|
|
|
|
বাম সরকারের হিসেব ‘অসত্য’ |
যোজনা নিয়ে মমতা-মন্টেক বৈঠক স্থগিত |
প্রেমাংশু চৌধুরী ²নয়াদিল্লি |
রাজ্যের যোজনা আয়তন ঠিক করার সময়সীমা দরজায় কড়া নাড়ছে। কিন্তু যোজনা কমিশনের কাছে পেশ করার জন্য নথি তৈরি করতে গিয়ে অথৈ জলে পড়েছেন রাজ্য সরকারের অর্থ দফতর ও উন্নয়ন-পরিকল্পনা দফতরের দুই মন্ত্রী এবং আমলারা। কারণ, তাঁদের অভিযোগ, এত বছর ধরে পুরোপুরি অসত্য হিসেবনিকেশের উপর দাঁড়িয়ে রাজ্যের যোজনা আয়তন ঠিক হয়ে এসেছে।
চলতি আর্থিক বছরের যোজনা আয়তন ঠিক করতে আগামী ১৩ জুন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারপার্সন মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়ার বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরিস্থিতি দেখে মমতা প্রশ্ন তুলেছেন, তা হলে এখনই আর আলোচনা করে কী হবে! তাই সেই বৈঠক বাতিল করা হয়েছে। তার বদলে মমতার নির্দেশে দিল্লি এসে যোজনা কমিশনের আধিকারিকদের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র এবং উন্নয়ন-পরিকল্পনা দফতরের মন্ত্রী মণীশ গুপ্ত। আগামী সোমবার বা মঙ্গলবার সেই বৈঠক হতে পারে। সেখানেই রাজ্যের যোজনা আয়তন নিয়ে প্রাথমিক আলোচনা হবে।
রাজ্য সরকারি সূত্রের বক্তব্য, বামফ্রন্ট জমানায় পরিসংখ্যান নিয়ে কারসাজি করে যে ভাবে রাজ্যের আর্থিক অবস্থার ‘অসত্য’ চিত্র তুলে ধরা হত, বর্তমান সরকার সেই পথে হাঁটতে চাইছে না। মুখ্যমন্ত্রী যোজনা কমিশনের সামনে রাজ্যের সঠিক আয়-ব্যয়ের হিসেবটাই তুলে ধরতে চাইছেন। বর্তমান কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় যখন যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারপার্সন ছিলেন, তখন থেকেই তিনি বামফ্রন্ট সরকারকে বারবার বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে, স্বল্প সঞ্চয় থেকে পাওয়া টাকাকে রাজ্যের আয় হিসেবে দেখানো উচিত হবে না। ওটা আসলে ঋণ। কিন্তু সেই যুক্তি রাজ্য সরকার কখনওই মানেনি। পাশাপাশি, কেন্দ্রীয় সাহায্যকেও রাজ্যের আয় হিসেবে দেখিয়ে বছরের পর বছর যোজনার আয়তন বাড়িয়ে নিত তারা। আর বছর শেষে অভিযোগ করা হত, কেন্দ্রীয় সাহায্য না-পাওয়ায় পরিকল্পনা খাতে খরচ করা যায়নি।
কেন্দ্রীয় সরকার এবং তৃণমূলের তোলা এই সব অভিযোগ অবশ্য বরাবরই খারিজ করেছেন রাজ্যের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত। তাঁর বক্তব্য, এই অভিযোগ সর্বৈব মিথ্যা। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবেই এই সব কথা বলা হচ্ছে। এর আগে যোজনা কমিশনকে দেওয়া রাজ্যের হিসেবে কোনও গরমিল বা কারচুপি নেই। অসীমবাবুর এই বক্তব্য আবার নস্যাৎ করেছেন রাজ্যের বর্তমান অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র।
এ বছরের যোজনা নথি করতে অর্থসচিব সি এম বাচাওয়াত এবং উন্নয়ন-পরিকল্পনা সচিব জয়া দাশগুপ্তের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন অমিতবাবু ও মণীশবাবু। তখন দেখা যায়, গত বছর যে যোজনা বরাদ্দ হয়েছিল, তার কত অর্থ কোন খাতে খরচ হয়েছে, এর ঠিকমতো হিসেব নেই। বহু প্রকল্পে রাজ্য সরকার কেন্দ্রীয় বরাদ্দের সমপরিমাণ অর্থ দিতে না-পারায় সেই টাকা খরচ করা যায়নি। গত আর্থিক বছরে রাজ্যের যোজনা আয়তনের পরিমাণ ছিল ১৭ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। তার আগের বছরের তুলনায় ২৮ শতাংশ বেশি। এই টাকার মধ্যে ৪০৭০ কোটি ছিল কেন্দ্রীয় সাহায্য। অর্থাৎ মোট যোজনা আয়তনের ২৩ শতাংশই ছিল কেন্দ্রীয় সাহায্য। গত বছর যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারপার্সন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, পরিকাঠামো ক্ষেত্রে আরও বিনিয়োগ বাড়াতে। কারণ উন্নয়ন ও পরিকাঠামোয় ব্যয় না হলে বিনিয়োগ আসা সম্ভব নয়। কিন্তু রাজ্যের মোট যোজনা আয়তনের ৯৩ শতাংশই পরিকল্পনা বহির্ভূত খাতে ব্যয় হয়। উন্নয়নের কাজ হয় বাকি সামান্য টাকায়। বাজেট ঘাটতি ও রাজস্ব ঘাটতি কমিয়ে আনতে কেন্দ্রের তরফে বারবার ‘ফিসক্যাল রেসপন্সিবিলিটি অ্যান্ড বাজেট ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট’ চালু করতে বলা হত। একেবারে শেষ পর্যায়ে গিয়ে সেই কাজ করেছিল বামফ্রন্ট সরকার।
নতুন সরকারের তরফে বলা হচ্ছে, একশো দিনের কাজ, গ্রামীণ স্বাস্থ্য, সর্বশিক্ষা অভিযান, ভারত-নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় গ্রামীণ বিদ্যুদয়ন, সড়ক, পানীয় জল, আবাসন সংক্রান্ত বেশ কিছু কেন্দ্রীয় প্রকল্পে বড় অঙ্কের অর্থ বাম আমলে খরচ না হওয়ায় দিল্লি ফিরে গিয়েছে। পুলিশের আধুনিকীকরণের জন্য যে টাকা কেন্দ্র বরাদ্দ করেছিল, রাজ্য তার সমপরিমাণ অর্থ দিতে না-পারায় সেই টাকা খরচ করা যায়নি।
রাজ্যের আর্থিক অবস্থার এই বেহাল দশা কাটাতে গত শনিবার দিল্লি এসে কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের আমলাদের সঙ্গে বৈঠক করে গিয়েছেন রাজ্যের অর্থসচিব। পশ্চিমবঙ্গকে বিশেষ আর্থিক প্যাকেজ দেওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে ওই বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। বিশেষ প্যাকেজ একান্তই দেওয়া না-গেলে ঘুরপথে কী ভাবে বড় মাপের আর্থিক সাহায্য দেওয়া যায়, তা-ও খতিয়ে দেখছে প্রধানমন্ত্রীর দফতর ও অর্থ মন্ত্রক।
কেন্দ্র যখন এই সাহায্যের মনোভাব দেখাচ্ছে, তখন হিসেবের কারিকুরির পথে না-হেঁটে রাজ্যের আর্থিক অবস্থার প্রকৃত ছবিটা যোজনা কমিশনের সামনে তুলে ধরাই উচিত কাজ বলে মনে করছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। |
|
|
 |
|
|