প্রকৃত বন্ধু
মানালি আগে ফরাক্কায় থাকত। কিন্তু ওর বাবা কয়েক মাস হল বদলি হয়ে কলকাতায় চলে এসেছেন। তাই নতুন সেশন শুরুর আগেই মানালি ওর মায়ের সঙ্গে কলকাতায় চলে আসে। একটা নামী স্কুলে ক্লাস সিক্সে ভর্তিও হয়েছে। স্কুলের আন্টিরা বেশ ভাল। রোজ পড়া পারে বলে ওকে সব আন্টি ভালবাসেন। ক্লাসে কয়েক জনের সঙ্গে মানালির ভাল বন্ধুত্বও হয়েছে। ঋচিকা বাদে। ঋচিকা ভীষণ নাক উঁচু ধরনের মেয়ে। ওই ঋচিকার পাশের মানালি বসে।
ওদের ক্লাস-টিচার চৈতালি আন্টি। মানালি এক বার আন্টিকে বলেওছিল যে, ও ঋচিকার পাশে বসবে না। তাতে আন্টি অবাক হয়ে মানালিকে বলেছিলেন, ‘মানালি, ক্লাসের সবাই তোমার বন্ধু। ঋচিকা তো চমৎকার মেয়ে। পড়াশোনাতেও যেমন ভাল, তেমনই সুন্দর গানও জানে। ব্যবহার নিয়েও এখনও পর্যন্ত কোনও কমপ্লেন পাইনি।’
মানালি আন্টিকে বলতে পারেনি, জানেন আন্টি, ঋচিকার খুব জ্বর। আমার পাশে বসে সব সময় শোনায় ওর কত কী আছে। ওর মামা কানাডা থেকে আইপড পাঠিয়েছেন, মাসি দিল্লি থেকে এসে তাজ বেঙ্গলে খাইয়েছেন। ওর বাবা হায়দরাবাদে থাকেন, তাই সানিয়া মির্জার বিয়েতে গিয়েছিলেন। নামীদামি লোকের পাশে দাঁড়িয়ে ফটো তুলেছেন। ওর মা ছুটির দিনে পিৎজা হাটে নিয়ে যান। শপিং মলে ঘোরান এ রকম আরও কত কী টিফিনের সময় বা ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে আমাকে শুনতে হয়। অথচ আমি প্রত্যুত্তরে কিছুই বলতে পারি না। আমার বাবা সাধারণ চাকরি করেন। মামা-মাসি-পিসির সম্বন্ধেও গর্ব করে বলার কিছু নেই। তাই ঋচিকার কথা শুনে আমার নিজেকে কেমন ছোট ছোট মনে হয় আন্টি।
নাঃ, মানালি এর একটা কথাও আন্টিকে বলতে পারেনি। তাই চুপচাপ প্রতিদিন ঋচিকাকে মানালি সহ্য করে যায়।
এখানে এসে ফরাক্কার স্কুলের বন্ধুদের মানালি খুব মিস্ করে। বিশেষ করে শিঞ্জিনি, অংশিকা, যাজ্ঞসেনী, অন্যতমা
আর সুলগ্নাকে। ওদের ছ’জনের মধ্যে দারুণ বন্ধুত্ব ছিল।
ছবি: দেবাশীষ দেব

এক দিন মানালি ওর মাকে ঋচিকার কথা বলেছিল। ওর মা মানালিকে কাছে টেনে নিয়ে বলেছিলেন, ‘জানো তো সোনা, মানুষ মনের কোনও অপূর্ণ চাহিদা বা অভাব থেকে বড় বড় কথা বলে। তা যে সব সময় সত্যি হয়, তা নয়। আবার সত্যি হলেও মনে রাখবে, সবার আর্থিক বা সামাজিক অবস্থাও সমান নয়। এ নিয়ে অযথা মন খারাপ করবে না। ঋচিকা তোমার কাছে যখন এ সব কথা বলবে, তুমি প্রতিবাদ করবে না, কেমন?’
মানালি ওর মায়ের কথায় ঘাড় নেড়েছিল। কিন্তু মুখে বলতে পারেনি, মা, প্রতিদিন ওকে সহ্য করা যে কত কঠিন, তা তো জানো না।
সামনের রবিবার ২ জুলাই মানালির জন্মদিন। মানালির বারো বছর হল। তাই এ বছরের জন্মদিনটা বেশ ধুমধাম করেই হবে। মায়ের মুখে এ কথা জানতে পেরে মানালি খুশিতে ডগমগ।
বর্ষাকাল। তাই বৃষ্টি আর লোডশেডিং-এ যাতে অনুষ্ঠানটা পণ্ড না হয়ে যায়, তাই দুপুরেই সবাইকে নেমন্তন্ন করা হয়েছে। আত্মীয়স্বজন তো আছেই। এ ছাড়া স্কুলের কয়েক জন বন্ধুকেও মানালি নেমন্তন্ন করেছে। বন্ধুরা না থাকলে কি জন্মদিনে মজা হয়? ঋচিকাকে মানালি নেমন্তন্ন করতে চায়নি। কিন্তু ওর মা শুনে বলেছেন, ‘ছিঃ মানালি, মনকে ছোট করবে না। ঋচিকা তোমার পাশেই বসে, তাই ও-ও তো তোমার বন্ধু।’
জন্মদিনের দিন সকাল থেকেই সবাই আসতে লাগলেন। কাকু আর পিসন মিলে বাড়িটা পুরো সাজালেন। মানালি ওর দিদিভাই-দাদাভাইদের সঙ্গে বেলুন ফুলিয়েছে। কাগজ কেটে আঠা লাগিয়েছে।
সবাই চলে আসার পর মানালি প্রথমে কেক কাটল। মামিমা চামচে করে পায়েস খাইয়ে দিলেন। তার পর মা আর কাকিমা বাটি সাজিয়ে মানালিকে খেতে দিলেন। বন্ধুরাও ওর সঙ্গে বসল। ডাইনিং হলটা ফাঁকা করে দেওয়া হয়েছে বলে অনেকটা জায়গাও পাওয়া গিয়েছিল।
এ ভাবে কোনও দিন মানালির জন্মদিন হয়নি বলে মানালির খুব ভাল লাগছিল। পিসিমণিও এত সুন্দর চন্দন পরিয়ে দিয়েছেন যে, মানালি আয়নায় দেখে নিজেকে চিনতেই পারছিল না। উপহারও পেয়েছে অনেক।
বিকেলে মেসোমণি ম্যাজিক দেখালেন দড়ি আর তাস দিয়ে। দাদা-দিদি আর বন্ধুরা মিলে নাচ-গানও হল। ঋচিকা অত ভাল গান জানে। সবাই কত করে বলল, কিন্তু একটা গানও গাইল না। কেমন যেন গুম মেরে রইল
সারাটা দিন।
পরের দিন স্কুলে গিয়ে মানালি দেখল, ঋচিকার মুখটা একই রকম গোমড়া। এমনকী ক্লাসে ভাল করে পড়া বলতে না পারার জন্য বকুনি খেল। পাপিয়া আন্টি তো বাংলা হোম ওয়ার্ক না আনার জন্য ক্লাসের বাইরেই দাঁড় করিয়ে রাখলেন।
ক্লাসের অন্যান্য মেয়েরা অবাক তো হয়েছিলই, তবে সবচাইতে অবাক হয়েছে মানালি নিজে। অন্যান্য দিনের মতো ঋচিকা এক বারও ওর মামা-মাসির কথা বলল না।
ছুটির পর মানালি যখন ঋচিকাকে জিজ্ঞেসা করল, হ্যাঁ রে ঋচিকা, তোর কি শরীর খারাপ? কথাটা শুনেই ঋচিকা ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল। মানালির ব্যাগ গোছানো হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু ঋচিকা হাত ধরে টেনে বসাল। তার পর ভাঙা গলায় বলল, ‘মানালি, তুই কী লাকি রে! তোর কত রিলেটিভস। আমার কেউ নেই রে।’
মানালি অবাক হয়ে বলল, মানে? তুই তো মামা-মাসির কথা বলিস।
ঋচিকা চোখ মুছে বলল, ‘হ্যাঁ ওরাই শুধু আছেন, তাও তো দূরে থাকেন। মা ডিভোর্সি। তাই মায়ের সঙ্গে আমি একা থাকি। ঠাকুমা-দাদু-কাকা কলকাতাতেই থাকেন। কিন্তু ওদের আমি চিনি না। আমি যখন একদম ছোট ছিলাম তখন বাবা কলকাতাতেই থাকতেন। মায়ের সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে যাওয়ার পরে ট্রান্সফার নিয়ে হায়দরাবাদে চলে যান। শুনেছি আবার বিয়ে করেছেন। ফোনে বাবার সঙ্গে কথাবার্তা হয়। আমার বার্থ ডে-তে বাবা কার্ড পাঠান। গিফ্ট পাঠান। কিন্তু আমার জন্মদিনে কেউ আসে না রে। মা পার্ক স্ট্রিটের কোনও হোটেলে নিয়ে গিয়ে খাইয়ে আনেন।
ফ্ল্যাটের বন্ধুদের অবশ্য সঙ্গে নিয়ে যাই। কিন্তু তোর মতো এ ভাবে জন্মদিন সেলিব্রেট কখনও হয়নি রে।’
ঋচিকার কান্না দেখে মানালিরও চোখ ছলছল করে উঠল। মুখে বলল, দুঃখ করিস না ঋচিকা। তোকেও তো মামা-মাসি কত কিছু গিফ্ট দেন, সেটাও বা কম কীসে? আমার মা তো প্রায়ই বলেন, কত জনের কেউই নেই, তাদের জন্মদিনও হয় না। তাদের কথা ভাববি, দেখবি দুঃখ হবে না। এখন ওঠ, বাস চলে যাবে আমার।
ফেরার সময় মানালি বাসের জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে ভাবল, এত দিন ও ঋচিকাকে নাক উঁচু মেয়ে বলেই জেনে এসেছে। কিন্তু ও যে কত নিঃসঙ্গ, তা কোনও দিনই বুঝতে পারেনি। কত দুঃখ, অভিমান চাপা দেওয়ার জন্য যে ও কথাগুলো বলত, তা আজ বুঝতে পারল। এখন থেকে ঠিক করল, নাঃ, ঋচিকার বন্ধু ওকে হতেই হবে। তা হলে কিছুটা হলেও ওর একাকিত্ব দূর হবে। ক্লাসে এক দিন ওদের পাপিয়া আন্টি বলেছিলেন না, প্রকৃত বন্ধু হল সে-ই, যে সুখ-দুঃখ, আনন্দ-অমিভান, ভাল-মন্দ সব অবস্থার মধ্যে পাশে থাকবে।
মানালি কি পারবে না ঋচিকার বন্ধু হতে?

Magazine Rabibasariyo Anandamela



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.