মধুরেণ সমাপয়েৎ কিন্তু হয়নি। মারিয়া জানিয়ে দিয়েছিলেন, হুসেনকে বিয়ে করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। হুসেনের ওই ৮০টি ছবি রয়ে গিয়েছিল মারিয়ার কাছে। বেশ কয়েক বছর আগে মেলবোর্নে এক বন্ধুর সূত্রে ফের দেখা হওয়ার পরে মারিয়া হুসেনকে বলেছিলেন, জীবন-সায়াহ্নে পৌঁছে তাঁর মনে হচ্ছে, এত বছর ধরে আগলে রাখা ছবিগুলো ভারতের মাটিতেই থাকা উচিত। হুসেনকে ছবিগুলো ‘উপহার’ দেন মারিয়া। আপাতত সেগুলো দুবাইয়ে। হুসেন চেয়েছিলেন, ছবিগুলো কলকাতায় থাকুক। কারণ সাবেক বম্বে, প্রাগ, রোম আর মেলবোর্নে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা হুসেন-মারিয়ার গল্পে কলকাতাও একটা অবিচ্ছেদ্য চরিত্র। হুসেন মনে করতেন, এই গল্পটা ধরে রাখার ‘‘উপযুক্ত জায়গা কলকাতার কোনও গ্যালারি’’। তাই অদূর ভবিষ্যতে যে ‘কলকাতা মিউজিয়াম অফ মডার্ন আটর্’ তৈরি হতে চলেছে, সেখানেই ‘মারিয়া জুরকোভা সংগ্রহে’র স্থান পাওয়ার কথা।
১৯৫৬ সালে হুসেন ও মারিয়ার সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে এগিয়েছিল আরও একটি প্রেমকাহিনি। তথ্যচিত্রের কাজে ভারতে আসা ইতালীয় পরিচালক রোবের্তো রোসেলিনির সঙ্গে হরিসাধন দাশগুপ্তের স্ত্রী, কলকাতার মেয়ে সোনালি দাশগুপ্তের সম্পর্ক নিয়ে তখন সারা বিশ্বের সংবাদমাধ্যম তোলপাড়। হুসেন বলেছিলেন, ‘‘আমেরিকার একটা কাগজ ওদের ছবি তুলে দেওয়ার জন্য আমায় ১০ হাজার ডলার দেবে বলেছিল। কিন্তু আমি বন্ধুর (রোসেলিনি) সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারিনি।’’ নিজের স্ত্রীর ছদ্মবেশে সোনালিকে নিয়ে বম্বে থেকে দিল্লি গিয়েছিলেন হুসেন। দিল্লি থেকেই রোসেলিনির সঙ্গে পালিয়ে বিয়ে করেন সোনালি। আর তার কিছু দিন পরেই হুসেন রোমে গিয়ে ওঠেন রোসেলিনির বাড়িতে। সেখান থেকেই মারিয়াকে বিয়ের স্বপ্ন নিয়ে চেকোস্লোভাকিয়া পাড়ি।
‘‘একটা পুরনো গাড়ি কিনলাম, চালানো শিখলাম আর ‘দুলহা’ সাজার দিকে মন গিয়েছিল বলে একটা বিয়ের সাদা পোশাক কিনলাম। সবে দু’সপ্তাহ আগে গাড়ি চালানো শিখেছি। তাই বন্ধুরা কেউই ‘বারাতি’ হয়ে গাড়িতে ওঠার ঝুঁকি নিল না।’’ অগত্যা হুসেন একাই রোম থেকে মিলান, মিলান থেকে জুরিখ গাড়ি চালিয়ে যান। ‘‘সুইস আল্পস পার হওয়ার সময় টানা ১৪ ঘণ্টা গাড়ি চালিয়েছিলাম। তখন তো এত টানেল তৈরি হয়নি।’’
চেক সীমান্তে দেখা হয় মারিয়ার সঙ্গে। কিন্তু মারিয়া বলে দেন, তিনি পাশ্চাত্যের, হুসেন প্রাচ্যের। ফলে সংঘাত হবেই।
দেশ ছেড়ে কেউ সুখী হয় না।
দু’বছর মারিয়ার সঙ্গে কথা বলেননি হুসেন। মারিয়া এক অধ্যাপককে বিয়ে করেন। তিনটি সন্তানও হয়। হুসেন ডুবে যান কাজে। ৪৬ বছর পরে মেলবোর্নে মারিয়ার বাড়িতে ওই ৮০টা ছবি নতুন করে আবিষ্কার করেন হুসেন।
প্রচুর প্রস্তাব সত্ত্বেও মারিয়া যেগুলো বেচেননি।
পরে হুসেন বলেছিলেন, ‘‘মনে হয় মারিয়া ঠিকই বলেছিল। আমাদেরও যদি বিয়ে হত, টিঁকত না। যাকে ভালবাসো, তাকে বিয়ে করা উচিত নয়।’’ মারিয়ার লেখা একটা চিঠি সব সময়ে রাখতেন আলখাল্লার পকেটে। মনে পড়ে গেল বেশ কিছু দিন আগে ‘মুঘল-এ-আজম’ সিরিজের ছবি আঁকতে ব্যস্ত হুসেনের একটা অনবদ্য ফ্রেম। সেলিমের বাহুপাশে আনারকলি। হুসেন আঁকছেন। কাছেই পড়ে রয়েছে একটা কবিতার বই।
ক্যানভাসে গর্জে উঠছিল বিদ্রোহীর তুলি প্রেমই সর্বশ্রেষ্ঠ। |