একটু ভাবুন
অভাবের সঙ্গে লড়েও সফল গোঘাটের বিপ্লব, উত্তম
এক জনের বাবা খেতমজুরি করেন। অন্য জনের বাবা রিকশা চালান।
দু’জনেরই ছেলে এ বার উচ্চ মাধ্যমিকে আরামবাগ মহকুমায় কৃতীদের মধ্যে স্থান করে নিয়েছেন। কিন্তু সাংসারিক অনটন দুই ছাত্রেরই উচ্চশিক্ষার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পড়াশোনার খরচ নিয়ে চিন্তায় ঘুম উবে গিয়েছে তাদের বাবা-মায়েদের।
আরামবাগ মহকুমার গোঘাটের বালি হাইস্কুলের ওই দুই ছাত্রের নাম বিপ্লব দেবনাথ এবং উত্তম কর্মকার। বিপ্লব উচ্চ মাধ্যমিকে পেয়েছে ৪৫৪, উত্তম ৪৪৭। পঞ্চম শ্রেণি থেকে দু’জনে ওই স্কুলে পড়ছেন। দু’জনের বন্ধুত্বও বেশ গাঢ়। এ বার উচ্চ মাধ্যমিকে সফল হয়ে একই স্বপ্ন দেখছেন দু’জনে। তাঁরা চান, গবেষণা করতে। অধ্যাপনা করতে।
বিপ্লব উত্তম
বিপ্লবের বাড়ি গোঘাটের দিঘরা গ্রামে। তার বাবা দিলীপবাবু খেতমজুরি করেন। কিন্তু বয়সের জন্য নিয়মিত কাজে যেতে পারেন না পঞ্চাশোর্ধ্ব দিলীপবাবু। বিপ্লবের মা বিভাদেবী অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী। মূলত, তাঁর উপার্জনেই সংসার চলে। বিভাদেবীর কথায়, “এত দিন কোনও রকমে চালিয়েছি। কিন্তু এ বার যে কী হবে! ছেলের কলেজের পড়াশোনার খরচ তো অনেক। দু’আড়াই হাজার টাকা মাইনের চাকরি করে তা কী করে সম্ভব হবে বুঝতে পারছি না।” একই বক্তব্য দিলীপবাবুরও।
উচ্চ মাধ্যমিকে বিপ্লব বাংলায় পেয়েছেন ৮৫, ইংরাজিতে ৮২, পদার্থবিদ্যায় ৯৮, রসায়নে ৯০, গণিতে ৯৯ এবং জীবনবিজ্ঞানে ৮৪। আর তার বন্ধু উত্তমের প্রাপ্ত নম্বর বাংলায় ৮১, ইংরাজিতে ৭৫, পদার্থবিজ্ঞানে ৯৮, রসায়নে ৯০, গণিতে ৯৭ এবং জীবনবিজ্ঞানে ৯৬।
উত্তমের বাবা অশোকবাবু রিকশা চালান। প্রতিদিন সকালে বালি গ্রামের বাড়ি থেকে রিকশা নিয়ে চলে আসেন আরামবাগ শহরে। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পরে রাতে ফেরেন। তাঁর কথায়, “সারা দিন রিকশা চালিয়ে ৮০-১০০ টাকা হয়। তিন শতক জমির উপরে আমার ভিটেটুকুই সম্বল। দুই মেয়ের কোনও মতে বিয়ে দিয়েছি। ছেলেকে নিয়ে আমি স্বপ্ন দেখতে সাহস পাই না।”
উচ্চ মাধ্যমিকের প্রস্তুতির সময়ে দুই ছাত্রকেই যাবতীয় সাহায্য করেছেন স্কুলের শিক্ষকেরা। এখন তাঁরা কলেজের ফর্ম-ফিলআপও করছেন ওই স্কুলশিক্ষকদের অর্থ সাহায্যেই। বালি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক কাজলচন্দ্র দে বলেন, “স্কুলের শিক্ষকেরা বিনা পারিশ্রমিকে ওদের পড়িয়েছেন। উচ্চ মাধ্যমিকে ভাল ফল করে ওরা স্কুলকে গর্বিত করেছে। ওদের উচ্চশিক্ষায় যাতে ব্যাঘাত না ঘটে সেটা দেখা জরুরি। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, আমাদের সঙ্গে অনেকেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবেন।” উচ্চ মাধ্যমিকের পরে জয়েন্ট এন্ট্রান্সও দিয়েছে বিপ্লব। তাঁর কথায়, “ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে সুযোগ পেলে মায়ের স্বপ্ন সত্যি করতে পারব। আমার ইচ্ছা রসায়নে অনার্স নিয়ে পড়াশোনা করে গবেষণা করার। অধ্যাপক হতে চাই।” অধ্যাপনার ইচ্ছা উত্তমেরও। তিনিও বলেন, “আমার ভাল লাগে পদার্থবিদ্যা। গবেষণা করব। অধ্যাপক হতে পারলে আর কিছু চাই না।”


বিপ্লব দেবনাথকে সাহায্যের জন্য যোগাযোগ ৭৬৭৯৪৪৯৪৪৫।
উত্তম কর্মকারকে সাহায্যের জন্য যোগাযোগ ৮৩৪৮১৮৫৪৫৬।

পড়ার ফাঁকে ছবিও আঁকেন ইন্দ্রনীল
পাঁচটি বিষয়ে ৪৬৪ নম্বর পেয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় জেলায় তো বটেই রাজ্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ফল করেছেন ডোমজুড়ের সলপ কালীতলার বাসিন্দা ইন্দ্রনীল রায়। তিনি হাওড়ার রামকৃষ্ণ শিক্ষালয়ের ছাত্র ছিলেন। বাংলা, ইংরেজি, রসায়ন, অঙ্ক, এবং পদার্থ বিজ্ঞানে তাঁর প্রাপ্ত নম্বর ৮০, ৯৫, ৯৪, ৯৭ এবং ৯৮। ইন্দ্রনীলের লক্ষ্য, ভবিষ্যতে পদার্থ বিজ্ঞান নিয়ে উচ্চ শিক্ষা এবং গবেষণা করা।
এক চিলতে বাড়িতে বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকেন ইন্দ্রনীল। তাঁর বাবা অরুণবাবু দাশনগরে একটি কারখানার হিসাবরক্ষক। টানাটানির সংসারে তিনি মেধাবী ছেলের লেখাপড়ার জন্য যথাসাধ্য খরচ করেছেন। তবে অরুণবাবু ভোলেন না, তিনি যে প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন তার মালিক শম্ভুনাথ দত্তের অবদানের কথা। অরুণবাবুর কথায়, “শম্ভুবাবু আমার ছেলের পড়াশোনার খাতে অনেকটাই আর্থিক সাহায্য করেছেন।” ইন্দ্রনীল জানায় তার স্কুলের শিক্ষকদের কথাও। বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব প্রায় ৮ কিলোমিটার। ইন্দ্রনীল প্রতিদিন সাইকেলে চেপে এই পথ পাড়ি দিয়ে স্কুলে যাতায়াত করত। সব কষ্ট ঘুচে গিয়েছে উচ্চ মাধ্যমিকে ইন্দ্রনীল ভাল ফল করার পরে। পরিবারে লেগেছে খুশির ছোঁয়া। ইন্দ্রনীলের কথায়, “ভবিষ্যতে আরও পড়াশোনা করতে চাই আমি। পড়ার জগতে ডুবে থাকতে আমার খুব ভাল লাগে।” ভাল ছবিও আঁকেন ইন্দ্রনীল। পড়ার ফাঁকে শখের জন্যও সময় বের করে নেন বলে জানালেন।

আয়লায় ঘর ভেসেও সাফল্য এল পরীক্ষায়

এমনিতেই অভাব-অনটনের সংসার। তার উপর আয়লার তাণ্ডবে ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছিল বাড়ি-ঘর। জোয়ারের জলে ভেসে গিয়েছিল বইপত্রও। কিন্তু তখনও অটুট পাথরপ্রতিমার দেবনগর মোক্ষদা দিন্দা হাইস্কুলের ছাত্র তন্ময় মাইতির পড়াশোনার আগ্রহ। যার জোরেই পাথরপ্রতিমার লক্ষ্মীজনার্দনপুর পঞ্চায়েতের পূর্ব চিন্তামনিপুর গ্রামের বাসিন্দা তন্ময় এ বার উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছেন ৪৩৯ নম্বর পেয়ে।
সাফল্যের পিছনে স্কুলশিক্ষক এবং সহপাঠীদের সহযোগিতার কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে উল্লেখ করেন তন্ময়। বলেন, এঁদের সাহায্য ছাড়া কখনই এই ফল সম্ভব ছিল না। তাই গৃহশিক্ষকের সাহায্য নিতে হয়নি তন্ময়কে। তাঁর বাবা তপনবাবুর কোনও স্থায়ী কাজ নেই। কখনও আলুর গোডাউনে কাজ করেন তো কখনও সংসার চালান দিনমজুরি করে। ছেলের ফলাফলে খুশি হলেও উচ্চশিক্ষার কথা ভাবতে গিয়ে স্বভাবতই উদ্বিগ্ন বাবার মন। তন্ময়ের মা মাধবীদেবী বলেন, “অভাবের সংসারে ছেলেকে পড়াবো, সেই টাকা কোথায়? তবু হাল ছাড়ব না।” স্কুলের প্রধানশিক্ষক উৎপল দাসের কথায়, “অতি দুঃস্থ পরিবারের এই মেধাবী ছাত্রটিকে বিনা পয়সায় ছাত্র আবাসে থাকা-খাওয়া এবং স্কুলে ভর্তি-সংক্রান্ত ব্যাপারে সাহায্য করা হয়েছে। ও আমাদের স্কুলের সুনাম বাড়িয়ে তারই প্রতিদান দিল।” সারা দিনে ১০-১১ ঘণ্টা পড়াশোনা করেছেন তন্ময়। সংসারের আর্থিক পরিস্থিতি এখনও স্বপ্ন দেখার সাহসটুকু নষ্ট করতে পারেনি সুন্দরবনের প্রত্যন্ত গ্রামের ছেলেটির। ইঞ্জিনিয়ার হতে চান, জানালেন তন্ময়।

নিজস্ব চিত্র
Previous Story South First Page



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.