|
|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
হিন্দুত্ববাদীদের বানানো রূপকথা |
পিপ্ল উইদাউট হিস্টরি/ ইন্ডিয়াজ মুসলিম ঘেট্টোজ, জেরেমি সিব্রুক ও ইমরান আহমেদ সিদ্দিকি। নবায়ন, ২৯৫.০০ |
গৌতম রায় |
ভারতে সংখ্যালঘু তোষণের গল্পটা যে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের বানানো রূপকথা-- যা প্রায়শ আম জনতার মনেও প্রতিকূল বিভ্রম সৃষ্টি করে-- তা নানা ক্ষেত্রেই উত্তরোত্তর স্পষ্ট হচ্ছে। বিশেষত সাচার কমিটির রিপোর্টের পর তো সংখ্যালঘুদের পরিকল্পিত বঞ্চনার ইতিবৃত্ত রীতিমত চমকে দেয়। জেরেমি সিব্রুক এবং ইমরান আহমেদ সিদ্দিকি কলকাতার মুসলিম বস্তিগুলোয় ঘুরে বেড়িয়ে গরিব মুসলমানদের যে বঞ্চনা, অসহায়তা ও নিপীড়নের কাহিনী তুলে এনেছেন, তাও কম চমকপ্রদ নয়। সিব্রুক ও সিদ্দিকি অবশ্য তপসিয়া, বেনেপুকুর, তিলজলা ও ট্যাংরার বস্তিগুলোতেই সফর করেছেন। মেটিয়াবুরুজ, খিদিরপুর বা রাজাবাজারের বস্তি তাঁদের ক্ষেত্রসমীক্ষার অন্তর্ভুক্ত হয়নি। শহরতলির অনেক মুসলিম মহল্লাতেও তাঁদের চরণ পড়েনি। তাই তাঁদের বইয়ের নামপত্রে ‘ইন্ডিয়াজ মুসলিম ঘেট্টোজ’ কথাটি যথাযথ নয়, বরং অতিরঞ্জিত। ইন্ডিয়া দূরস্থান, কলকাতার সব মুসলিম বস্তিতেও তাঁরা যেতে পারেননি।
তাতে অবশ্য তাঁদের সমীক্ষা বা পর্যবেক্ষণের গুরুত্ব বিন্দুমাত্র হ্রাস পায় না। কেননা একটা ভাত টিপলেই যেমন বোঝা যায়, হাঁড়ির সব ভাত সিদ্ধ হয়েছে কিনা, তেমনই তিন-চারটি বস্তির কয়েক হাজার মানুষের অবমানব জীবনের বাস্তবতাই অবশিষ্ট বস্তিগুলোর অবস্থা সম্পর্কে সম্যক ধারণা গড়ে দিতে পারে। বিচারপতি রাজেন্দ্র সাচারের রিপোর্টে দেশময় সংখ্যালঘু মুসলিমদের দুরবস্থার যে ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরা হয়, পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী ও সেকুলার শাসকরা তাতে বিষম বিব্রত হয়েছিলেন। রিপোর্টটিকে ‘অর্ধসত্য’, ‘অসত্য’ ইত্যাদি বলেও পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানের দুর্দশার জন্য ইতিহাস, দেশভাগ ইত্যাদি প্রসঙ্গ টেনে নিজেদের সাড়ে তিন দশকের শাসনপ্রণালীর উপেক্ষা ও অবহেলার ঐতিহ্যকে আড়াল করার চেষ্টা করেছিলেন। লেখকরা দেখিয়েছেন, তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ বামফ্রন্ট সরকারও মুসলিমদের প্রতি কী বৈষম্য, অনাদর ও উপেক্ষা লালন করে এসেছে, বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর ১৯৯২-এর ডিসেম্বরে কী ভাবে হিন্দুত্ববাদীদের আক্রমণে ট্যাংরার মুসলিম বস্তি উজাড় হয়ে গিয়েছে এবং বামফ্রন্টের ধর্মনিরপেক্ষ পুলিশ কী নিদারুণ নিষ্ঠুরতায় গরিব মুসলিম কাগজকুড়ানিদের সন্ত্রাসবাদী হিসেবে মাসের পর মাস বিনা বিচারে আটক রেখে অসহ্য অত্যাচার চালিয়েছে। |
|
সন্ত্রাস। ট্যাংরা, ডিসেম্বর ১৯৯২। |
সমাজে যদি সংখ্যালঘুদের সম্পর্কে কাল্পনিক ভ্রান্তি ছড়িয়ে থাকে, সচেতন রাজনীতিকদের, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের উচিত সেই ভ্রান্তি দূর করে সংখ্যালঘুদের প্রতি সেই ভ্রান্তিজনিত অনাস্থা, সন্দেহ ও বিদ্বেষ দূর করা। এ জন্য বামপন্থীরা যথেষ্ট সময় পাননি, এ কথাও বলা যাবে না। সাড়ে তিন দশক যথেষ্ট দীর্ঘ সময়। কিন্তু সে সব তো তাঁরা করেনই নি, উপরন্তু পুলিশকে সংখ্যালঘুদের প্রতি নির্মম হতে, বিস্ফোরণ বা সামাজিক-রাজনৈতিক গোলযোগ হলেই তাঁদের লক-আপে কিংবা বিচারবিভাগীয় হাজতে পুরতে উৎসাহিত করেছেন। ফল হয়েছে এটাই-- পাশাপাশি থেকেও হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস গড়ে ওঠেনি। মাঝরাতে বস্তির ভাঙা দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হলেই মুসলিম গৃহস্থ বুঝে যায়, এ বার ভারী বুটের অধৈর্য লাথি দরজায় আছড়ে পড়বে। তারপর মারতে-মারতে থানায়, সেখানে থার্ড ডিগ্রি। প্রাথমিক চিকিৎসার প্রশ্ন নেই, উকিল নিয়োগের পয়সা পর্যন্ত নেই। অতএব জামিনও নেই, পড়ে-পড়ে হাজতে পচা।
কলকাতার মুসলমান তাই সর্বদা খুব সন্তর্পণে থাকে। এই বুঝি পুলিশ এসে সন্ত্রাসবাদী বলে তুলে নিয়ে গেল। থাকা বলতে অবশ্য আট ফুট বাই ছয় ফুট কিংবা তারও কম জায়গায় ঠেসেঠুসে আট-দশটা মানুষের দিন গুজরান। শোবার জায়গা না হওয়ায় অনেককে বাইরে, খোলা আকাশের নীচে, গলিতে বা রাস্তায়ও শুতে হয়। এই আট-দশ জনের মধ্যে কয়েকটি শিশু থাকে, দু-একজন বুড়োবুড়িও। ৭-৮ বছর বয়স থেকেই ছেলেদের কাজে লেগে পড়তে হয়। প্রধানত জুতো তৈরির কাজ, কখনও জরি বোনার, রাজমিস্ত্রি বা তার জোগাড়ের, প্লাস্টিকের জিনিস তৈরির। আধুনিক প্রযুক্তির অনুপ্রবেশে সাবেক জিনিসের চাহিদার অভাব এবং প্রথাগত বৃত্তি ও পেশাগুলির (যেমন কাঁসারি, পিতলের কারিগর) অবলুপ্তি মহানগরীর গোটা মুসলিম সমাজকে বেরোজগারির অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে। সেখান থেকে মাদক চোরাচালানের অন্ধকার ভুবন খুব দূরবর্তী নয়। আর এ এমন এক পেশা, পুলিশকে নিয়মিত তোলা দেওয়া, জীবনের ঝুঁকির পাশাপাশি যা অপরাধজগতের সঙ্গে নিবিড় পরিচয়ও ঘটিয়ে দেয়। মাদক-পাচারকারী ক্রমে মাদকাসক্তে পরিণত হয়। আর তার পর তাকে দিয়ে অপরাধজগতের যে-কোনও অপকর্মই করিয়ে নেওয়া যায়। শিক্ষার সুযোগবঞ্চিত বেকার মুসলিম যুবক ভাই-বোন, বাবা-মা-র মুখে দুটো অন্ন তুলে দেওয়ার মরিয়া তাড়নায় অপহরণ, মুক্তিপণ দাবি ও আদায়ের মতো সংগঠিত অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।
তবু শতাংশের হিসাবে খুব কম সংখ্যক মুসলমান তরুণই অপরাধজগতে নাম লেখায়। অথচ শহরে যে-কোনও অপরাধ সংঘটিত হলেই পুলিশ তার সঙ্গে প্রমাণহীন ভাবে একতরফা মুসলিমদের নাম জড়িয়ে দেয়। সংবাদপত্রে সে সব নাম ছাপাও হয়ে যায়। অভিযুক্তরা বিনা বিচারে আটক থাকে, তার পর মামলা আদালতে উঠলে কিছু কাল জেল খাটা নিরপরাধও সমাজ ও আইনের চোখে (পুলিশের চোখে তো বটেই) ‘দাগি’ হয়ে ওঠে। সংবাদপত্রে তাদের অভিযুক্ত ও গ্রেফতার হওয়ার সমাচারও নিয়ম করে ছাপা হয়ে যায়। কিন্তু তাদের বেকসুর খালাস হওয়া এবং বিচারপতিদের তরফে পুলিশের সাম্প্রদায়িক মনোভাবকে কড়া ভর্ৎসনা করার খবরটি প্রায় কখনওই ছাপা হয় না। ফলে জনমনেও এই ধারণা ক্রমে বদ্ধমূল হতে থাকে যে, মুসলিম মাত্রেই অপরাধপ্রবণ।
সাচার কমিটির রিপোর্টে মুখে চুনকালি লাগার পর, বিশেষত উপর্যুপরি নির্বাচনে মুসলিম ভোট হাতছাড়া হতে দেখার পর বামপন্থীরা কৌশল নিয়েছিলেন, রাতারাতি সংখ্যালঘু-দরদি সেজে মুসলিমদের আস্থা ফিরে পেতে। এই লক্ষ্যেই সরকারি চাকরিতে মুসলিমদের জন্য অনগ্রসর কোটায় ১০ শতাংশ আসন সংরক্ষণের সিদ্ধান্তও তড়িঘড়ি ঘোষণা করা হয়। তবে প্রচারের ঢক্কানিনাদ যত কোলাহলমুখর হোক, এতে কাজের কাজ কিছু হয়নি। আর মুসলিমরাও বামপন্থী প্রতারণার এই নতুন প্রকরণটি ধরে ফেলেছেন। তাঁরা দেখেছেন, সাড়ে তিন দশকেও মুসলিম মহল্লায় সরকারি উদ্যোগে কোনও স্কুল তৈরি হয়নি, ছাত্রাবাস হয়নি, চিকিৎসাকেন্দ্র হয়নি, গোরস্তানের সংস্কার হয়নি। হোমগার্ড-কনস্টেবলের মতো ন্যূনতম যোগ্যতার সরকারি চাকরিতেও মুসলিমরা ডাক পাননি। কেন তাঁরা বামপন্থীদের প্রত্যাখ্যান করেছেন, সিব্রুক ও সিদ্দিকির বই পড়লেই তা স্পষ্ট হয়ে যায়। |
|
|
|
|
|