|
|
|
|
দূরের স্কুলে নিয়ে যাবে কে, ষষ্ঠী কাঁদে |
অনল আবেদিন ² জিয়াগঞ্জ |
অপুষ্টি আক্রান্ত মা বছর চারেক থেকে মুনিস খাটতে যেতে পারেন না। জন্মান্ধ দাদা বীরেন বাড়ির বোঝা। দারিদ্রের কারণে ১৪ বছরের বোন অপরাজিতা প্রাথমিক স্কুলের গণ্ডি পার হওয়ার পর স্কুলছুট। কনিষ্ঠ ভাই বিশ্বনাথ মিডডে মিলের জরুরি প্রয়োজনে প্রাথমিক স্কুলে যায়। আর সে মাঝেমধ্যে গেরস্থের ডাক পেলে নিরক্ষর বাবা মাণিক সর্দারের সঙ্গে মাঠে মুনিস খাটতে যায়।
ঘর বলতে কাঠা খানেক জমির উপর খড়ের ছাউনি দেওয়া ১০ ফুট বাই ১৩ ফুটের কঞ্চির বেড়া দেওয়া একটি ঝুপড়ি। তাতেই থাকতে হয় স্বামী-স্ত্রী ও সন্তান মিলে ৬টি প্রাণীকে। সেই ঘরে আলো জ্বলে না। বিদ্যুৎ পৌঁছয়নি। কুপির টিম টিমে আলোই সম্বল। তাতে অবশ্য মাণিক সর্দারের দ্বিতীয় ছেলে ষষ্ঠির কিছু যাই আসে না। কারণ, দৃষ্টি ফিরে পাওয়ার প্রত্যাশায় অস্ত্রোপচার করার পর তার ডান দিকের চোখের দৃষ্টি চিরতরে গিয়েছে সেই শৈশবেই। বাঁ চোখে বড় গাছপালা, রাস্তাঘাট, দালানবাড়ি আবছা দেখতে পায়। এ সব কোনওটিই হতদরিদ্র ওই আদিবাসী কিশোরের মাধ্যমিক পাশ করার ক্ষেত্রে বাধা হতে পারেনি। |
|
দৃষ্টি ক্ষীণ। শ্রবণই ষষ্ঠীর ভরসা। ছবি: গৌতম প্রামাণিক। |
বই-এর অক্ষর যে দেখতে পায় না, ব্রেইল পদ্ধতি খায় না মাথায় মাখে সে জানে না, শতকরা ৮০ ভাগ দৃষ্টিশক্তিহীন সেই আদিবাসী কিশোর নিজে লিখতেও পারে না। তবুও সে বাংলায় ১২৬ নম্বর, ভৌত বিজ্ঞানে ৮৯ নম্বর, ভূগোলে ৬১ নম্বর, জীবন বিজ্ঞানে ৫৭ নম্বর, ইতিহাসে ৫৪ নম্বর, ইংরাজিতে ৪৭ নম্বর পেয়ে এ বার মাধ্যমিক পাশ করেছে। জিয়াগঞ্জ থানার মুকুন্দবাগ হাইস্কুলের ছাত্র ষষ্ঠি ওই সাফল্য একটি গল্প বটে।
নজির গড়ার গল্প। অদম্য ওই কিশোরে ‘অন্ধের যষ্ঠি’ তার স্কুলের শিক্ষকরা। স্কুল লাগোয়া জাখিরাবাদ গ্রামের ষষ্ঠি বলে, “জন্ম থেকেই কম দেখি। যত বড় হয়েছি, ততই দৃষ্টিশক্তি কমেছে। ক্লাসে মুখস্থ পড়া বলে শিক্ষকদের প্রিয় হয়ে গেলাম। তখন স্কুলে যেতেও ভাল লাগতে শুরু করল।” এই ভাবে প্রাথমিক বিদ্যালয় পার হয়ে মুকুন্দবাগ হাইস্কুলে সে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হয়।
হাইস্কুলের শিক্ষক জহরুল হক বলেন, “অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর স্মরণ শক্তি দেখে আমরা শিক্ষকরা ওর প্রতি একটু বেশিই স্নেহপ্রবন হয়ে পড়ি। তাকে বই, খাতা, পেন দেওয়া হয়। সে কোনও দিন স্কুল কামাই করেনি। প্রতি দিন সে প্রথম বেঞ্চে বসে শিক্ষকদের বলে দেওয়া পড়া সে মুখস্থ করে শুনিয়েছি। ভুল হলে ফের শিক্ষকদের কাছে থেকে পড়া শুনে মুখস্থ করেছে। স্কুলের বিভিন্ন পরীক্ষায় শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মীরা তার ‘সহায়ক’ (হেলপার) হয়েছে। প্রশ্নের উত্তর বলেছে ষষ্ঠি। লিখেছেন হেলপার। মাধ্যমিক পরীক্ষায় নবম শ্রেণির এক ছাত্রকে হেলপার করা হয়।” তার এত লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাসে এবার বোধ হয় ছেদ পড়তে চলেছে। বিষন্ন ষষ্ঠি বলেন, “এত দিন বাড়ির কাছে স্কুল হওয়ায় কোনও মতে লেখাপড়া করতে পেরেছি। এ বার তো আজিমগঞ্জের স্কুল ৪ কিলেমিটার দূরে। কে আমাকে নিয়ে যাবে? ঘরভাড়া করে থাকার ক্ষমতা নেই। নেই বই কেনার টাকাও!”
প্রায় একই রকম দশা ষষ্ঠির সহপাঠিনী জ্যোৎস্না খাতুনের। নবগ্রাম থানার বিনোদপুর গ্রামের দিনমজুুর আব্দুল সামাদের নিরক্ষর দুই ছেলে দিনমজুরি করলেও পোলিও আক্রান্ত হয়ে দুই পা পঙ্গু হয়ে যাওয়া মেয়ে জ্যোৎস্না কিন্তু লেখাপড়ার জন্য জেদ ধরে। মুকুন্দবাগ হাইস্কুলের প্রধানশিক্ষক বাসুদেব সরকার বলেন, “শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণে ওই ছাত্রী হাঁটতে পারে না। ফলে তার দিকে তাকিয়ে যে বার যে ক্লাসে পড়ছে সে বার সেই ক্লাস দোতলার বদলে একতলায় করা হয়েছে। সে এ বার মাধ্যমিকে শতকরা ৪০ শতাংশ নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে।’’ কিন্তু জ্যোৎস্নার আফশোষ, “এ বার উচ্চমাধ্যমিক যেতে হবে ৩ কিলোমিটার দূরের স্কুলে। হুইলচেয়ারে অতটা পথ কি ভাবে পার হব?” |
|
|
|
|
|