নেই তিনি
গরহাজির বুদ্ধ, ফের ‘বার্তা’ দিলেন কারাটকে
টিকিট কেটেও হায়দরাবাদের বিমান ধরলেন না বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য! নির্বাচনী বিপর্যয়ের পরে সিপিএমের কেন্দ্রীয় স্তরের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক এড়িয়ে যাওয়ার প্রায় ‘রেকর্ড’ গড়ে ফেললেন পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী!
দলের তরফে বলা হচ্ছে, তাঁর ফুসফুসে সংক্রমণ হয়েছে। এবং তা যথেষ্ট গুরুতর। সেই অসুস্থতার কারণেই তাঁর হায়দরাবাদ-সফর বাতিল করেছেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। ঘটনাচক্রে, বৃহস্পতিবার তিনি আলিমুদ্দিনে এসেছিলেন অন্যান্যদিনের মতোই। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জানান, তিনি ‘ভাল’ আছেন। তবে হায়দরাবাদ কেন গেলেন না, সে প্রশ্নের জবাব যথারীতি এড়িয়েই যান। এদিন আলিমুদ্দিনে বামফ্রন্টের বৈঠক ছিল। দলীয় দফতরে থাকলেও সেই বৈঠকে ছিলেন না বুদ্ধবাবু। বৈঠকের পর সাংবাদিক সম্মেলনে বিমানবাবুকে বুদ্ধবাবুর না-যাওয়া নিয়ে প্রশ্ন করায় তিনি বলেন, “এটা বামফ্রন্টের আলোচ্য বিষয় ছিল না। আমি বামফ্রন্টের বৈঠক নিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করছি!”
বিধানসভা ভোটে ভরাডুবির পরে দিল্লিতে দলের প্রথম পলিটব্যুরো বৈঠকেও যাননি বুদ্ধবাবু। এ বার পলিটব্যুরোর সঙ্গেই দু’দিনের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক ডাকা হয়েছে নির্বাচনী বিপর্যয়ের ময়নাতদন্ত করার জন্যই। দিল্লি, কলকাতা বা তিরুঅনন্তপুরমের বদলে হায়দরাবাদে বৈঠক সরিয়ে নিয়ে আসার অন্যতম কারণও ছিলেন বুদ্ধবাবু। যাতে প্রচারমাধ্যমের চড়া আলোর বাইরে ‘আন্তরিক’ ভাবে দলে আত্মসমীক্ষার কাজ শুরু করা যায় এবং তাঁর ‘দিল্লি-অনীহা’ সরিয়ে বুদ্ধবাবুও সেখানে উপস্থিত হতে পারেন। কিন্তু বুদ্ধবাবু পলিটব্যুরো এবং কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে সেই মুখ ফিরিয়েই রইলেন।
বিমানে হায়দরাবাদের পথে নিরুপম সেন, মহম্মদ আমিন
এবং বিমান বসু। বৃহস্পতিবার দেশকল্যাণ চৌধুরীর তোলা ছবি।
রাজ্যে ক্ষমতা হারানোর ইঙ্গিত পাওয়া মাত্রই এ কে জি ভবনে ফোন করে পলিটব্যুরো এবং কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে সরে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন বুদ্ধবাবু। তাঁকে সে যাত্রায় ‘নিরস্ত’ করা হয়েছিল। ‘বিড়ম্বনা’ সামাল দিতে সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট থেকে রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু পর্যন্ত বুদ্ধবাবুর পদত্যাগের ‘ইচ্ছা’র খবর ‘গুজব’ বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের তরফে বহু চেষ্টার পরেও বুদ্ধবাবু হায়দরাবাদ না-আসায় তাঁর ‘ইচ্ছা’ নিয়ে দলের অন্দরে নতুন করে বিস্তর জল্পনা শুরু হয়েছে। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর মনোভাব জেনে দলেরই একাংশের অভিমত, গত সপ্তাহে আলিমুদ্দিনে রাজ্য কমিটির বৈঠকে উপস্থিত থেকে কারাট যে ভাবে বিপর্যয়ের ‘দায়’ প্রকারান্তরে রাজ্য নেতৃত্বের উপরেই চাপিয়ে দিয়েছিলেন এবং দলে আক্রমণের মুখে তাঁর ‘পাশে’ দাঁড়াননি, হায়দরাবাদে অনুপস্থিত থেকে তার বিরুদ্ধে ‘প্রতীকী প্রতিবাদ’ জানালেন বুদ্ধবাবু!
তবে ইতিপূর্বে কেন্দ্রীয় স্তরের বৈঠক এড়িয়ে গিয়ে বুদ্ধবাবু যতটা ‘স্পষ্ট বার্তা’ কারাটকে দিতে পেরেছিলেন, এ বার তা পারবেন কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। কারণ ভিন্ রাজ্য থেকে কেন্দ্রীয় কমিটির একটি বড় অংশই পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর বারংবার গরহাজির থাকার অভ্যাসে প্রবল ‘ক্ষুব্ধ’। কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্যের কথায়, “বুদ্ধবাবুর মনে হচ্ছে ‘এসএমএস’ (স্কিপ মিটিংস সিনড্রোম) দেখা দিয়েছে! লোকসভা এবং পুরসভার ভোটে বিপর্যয়ের পরে পরপর পলিটব্যুরো বৈঠকে যাননি। বিজয়ওয়াড়ায় কেন্দ্রীয় কমিটির বর্ধিত অধিবেশনের আগে পলিটব্যুরোর বৈঠকে এসেও মাঝপথে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। এ বার বিধানসভা ভোটে হারের পরেও এলেন না!”
বিধানসভা ভোটে বিপর্যয়ের পরে তিনি যখন পলিটব্যুরো এবং কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে সরে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন, তখন বুদ্ধবাবুকে বোঝাতে সর্বাগ্রে আসরে নেমেছিলেন পলিটব্যুরোর সদস্য সীতারাম ইয়েচুরি। কলকাতায় গিয়ে ইয়েচুরির ‘দৌত্যে’র ফলেই রানি রাসমণি অ্যাভেনিউয়ে বামফ্রন্টের নির্বাচনোত্তর প্রথম জনসভায় প্রথম বার জনসমক্ষে মুখ খুলেছিলেন বুদ্ধবাবু। হায়দরাবাদে এসে তিনি যাতে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন, সেই মর্মেই বুদ্ধবাবুর সঙ্গে আলোচনা চালিয়েছিলেন ইয়েচুরি। প্রাথমিক অনড় মনোভাব ছেড়ে বুদ্ধবাবুর তরফে কিছুটা ‘ইতিবাচক’ সাড়া মেলায় রাজ্য থেকে দলের আরও তিন পলিটব্যুরো সদস্য বিমানবাবু, নিরুপম সেন ও মহম্মদ আমিনের সঙ্গেই বিমানের টিকিট কাটা হয়েছিল প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর। হায়দরাবাদের রাজীব গাঁধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমে বৃহস্পতিবার দুপুরে ইয়েচুরি খবর পান, শেষ পর্যন্ত বুদ্ধবাবু অন্ধ্রপ্রদেশের উড়ান ধরছেন না!
সিপিএম সূত্রের ব্যাখ্যায়, কারাটের সামনেই রাজ্য কমিটির একাধিক সদস্য বিগত সরকার পরিচালনা এবং দলের রাজ্য নেতৃত্বের সমালোচনায় মুখর হওয়ায় বুদ্ধবাবুর ধারণা হয়, নিজের রাজ্যেও তাঁর ‘পাশে’ বিশেষ কেউ নেই। কারাটও তাঁকে ‘রক্ষা’ করছেন না। তা হলে সব দায় তো তাঁর একারই হয়! কারাট নিজেও বুদ্ধবাবুকে হায়দরাবাদে আসতে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু বুদ্ধবাবু রাজ্য কমিটির ঘটনা দেখার পর থেকেই ইঙ্গিত দিতে শুরু করেন, তাঁর শরীরটা ভাল যাচ্ছে না। বুদ্ধবাবু যে শেষ পর্যন্ত শারীরিক কোনও কারণ দেখিয়ে হায়দরাবাদ এড়িয়ে যেতে পারেন, দিল্লি ফিরে এ কে জি ভবনে তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলে সেই ‘সম্ভাবনা’র কথা আগাম আলোচনাও করেছিলেন কারাট!
এই পরিস্থিতিতে সব চেয়ে ‘বিড়ম্বনা’য় অবশ্যই বিমানবাবু। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি চেষ্টা চালিয়েছেন বুদ্ধবাবুকে রাজি করানোর। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। আলিমুদ্দিনে তো বলেনইনি, হায়দরাবাদের উড়ান ধরতে যাওয়ার আগেও বুদ্ধবাবুকে নিয়ে প্রশ্নের মুখে বলেছেন, “এই নিয়ে কোনও মন্তব্য করব না।” বুদ্ধবাবু দিল্লির পলিটব্যুরোয় না-যাওয়ার সময় বিমানবাবু বলেছিলেন, জেলায় জেলায় সন্ত্রাস-পরিস্থিতির উপরে নজরদারি চালানোর জন্য তিনি গেলেন না। এ বার বলা হচ্ছে ফুসফুসে সংক্রমণের কথা!
বুদ্ধবাবুর আচরণে যারপরনাই ক্ষুব্ধ সিপিএমের দক্ষিণ ভারতীয় শিবির। পলিটব্যুরোর এক দক্ষিণী সদস্যের কথায়, “লোকসভায় খারাপ ফল করেও কেরলে ভি এস অচ্যুতানন্দনের নেতৃত্বেই বিধানসভায় ঘুরে দাঁড়ানো গিয়েছে। আমাদের দলে ব্যক্তিগত স্তরে কিছু হয় না। সবটাই যৌথ নেতৃত্ব এবং দায়িত্ব। এক জন প্রবীণ নেতা সেটা বুঝবেন না?” কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্যের আরও ঝাঁঝালো বক্তব্য, “ওঁর আচরণে মনে হচ্ছে, উনি নিজে রাজা আর দলে বাকি সব প্রজা! দলীয় অনুশাসন না-মানায় ভি এসের মতো প্রতিষ্ঠাতা সদস্যকে যদি পলিটব্যুরো থেকে বহিষ্কার করা যায়, ওঁকে ওঁর নিজের ইচ্ছা মেনেই কেন পলিটব্যুরো থেকে অব্যাহতি দেওয়া হবে না?” পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনী প্রচারের আর এক মুখ গৌতম দেবও শারীরিক কারণে কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে সম্ভবত থাকছেন না। গোটা ঘটনাতেই বঙ্গ ব্রিগেডের তরফে দলের অন্দরে ‘ভুল বার্তা’ যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। অন্ধ্র সিপিএমের রাজ্য সদর দফতর এম বাসবপুন্নাইয়া ভবনেও (যেখানে আজ, শুক্রবার পলিটব্যুরোর বৈঠক বসবে) প্রশ্ন উঠছে, যাঁরা জেলায় জেলায় আক্রান্ত কর্মীদের পাশে দাঁড়াতে যান না আবার দলীয় বৈঠকেও অনুপস্থিত থাকেন, তাঁদের প্রতি কি ‘কড়া বার্তা’ পাঠানো যায় না?
First Page Rajya Next Story



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.