|
|
|
|
স্বস্তিতে কারাট-শিবির, বিপাকে বঙ্গ সিপিএম |
প্রেমাংশু চৌধুরী • হায়দরাবাদ |
খেলা শুরুর আগেই ‘অ্যাডভান্টেজ’ প্রকাশ কারাট।
পশ্চিমবঙ্গ এবং কেরলে নির্বাচনী বিপর্যয়ের পর হায়দরাবাদে পলিটব্যুরো এবং কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক থেকেই প্রবল ‘কারাট-বিরোধী’ হাওয়া তুলতে চেয়েছিলেন সিপিএমের কারাট-বিরোধী শিবিরের নেতারা। তাঁদের আশা ছিল, আগামী পার্টি কংগ্রেসে এই হাওয়াই ঝড় হয়ে কারাটকে দলের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে গদিচ্যুত করবে।
কিন্তু সব আশায় জল ঢেলে দিয়ে হায়দরাবাদে অনুপস্থিত থাকছেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। যাঁকে সামনে রেখে কারাট-বিরোধী শিবির সিপিএমের সাধারণ সম্পাদকের রাজনৈতিক রণকৌশলের সমালোচনায় মুখর হতে চাইছিল। পরিকল্পনা ছিল, পশ্চিমবঙ্গে বামদুর্গের পতনের পর দলের নীচুস্তরে তৈরি হওয়া হতাশা ও ক্ষোভের তিরকে কারাটের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার। এত দিন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় কমিটিতে কারাটের পক্ষেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেও কারাট-বিরোধী শিবির মনে করছিল, এবার অনেকেই অবস্থান পরিবর্তন করবেন। ফলে গরিষ্ঠ অংশ থাকবেন কারাটের বিপক্ষেই।
কিন্তু এক বুদ্ধবাবুর অনুপস্থিতি ফের কারাটেরই ‘সুবিধা’ করে দিল বলে মনে করছেন তাঁরা। কারণ, পশ্চিমবঙ্গের ফলাফল নিয়ে আলোচনার জন্য ডাকা শীর্ষ কমিটির বৈঠকে বুদ্ধবাবু না-আসায় তিনি নিজে থেকেই হারের দায় নিচ্ছেন বলে ‘বার্তা’ যাবে। তা ছাড়া যাবতীয় আক্রমণ সামলাতে হবে একা রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুকে। ভোট-যুদ্ধে দলের অন্য সেনাপতি গৌতম দেবও কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে যোগ দিচ্ছেন না। এ সব দেখেশুনে হতাশ কারাট-বিরোধী শিবিরের এক নেতার মন্তব্য, “এরপরে আর আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের পাশে দাঁড়ানোর কোনও অর্থই হয় না!”
দলীয় সূত্রের খবর, ঠিক এই পরিস্থিতিতে দলের উপর নিজের নিয়ন্ত্রণ আরও সুপ্রতিষ্ঠিত করতে দু’টি ‘মাস্টারস্ট্রোক’ দিতে যাচ্ছেন কারাট।
প্রথমত, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে ভোটের ফল ঘোষণার পর থেকেই রাজ্যের নেতা-কর্মীদের উপর ‘তৃণমূলী আক্রমণ’ সম্পর্কে একটি নোট বিলি করা হবে। এ নিয়ে পলিটব্যুরোতেও আলোচনা হয়েছিল। ওই বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে এবার গোটা দলকে পশ্চিমবঙ্গের পাশে দাঁড়াতে বলবেন সাধারণ সম্পাদক। বার্তা দেবেন, তিনিও পশ্চিমবঙ্গের পাশেই আছেন।দ্বিতীয়ত, পশ্চিমবঙ্গ ও কেরলের বাইরে অন্য রাজ্যের কারাট-ঘনিষ্ঠ নেতারা কেন্দ্রীয় কমিটিতে পশ্চিমবঙ্গের দলীয় নেতৃত্ব ও বিগত সরকারের কাজকর্ম নিয়ে আক্রমণে যাবেন। একদিকে তাঁরা সাংগঠনিক দুর্বলতার প্রশ্ন তুলে বিমানবাবু তথা রাজ্য নেতৃত্বকে আক্রমণ করবেন। অন্যদিকে, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম থেকে শুরু করে ভোটের আগে পর্যন্ত রাজ্যের প্রশাসন কার্যত ভেঙে পড়েছিল বলে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকারের ভূমিকার সমালোচনা করবেন।
পলিটব্যুরোয় কারাট-ঘনিষ্ঠ এক নেতা অবশ্য যুক্তি দিচ্ছেন, “আলোচনার মাধ্যমে হারের পিছনে ভুল-ভ্রান্তি খুঁজে বার করাটাই আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। তা করতে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গে দল বা সরকারের কাজকর্ম নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তার মধ্যে অন্য তাৎপর্য না খোঁজাই উচিত। রাজ্য কমিটির বৈঠকেও তো জেলার নেতারা রাজ্য সম্পাদক ও প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর সমালোচনা করেছেন।” এখানেই বেকায়দায় আলিমুদ্দিনের নেতারা। কারণ, ভোটের ফলাফল নিয়ে রাজ্য কমিটির আলোচনায় কারাট নিজেই উপস্থিত ছিলেন। কাজেই তিনি খুব ভাল করেই জানেন, রাজ্যের একটা অংশও তাঁর মতোই ‘রাজ্য স্তরের প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক দুবর্লতা’-ই হারের কারণ বলে মনে করেন।
কারাট-ঘনিষ্ঠ নেতারা এ-ও বলছেন, হারের জন্য কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের তরফে কখনওই ‘ব্যক্তিগত’ ভাবে কাউকে দায়ী করা হয়নি। সাধারণ সম্পাদক নিজেও ‘সামগ্রিক দায়বদ্ধতা’র কথাই বলেছেন। হারের পরে বুদ্ধবাবুর পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে সরে দাঁড়ানোর ইচ্ছা জানিয়ে দিল্লিতে পলিটব্যুরো বৈঠকে যোগ না-দেওয়ার প্রশ্নেও সংবাদমাধ্যমের সামনে তিনি বুদ্ধবাবুকে যথাসাধ্য আড়াল করার চেষ্টা করেছেন। আবার বিরুদ্ধ শিবিরের যুক্তি হল, রাজ্য কমিটিতে শুধু বিমান-বুদ্ধর সমালোচনাই হয়নি। পরমাণু চুক্তিতে সমর্থন প্রত্যাহার করে কংগ্রেসের সঙ্গে তৃণমূলের জোটের রাস্তা তৈরি করে দেওয়ার জন্য কারাটের রাজনৈতিক লাইনেরও সমালোচনা হয়েছিল। তা-ও কারাট খুব ভাল করেই জানেন। আর তা হবে জেনেই তিনি বুদ্ধ-বিরোধী আক্রমণের পথ তিনি নিজেই খুলে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ২০০৬-এ পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের বিপুল ভোটের জয়ের কৃতিত্ব তিনি নেননি। কাজেই ২০১১-র হারের দায়ও নেবেন না। সেই পথে হেঁটেই পশ্চিমবঙ্গে হারের সব দায় শুধু রাজ্য নেতৃত্ব ও সরকারের উপরেই চাপাবার চেষ্টা করবেন কারাট-অনুগামীরা।
ফলে আগামীকাল বৈঠক শুরুর আগে ‘বেঙ্গল-লবি’ যথেষ্ট কোণঠাসা।
কিন্তু গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব কাটিয়ে ফের শক্তিশালী হয়ে উঠছে ‘কেরল-লবি’। কেরলে সামান্য ব্যবধানে হারকে আদৌ হার বলেই মনে করছেন না রাজ্য নেতৃত্ব। পিনারাই বিজয়ন এবং ভি এস অচ্যুতানন্দনের মধ্যে দূরত্বও যথাসম্ভব কম করে দেখানোর যথাসাধ্য চেষ্টা চলছে। তার মধ্যেও কারাট-বিরোধী শিবিরের নেতাদের ক্ষীণ আশা অচ্যুতানন্দনকে নিয়ে। বুদ্ধবাবুর অনুপস্থিতিতে একমাত্র তিনিই কারাট-গোষ্ঠীকে বেকায়দায় ফেলতে পারেন। ভোটের ফলাফলও তাঁর পক্ষে। দল প্রথমে টিকিট না-দিলেও পলিটব্যুরো থেকে রাজ্য নেতৃত্ব মানছে, তাঁর জন্যই রাজ্যে তুলনায় ‘ভাল’ ফল হয়েছে। বুদ্ধবাবুর অনুপস্থিতিতে তাই আপাতত বৃদ্ধ অচ্যুতানন্দনের দিকেই তাকিয়ে কারাট-বিরোধী শিবির। |
|
|
|
|
|