমনিতেই সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দলের এই বিপর্যয় কারাটের পক্ষে যথেষ্ট ‘অস্বস্তিকর’। ঠিক যেমন পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে তা ‘অস্বস্তিকর’ রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুর কাছে। অন্ধ্রপ্রদেশ সিপিএমের রাজ্য সদর দফতর এম বি ভবনে শুক্রবার দিনভর পলিটব্যুরো বৈঠকে চার রাজ্যের নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে রাজ্য সম্পাদকদের রিপোর্ট জমা পড়েছে। তৈরি হয়েছে কেন্দ্রীয় কমিটিতে পেশ করার জন্য পলিটব্যুরোর রিপোর্টও। দলীয় সূত্রের খবর, গত সপ্তাহে আলিমুদ্দিনে রাজ্য কমিটির বৈঠকে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সম্পাদক বিমানবাবু যা বলেছিলেন, সেই সুরেই কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে পেশ-করা রিপোর্টেও রাজ্যে প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক ব্যর্থতার কথা বলেছেন তিনি। লোকসভা ভোটে ভরাডুবির পরে প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক ক্ষেত্রে জমি পুনরুদ্ধারের যে লক্ষ্য সামনে রাখা হয়েছিল, তা পূরণ করা যায়নি বলে দলের অন্দরে জানিয়েছেন বিমানবাবু।
রাজ্য সিপিএমের একটি অংশ অবশ্য এখনও বলার চেষ্টা করছে যে, পরমাণু চুক্তি নিয়ে কংগ্রেসের উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করার ফলেই কংগ্রেস-তৃণমূল জোট গঠন সম্ভব হয়েছিল এবং তার পরিণতিতেই নির্বাচনে বিপর্যয়। কিন্তু রাজ্যের সিংহভাগ নেতাই মনে করেন এবং দলের অন্দরেও বলেছেন, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম-সহ বিভিন্ন প্রশ্নে, প্রশাসনিক এবং সাংগঠনিক ব্যর্থতার কারণেই এই বিপুল হার হয়েছে। সে দিক থেকে কারাটের সঙ্গে তাঁরা যে খুব একটা ‘ভিন্নমত’, তা-ও নয়। কারণ, দুই রাজ্যে ক্ষমতা হারানোর পরে পলিটব্যুরোয় প্রাথমিক আলোচনার পরে কারাট প্রশ্ন তুলেছিলেন, ২০০৬-এ বুদ্ধবাবুর নেতৃত্বাধীন সরকারের বিপুল নির্বাচনী সাফল্যের ‘কৃতিত্ব’ তিনি যখন নেননি, তা হলে ২০১১-এ বিপর্যয়ের ‘দায়’ কেন নেবেন? কারাট বলতে চেয়েছিলেন, ‘দায়’ একান্ত ভাবেই ‘সামগ্রিক’। কোনও ব্যক্তি বিশেষের নয়। তা হতেও পারে না।
সিপিএম সূত্রের খবর, এই পরিস্থিতিতে নির্বাচনী বিপর্যয় নিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে দলের সদস্যদের ‘মনোভাব’ বোঝার চেষ্টা করবেন কারাট। দলের একটি অংশের অভিমত, এই পরিস্থিতিতে কারাটের সামনে একটি পথ খোলা রয়েছে। তা হল সাধারণ সম্পাদক পদের মেয়াদ বেঁধে দিয়ে নৈতিক স্বচ্ছতা দেখিয়ে পদ ছেড়ে যাওয়া। যা একজন ‘পরাজিত সেনাপতি’ হিসেবে দায় ছাড়ার চেয়ে রাজনৈতিক দিক দিয়ে অনেক বেশি সুবিধাজনক হবে তাঁর পক্ষে। এখন দেখার, আগামী দু’দিনে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের মনোভাব বুঝে কারাট কোন রাস্তা নেন।
First Page Desh Next Story



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.