পঁচানব্বইয়ে থেমে গেল মকবুলের ‘ঘোড়া’।
ঘোড়া আর নারী। সারা জীবন ধরে যাদের আঁকতে কখনও ক্লান্ত বোধ করেননি মকবুল ফিদা হুসেন।
একেবারে শেষেও দোহা-র একটি গ্যালারির জন্য মুরানো গ্লাসের উপরে ঘোড়ার ছবিই আঁকছিলেন। অতিকায় সেই ‘ইনস্টলেশন’-এর জন্য সুর তৈরির কথা ছিল এ আর রহমানের।
কালো শেরওয়ানি। খালি পা। রুপো-বাঁধানো কালো ছড়ি এক হাতে, অন্য হাতে ছবি আঁকার ব্রাশ। ধপধপে সাদা চুল আর দাড়ি নিয়ে সোজা হেঁটে যাচ্ছেন এক ‘যুবক’। মে ফেয়ার থেকে শেফার্ড মার্কেটের রাস্তায় এ দৃশ্য দেখা যাবে না আর। ‘এমএফএইচওয়ান’ নেমপ্লেট নিয়ে কালো রোলস রয়েসও আর ছুটবে কি? ক্রিস্টির নিলাম এ দিন শুরু হল এক মিনিট নীরবতা পালন করে।
ফুসফুসে জল জমেছিল। শ্বাসকষ্ট নিয়ে শেষ কয়েকটা সপ্তাহ বারবারই ভর্তি হতে হচ্ছিল লন্ডনের রয়্যাল ব্রম্পটন হাসপাতালে। সেখানেই রাত আড়াইটে নাগাদ শেষ নিঃশ্বাস পড়ল। হুসেনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু আনোয়ার সিদ্দিকি বললেন, ‘‘আমরা ভাবতাম, হুসেন হার মানতে জানেন না। উনি একশো বছর বাঁচবেনই। তবে ইসলামের হিজরি ক্যালেন্ডার দেখে এক জন বলেছিল, ওঁর একশো বছর হয়ে গিয়েছে। সুতরাং হুসেন নিজে তাঁর লক্ষ্য পূর্ণ হয়েছে বলেই জানতেন।”
কীসের লক্ষ্য? হুসেন বাঁচতে ভালবাসতেন অবশ্যই। বারবার বলতেনও সে কথা। বুড়োমি শব্দটা তাঁর অভিধানে ছিলই না। কিছু দিন আগেও তো ‘ব্যান্ড বাজা বারাতি’ দেখে অনুষ্কা শর্মার ছবি আঁকবেন বলে ঠিক করে ফেলেছিলেন। আন্না হাজারের অনশন? হুসেন তাঁর সমর্থন জানিয়ে কার্টুন এঁকে রেখেছেন। গত বছর অবধিও সদবি বা বনহ্যামের নিলামে নিজে উপস্থিত থাকতেন। রবীন্দ্রনাথের ছবির নিলামেও সশরীরে ছিলেন। বয়সের ভার বা বেদনার আর্তি ওঁর কথাবার্তায় সে ভাবে উঠে আসত না। শুধু দেশছাড়া হয়ে থাকার ব্যাপারটা হুসেন কোনও দিনই মন থেকে মানতে পারেননি। মুখে বলতেন, ‘‘শিল্পীর কোনও ভৌগোলিক সীমানা নেই।” তবু গত বছর কাতারের নাগরিকত্ব গ্রহণ করার পরে অভিমান উগরে দিয়েছিলেন, ‘‘ভারত আমার মাতৃভূমি। আমি কখনও মাতৃভূমিকে ভাল না বেসে থাকতে পারব না। কিন্তু ভারত আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছে।” বন্ধুরা জানতেন, মুম্বইয়ে জাহাঙ্গির আর্ট গ্যালারিতে চা নিয়ে আড্ডাটা হুসেন ‘মিস’ করেন খুব।
এক সময় যাঁরা হুসেনের বিরুদ্ধে গলা ফাটিয়েছিলেন, আজ অবশ্য তাঁরা হুসেনের মৃত্যুতে শোক প্রকাশই করেছেন। শিবসেনা প্রধান বাল ঠাকরে তাঁদের ধ্রুপদী সংস্কৃতি থেকে আমজনতার বলিউড মকবুল ফিদা হুসেনের চিত্রভাবনায় দুয়েরই সমাদর ছিল সমান। জেজে স্কুল অফ আর্টসের ছাত্র জীবন শুরু করেছিলেন সিনেমার বিলবোর্ড এঁকেই। “স্কোয়ার ফুট প্রতি চার-ছ’আনা পাওয়া যেত। তা-ও নিউ থিয়েটার্স ছাড়া আর কেউই নিয়মিত পয়সা দিত না। তার মধ্যেই হাতে কিছু জমলে ল্যান্ডস্কেপ আঁকতে চলে যেতাম সুরাত, বরোদা বা আমদাবাদে”, পরে বলেছিলেন হুসেন। ১৯৫২ সালে মুম্বইয়ে প্রথম একক প্রদর্শনী। ওই বছরই প্রথম একক আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী জুরিখে। ধ্রুপদী ভারতীয় ঘরানার সঙ্গে পিকাসোর কিউবিজমের মিশেল ঘটানো মকবুল তার পর ক্রমশ নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে থেকেছেন। আর তাঁর ছবির মতোই বর্ণাঢ্য হয়ে উঠেছে তাঁর জীবন। পিকাসোরই মতো মকবুল এমন এক শিল্পী, যিনি একই সঙ্গে প্রবল বিতর্কিত এবং তুমুল জনপ্রিয়। মুষ্টিমেয় শিল্পরসিক নয়, পিকাসোর মতোই হুসেনের নাম জানে তামাম জনতা। নিউ ইয়র্ক বা লন্ডনের নিলামে ভারতের সবচেয়ে ‘দামি’ শিল্পী হুসেনকে ফোর্বস পত্রিকা ‘ভারতের পিকাসো’ বলেই চিহ্নিত করেছিল। ১৯৭১ সালে সাও পাওলো বাইনিয়ালে একসঙ্গে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন দুজনেই।
পিকাসোর সঙ্গে মকবুলের মিল আরও আছে। পিকাসোর মতোই জীবনকে চুটিয়ে উপভোগ করে গিয়েছেন মকবুল। একের পর এক সম্পর্কে জড়িয়েছেন। অশীতিপর বয়সেও ৭৩ বার ‘হম আপকে হ্যায় কৌন’ দেখে উচ্ছ্বসিত হয়েছেন। মাধুরীকে নিয়ে ‘গজগামিনী’ বা তব্বুকে নিয়ে ‘মীনাক্ষী’র মতো ছবি করতে নেমেছেন হুসেন পঁচাশি পেরিয়েই তো! অথচ ১৯৬৭ সালেই তাঁর তৈরি চলচ্চিত্র ‘থ্রু দ্য আইজ অফ আ পেন্টার’ বার্লিন উৎসবে সেরা পুরস্কার পেয়ে গিয়েছিল। হুসেন এই রকমই। স্বাধীন ভাবে যখন যা মন চেয়েছে, করে গিয়েছেন।
হুসেন বরাবর চাইতেন, তাঁর ক্যানভাস হোক সহজ। ছবিতে গল্প থাকুক। ছবি যেন মানুষের সঙ্গে কথা কয়ে ওঠে! গত বছর পাকাপাকি ভাবে কাতারের নাগরিক হলেন। বললেন, কাজের সুবিধা আর স্বাধীনতাটাই অগ্রাধিকার এখন। “২০০৬ থেকে আমি তিনটে বিরাট কাজে হাত দেওয়ার কথা ভেবে এসেছি। এক, ভারতের ইতিহাস। দুই, অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাস। তিন, ভারতীয় সিনেমার ইতিহাস।”
গীতা, উপনিষদ এবং পুরাণের এই নিষ্ঠ পাঠক সবেমাত্র ভারতীয় সভ্যতার সিরিজটা শেষ করেছিলেন। বলেছিলেন, এটাই তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টি। অন্য সিরিজ দু’টো আঁকার সুযোগ জীবন আর দিল না ‘ফিদা’কে।
ফিদা মাধুরীর ছবিতে এটাই ছিল হুসেনের স্বাক্ষর। |