|
|
|
|
রামদেবকে ঘিরে দল-সরকার দ্বন্দ্ব তুঙ্গে |
তোষামোদ ভুল হয়েছিল, মত কংগ্রেসেই |
জয়ন্ত ঘোষাল ² নয়াদিল্লি |
বুধবার। ১ জুন। বাবা রামদেব তাঁর নিজস্ব বিমানে চেপে যখন দিল্লি বিমানবন্দরে পৌঁছলেন, তখন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের নির্দেশে চার-চার জন শীর্ষ মন্ত্রী তাঁকে স্বাগত জানাতে সেখানে হাজির। উদ্দেশ্য, যোগগুরুর অহংকে তুষ্ট করে তাঁর অনশনের হুমকি প্রত্যাহার করানো।
৪ জুন রাতে এই ছবিটাই ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেল! অনশন প্রত্যাহার করবেন না, রামদেবের এই হুমকির পরে ইউপিএ সরকারের নির্দেশে দিল্লির পুলিশ তাঁকে রামলীলা ময়দান থেকে তুলে বিমানে চড়িয়ে হরিদ্বারে পাঠিয়ে দিল!
কী এমন হল যে কংগ্রেস সরকার রাতারাতি কৌশলটাই বদলে ফেলল? গ্রেফতারই যদি করতে হত, তা হলে দিল্লির পাঁচতারা হোটেলে সে দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার দরকার ছিল কি? রাজধানীতে প্রশ্ন উঠেছে, কংগ্রেসের এই অবস্থানগত পরিবর্তনের পিছনে সনিয়া গাঁধী এবং রাহুল গাঁধীই কি সব চেয়ে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন? তাই কি দিগ্বিজয় সিংহ থেকে জর্নাদন দ্বিবেদী, এমনকী অনিল শাস্ত্রীও মনমোহনের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়েছিলেন?
এই পরিস্থিতিতে সব থেকে অস্বস্তিতে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়। ১ জুন বিমানবন্দরে রামদেবকে বোঝাতে তিনি কেন গিয়েছিলেন, তা নিয়ে এখনও নানা মহলে চলছে জোর আলোচনা। কংগ্রেসের এক শীর্ষ নেতার কথায়, “প্রণববাবু সব সময় যা কিছু বলেন, যা কিছু করেন, তা ঠান্ডা মাথায় সচেতন ও পরিকল্পিত ভাবেই করেন। এ ভাবে হুট করে বিমানবন্দরে চলে যাওয়া প্রণববাবুর রাজনীতির অঙ্গ নয়।” ওই নেতা আরও বলেন, “ইন্দিরা গাঁধী, রাজীব গাঁধী বা মহাত্মা গাঁধীর জন্ম-মৃত্যু দিনে রাজঘাট বা শক্তিস্থলে অন্য নেতাদের মতো সাতসকালে গাঁধী টুপি পরে সনিয়া গাঁধীর পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার জন্য প্রণববাবু কোনও দিন যান না। ঘনিষ্ঠ মহলে প্রণববাবু বলেন, ‘আমার শ্রদ্ধা আমার কাছে। অনুগত সাজার জন্য ওই তোষামোদের প্রতিযোগিতায় আমি যেতে পারি না’।”
তোষামোদের রাজনীতি যাঁর একেবারেই না-পসন্দ, সেই প্রণববাবু রামদেবকে ‘তুষ্ট’ করতে বিমানবন্দরে যাওয়ায় বিস্মিত খোদ সনিয়া গাঁধী। প্রধানমন্ত্রীর সামনেই সনিয়া প্রণববাবুকে বলেন, ‘আপনি রামদেবকে স্বাগত জানাতে বিমানবন্দরে যাবেন, এটা আমি ভাবতেই পারিনি। কপিল সিব্বল, পবন বনসল বা সুবোধকান্ত সহায় যাওয়ার তা-ও মানে রয়েছে। কিন্তু আপনি কেন যাবেন’? প্রণববাবুর বক্তব্য ছিল, ‘আমি কী করতে পারি! প্রধানমন্ত্রীই আমাকে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন’। আসলে রামদেব-পর্বের গোড়া থেকেই যোগগুরুর সঙ্গে প্রধান মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করছিলেন সুবোধকান্ত সহায়। তিনি ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর দূত হয়ে কাজ করছিলেন কপিল সিব্বলও। এই কারণে রামদেব-পর্ব জটিল হয়ে উঠতে পারে আঁচ পেয়েই সুবোধকান্তকে তড়িঘড়ি বিদেশ থেকে ডেকে আনা হয়। একই কারণে কপিলকে লন্ডন যেতে দেওয়া হয়নি। এঁরা নিশ্চিত ছিলেন যে, রামদেব মোটেই আন্না হাজারে নন। আন্নার সঙ্গে বিজেপির যে ভাবে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রয়েছে, রামদেবের তা নেই। রামদেবকে বিজেপি দলে টানার চেষ্টা করলেও তিনি পুরোপুরি সে দিকে হেলে যাননি। তা ছাড়া, রামদেব যে কালো টাকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, তা আয়কর দফতরের অধীন। তাই প্রণববাবু গোটা বিষয়টি রামদেবকে বোঝাতে পারবেন। আরও একটি অঙ্ক সরকারের ছিল। তা হল, রামদেবকে বাগে এনে তাঁর সঙ্গে আন্নার দূরত্ব তৈরি করা। সে ক্ষেত্রে আন্নাকে অপ্রাসঙ্গিক করে দেওয়া যাবে। এই পরিস্থিতিতে প্রণববাবু-সহ মন্ত্রিসভার আরও ক’জন মন্ত্রী ও ক্যাবিনেট সচিব যদি বিমানবন্দরে যান, তা হলে রামদেবের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করে ফেলা যাবে। সে কারণেই প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত নেন, বিমানবন্দরেই তাঁর সঙ্গে কথা বলতে যাবেন মন্ত্রীরা। প্রণববাবু সে দিন যেতে মোটেই আগ্রহী ছিলেন না। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই তাঁকে যেতে হয়।
কিন্তু যখন দেখা গেল, বিমানবন্দর-পর্বের পরেও রামদেবের তর্জন-গর্জন থামল না, তখন যথেষ্ট অসন্তুষ্ট হন রাহুল গাঁধী। কংগ্রেস সূত্র বলছে, শাহরুখ খান যে ভাবে রামদেবের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন, তার পিছনেও রাহুলের ভূমিকা রয়েছে। এ ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা নেন রাজীব শুক্ল। একই সময়ে দিগ্বিজয় সিংহ ও জর্নাদন দ্বিবেদী প্রকাশ্যে মনমোহন-সরকারের সমালোচনা শুরু করেন।
সরকার ও দলের এই টানাপোড়নের ফলে কপিল-সুবোধকান্তদের কাজটা আরও কঠিন হয়ে যায়। ৩ জুন নাগাদ এই দুই মন্ত্রী রামদেবের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। আগেই ঠিক ছিল, সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে রামদেব বৈঠকে বসবেন। শেষ পর্যন্ত সরকার রামদেবের কিছু শর্ত মেনে নেবে। ঠিক হয়, ৪ জুন অনশন শুরু করলেও সূর্যাস্তের আগেই তা তুলে নেবেন রামদেব। ঠিক হয়, গল্ফ-লিঙ্কে কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের অতিথিশালায় এ নিয়ে বৈঠকটি হবে। সেই মতো কপিল ও সুবোধকান্ত তা জানিয়েও দেন। কিন্তু সরকারের ওই অতিথিশালায় যেতে অস্বীকার করেন রামদেব। জানিয়ে দেন, তিনি আসবেন বড়াখাম্বার একটি অনাথ আশ্রমে। রামদেবের দাবি মানতে রাজি হননি সরকারের প্রতিনিধিরা। এই দর কষাকষি যখন চলছিল, তখন রাজধানীর একটি পাঁচতারা হোটেলে কফি খাচ্ছিলেন কপিল ও সুবোধকান্ত। আচমকাই সমাধান সূত্র হিসেবে কপিলরা প্রস্তাব দেন, ‘তা হলে আপনি এই হোটেলে চলে আসুন’। রাজি হন রামদেব। ওই পাঁচতারা হোটেলেই শেষ পর্যন্ত দু’পক্ষের বৈঠক হয়। এবং সেখানেই রামদেবের তরফে লিখিত ভাবে জানানো হয়, শর্ত মানা হলে তিনি নির্দিষ্ট সময়ের পরে উঠে যাবেন।
এই পর্যন্ত রামদেব ও সরকারের বোঝাপড়ার চিত্রনাট্য ঠিক ছিল। কিন্তু সমস্যা হয় তার পরেই। সময় পার হয়ে যাওয়ার পরেও রামদেব অনশন না তোলায় কংগ্রেস শিবিরে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। এই অবস্থায় কপিল সাংবাদিক বৈঠক করে রামদেবের অনশন প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি দেওয়া চিঠি ফাঁস করে দেন। প্রশ্ন উঠেছে, রামদেবের সঙ্গে যখন আলোচনা চলছে, তখন সাংবাদিক বৈঠক করে এতটা আক্রমণাত্মক হওয়ার কী দরকার ছিল? অনেকেই বলছেন, সিব্বলের এই আক্রমণাত্মক ভূমিকার পিছনে যতটা না মনমোহন, তার চেয়ে বেশি রয়েছে কংগ্রেস। দল মনে করেছে, নরম মাটিতে রামদেব আঁচড়াবেন বেশি। তাই প্রতি-আক্রমণে যাওয়াটাই ঠিক। বিমানবন্দরে গিয়ে তোষামোদ করাটা আসলে ভুল হয়েছে।
কপিলের ওই চিঠি ফাঁসের পরে অনশন প্রত্যাহার তো দূর, রামদেব উল্টে ফোঁস করে ওঠেন। তিনি সিব্বলকে জানিয়ে দেন, রামদেবের পরবর্তী কর্মসূচির থেকেও এখন বেশি অস্পষ্ট, কংগ্রেসের শীর্ষ নেতারা এ বারে কী করবেন! |
|
|
|
|
|