রসনার কৈলাশ
বিবাহিত জীবনের অনেকটাই আমার কেটেছে দার্জিলিঙে। ভাগ্য এতটাই সুপ্রসন্ন ছিল যে সেখানে পেয়েছিলাম আমার মাসিশাশুড়ি ঝর্না বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো মানুষকে। তাঁর কাছে শেখা নানা খাবার, সে জলখাবার হোক বা কোনও ভাত বা রুটির পাতের পদ হোক আজ সেগুলি জানাতে খুব ভাল লাগছে।
শ্বশুরবাড়ির রীতি মেনে রুপোর বাসনে খাওয়াদাওয়ার পর্ব তখনও মেটেনি। ঠাকুর-বামুনমায়ের রান্না নানা পদ শাশুড়িমায়েরা দু’বেলা সাজিয়ে খাওয়াতেন। বিয়ের পরেই রাজবাড়ির জমজমাট সংসার ছেড়ে চলে যেতে মন না চাইলেও স্বামীর চাকরির জন্য আমাকে দার্জিলিঙে চলে যেতে হয়। প্রথমে ভেবেছিলাম সারা দিন একা থাকতে হবে। কিন্তু থাকতে হয়নি। পেয়ে গেলাম মাসিশাশুড়ির মতো এক বন্ধুকে। তখন কোনও খাবারই তৈরি করতে পারতাম না। উনি আমাকে পরম যত্নে নানা খাবার শিখিয়েছিলেন।
স্বামী চা-বাগানে কাজ করতেন। তাই বাড়িতে নানা স্তরের মানুষের আনাগোনা ছিল। বাড়ির মধ্যে ছিল ফল ও ফুলের বাগান। তাই বাগানের এঁচোড় দিয়ে মাসিশাশুড়ি নানা পদ শিখিয়েছিলেন। তারই একটি এঁচোড়ের কাটলেট। মাঝের শিরা কাটা এঁচোড়ের বড় টুকরো ও খোসা ছাড়ানো আলু সেদ্ধ করতে হবে। বেশি সেদ্ধ হবে না। একটি পাত্রে সেদ্ধ করা আলু ও এঁচোড় ভাল করে চটকাতে হবে। পরে একটি পাত্রে সেদ্ধ করা আলু ও এঁচোড়ের সঙ্গে পেঁয়াজবাটা, আদাবাটা, রসুনবাটা, নুন, চিনি ও লঙ্কাগুঁড়ো মিশিয়ে ভাল করে পেস্ট করতে হবে। কড়াইতে তেলে পেঁয়াজকুচি দিয়ে ভাজতে হবে বাদামি রং আসা পর্যন্ত। মশলা দেওয়া সব মিশ্রণটা কড়াইতে ভাল করে কষে নামানোর আগে কাঁচা লঙ্কাকুচি, ধনেপাতাকুচি, গরমমশলা ও জিরেগুঁড়ো দিয়ে নামাতে হবে। ঠান্ডা হলে চ্যাপ্টা বা চৌকো আকার গড়ে ময়দা বা বেসনের গোলায় ডুবিয়ে বিস্কুটের গুঁড়ো মাখিয়ে তেলে ভাজতে হবে। সাদা ও সরষের তেল মিশিয়ে নিতে হবে।
রান্নার লোক থাকলেও সখে-আহ্লাদে বা আত্মীয়স্বজন এলে রান্নায় নামতেন বাড়ির বৌ-শাশুড়িরা। আমি এই বাড়িতে বৌ হয়ে আসি উনিশ বছর বয়সে। এসে পেয়েছি দুই শাশুড়িমা, শ্বশুর, ননদ, দেওর-সহ নানা আত্মীয়কে। আমার শাশুড়িমা উমারানি দেবীর প্রিয় পদটি জানাই। নাম কলি-চিংড়ি। পেঁয়াজকলি ও আলু ছোট ছোট করে কেটে আলাদা করে ভাজতে হবে। মাঝারি মাপের চিংড়ি হাল্কা করে ভাজতে হবে। তেলে পেঁয়াজকুচনো, রসুনকুচনো, লঙ্কা, আদাবাটা, টোম্যাটো, নুন, মিষ্টি, জিরে ও মরিচবাটা দিয়ে পেঁয়াজকলি কষতে হবে। ভাল করে নাড়াচাড়া করে চিংড়ি মাছ দিয়ে কষে একবারে শুকনো শুকনো করে নামাতে হবে। নামিয়ে সরষের তেল ছড়িয়ে দিতে হবে।
আমার বিয়ের পরে জায়ের সংখ্যা বেড়েছে। বাড়িতে পদের স্বাদ বদলও হয়েছে। জায়ের কাছ থেকে শেখা ঝিঙে-পাতুরির রন্ধনপ্রণালীটি জানাই। কচি ঝিঙে বড় বড় টুকরো করতে হবে। এর সঙ্গে নারকেলকুরো, সরষে বাটা, নুন, মিষ্টি, সামান্য হলুদ ও কাঁচা লঙ্কা মাখিয়ে কড়াইতে দিয়ে ঢিমে আঁচে রাঁধতে হবে। ঢাকা দিয়ে রাঁধতে হবে। কড়ার তলা ধরে গেলে সামান্য জলের ছিটে দিয়ে নেড়েচেড়ে ঢাকা দিতে হবে। সরষের তেল ছড়িয়ে নামাতে হবে।
আমার বাপের বাড়ি হুগলির চুঁচুড়ায়। চুঁচুড়া বালিকা শিক্ষামন্দির থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে হুগলির উইমেন্স কলেজে পড়াকালীন আমার বিয়ে হয়। পরে অবশ্য সেই পড়াশোনা শেষ করি। আমার বাবা বরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের খুব প্রিয় ছিল ভেটকি মাছের ঘণ্ট। বাবা ছিলেন খাদ্যরসিক। খাবার নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করা ছিল তাঁর প্রিয়। খুব ছোটবেলার একটা ঘটনার কথা বলি। এক দিন সকাল থেকে শুনছি ইলিশ মাছের রোস্ট হবে। বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে দেখি একটা আস্ত ইলিশের রোস্ট প্লেটের উপরে। অন্য ভাইবোনেরা ততক্ষণে টুকরো টুকরো করে টেস্ট করে ফেলেছে। মা কী ভাবে সে দিন ইলিশের রোস্ট করেছিলেন বলি। একটি গোটা ইলিশ মাছের আঁশ ভাল করে ছাড়িয়ে পরিষ্কার করে ভিনিগারে ডুবিয়ে রাখতে হবে। পরে তাতে নুন, লঙ্কা, তেল ও ঘি মাখিয়ে বড় প্যানে বা এখন মাইক্রোআভেনে রোস্ট করতে হবে।
মায়ের নাম তৃপ্তি মুখোপাধ্যায়। নামের সঙ্গে মানানসই ছিল তাঁর রান্না। তাঁর হাতের একটি পদ মানপাতায় ইলিশ। সরষেবাটা, সরষের তেল, নুন ও চেরা কাঁচা লঙ্কা ইলিশ মাছের বড় দাগায় মাখিয়ে অমর্তমানের পাতার মধ্যে রেখে ভাল করে মুড়ে পরিষ্কার সাদা কাপড়ের টুকরোর মধ্যে রেখে সুতো দিয়ে বাঁধতে হবে। ভাত ফুটলে তাতে মোড়াটা ফেলে দিতে হবে। ফ্যান গালা হলে মোড়া খুলে তাতে আরও একটু সরষের তেল ছড়াতে হবে। খাবার সময় অমর্তমানের পাতাসমেত গরম ভাতে খেতে হবে (তবে এখন অমর্তমানের পাতা না পাওয়া গেলে লাউপাতায় রেখেও খাওয়া চলে)।
আমার শ্বশুরবাড়ি ভূকৈলাশ রাজবাড়ি। জয়নারায়ণ ঘোষালের আমল থেকে সংসারের বাড়বাড়ন্ত। দু’শো বিঘে জায়গার মধ্যে নানা দেবদেবীর অধিষ্ঠান। বিশাল চত্বরে আছে শিবের মন্দির, পতিতপাবনী (দুর্গা), শালগ্রাম শিলা। এ বাড়ির শিবগঙ্গার ধারে দু’টি বড় ও ছোট ছ’টি শিবের মন্দির আছে। এক বার রামপ্রসাদ এসে সব দেখে একটি শিবের মন্দিরের শিবলিঙ্গের নামকরণ করেছিলেন ‘ভূকৈলাশ’। বাড়ির নানা অনুষ্ঠানে বিশেষ করে পুজোর সময় এসেছেন তুষারকান্তি ঘোষ, সজনীকান্ত দাস, মহানন্দ ব্রহ্মচারী-সহ বহু গুণীজন। বাড়ির চত্বরে আছে শীতলাদেবীর মন্দির। এই পুজোয় বাড়ির বৌদের অংশগ্রহণ করা নিষেধ ছিল। চৈত্র সংক্রান্তির আগে এই পুজোয় যে পাঁঠা বলি হয়ে আসছে সেই প্রসাদ আজও আসে রাজবাড়িতে। সেই পদটির রন্ধনপ্রণালী বলি।
মাংস ভাল করে ধুয়ে টক দই মাখাতে হবে। আলু আগে ভেজে রাখতে হবে। তেলে গোটা গরমমশলা ফোড়ন দিয়ে আদাবাটা, টোম্যাটো দিয়ে কষে মাংস ও ভাজা আলু দিয়ে ভাল করে কষতে হবে। গরম জল দিয়ে চাপা দিতে হবে। সেদ্ধ হলে এবং গা-মাখা হলে ঘি দিয়ে নামাতে হবে। পুজোর সঙ্গে বিশেষ পদ্ধতিতে ২৩০ বছর ধরে এই পদটি হয়ে আসছে এই রাজবাড়িতে।
ছবি: শুভেন্দু চাকী
পদগুলি তৈরি করেছে ‘ওহ্! ক্যালকাটা’
Previous Story

Kolkata

Next Story

 



অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.