প্রকাশ্যে নিধন
এত রক্ত কেন

কেই বলে আইনকে বুড়ো আঙুল দেখানো!
দোকানে ঝুলছে চামড়া ছাড়ানো ছাগল বা খাসি। কাটা মাথাগুলো আলাদা করে সিমেন্টের বেদির উপর রাখা। কিন্তু কোনও আড়াল নেই। নেই পুর আইন অনুযায়ী কাচের দেওয়াল দিয়ে জায়গাটি ঘিরে রাখার কোনও ব্যবস্থাও। প্রকাশ্যেই চলছে মুরগি কাটা। দক্ষিণ থেকে উত্তর, কলকাতা পুরসভার নিয়ন্ত্রণাধীন বিভিন্ন পুর বাজার থেকে শুরু করে ফুটপাথের বাজার সব জায়গাতেই নিয়ম ভেঙে চলছে ব্যবসা। পুরসভার পক্ষ থেকে মাংসের দোকানগুলিতে অভিযান চালানোর প্রক্রিয়াও কার্যত বন্ধ।

১৯৯৭ সালের ১২ আগস্ট বিজ্ঞপ্তি জারি করে কলকাতা পুরসভা জানায়, পুর এলাকায় কোনও ভাবে প্রকাশ্যে, বিশেষ করে ফুটপাথে, রাস্তার ধারে কিংবা বাজারে সকলের সামনে কোনও জীবকেই হত্যা করা যাবে না। শুধু তাই নয়। এর আগে ১৯৮০ সালে কলকাতা পুরসভার আইনে বলা হয়, যে দোকানগুলিতে শুধুমাত্র মাংস বিক্রি হয় সেখানে মাংস ঝুলিয়ে রাখতে গেলেও তা ঢাকা অবস্থায় ঘসা বা কালো কাচের আড়ালে রাখতে হবে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে পুর আইন ও একই সঙ্গে ‘প্রিভেনশন অফ ক্রুয়েলটি টু অ্যানিম্যাল অ্যাক্ট ১৯৬০’ এবং প্রিভেনশন অফ ক্রুয়েলটি টু অ্যানিম্যাল (স্লটার হাউস) রুলস ২০০১’ কোনও ভাবেই মানা হচ্ছে না বলে জানান কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী বিভাস চট্টোপাধ্যায়। বিভাসবাবু দীর্ঘ দিন ধরেই পরিবেশ বিষয়ক নানা মামলা লড়ছেন। তিনি বলেন, ‘‘প্রিভেনশন অফ ক্রুয়েলটি টু অ্যানিম্যাল অ্যাক্ট ১৯৬০’ এবং ‘প্রিভেনশন অফ ক্রুয়েলটি টু অ্যানিম্যাল অ্যাক্ট (স্লটার হাউস) ২০০১’-এর আইন অনুযায়ী জীবহত্যার ক্ষেত্রে বেশ কিছু সীমাবদ্ধতার কথা বলা হয়েছে। এই আইনে স্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া আছে, রাস্তার ধারের মাংসের দোকান, বস্তি এলাকা, ধাবার সামনে কিংবা বাড়িতে পাঁঠা, মুরগির মতো নির্দিষ্ট কিছু জীবহত্যা করলে তা দণ্ডনীয় অপরাধ।

পুরসভার অন্তর্গত বিভিন্ন ওয়ার্ডের পুর বাজার থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন বাজার কিংবা ফুটপাথের বেআইনি বাজার সব ক’টি ক্ষেত্রেই মাংস বিক্রির এই সব নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চলছে রমরমা ব্যবসা। পুর আইন অনুযায়ী, বড় জীবের ক্ষেত্রে পুরসভার যে কসাইখানা রয়েছে, সেখান থেকে মাংস কেটে এনে বিক্রি করতে হবে। কিন্তু ছোট জীবজন্তুর ক্ষেত্রে এ ধরনের কসাইখানা না থাকলেও প্রকাশ্য স্থানে কোনও জীবহত্যা করা যাবে না। দোকানগুলির পিছন দিকে আলাদা জায়গায় মাংস কেটে এনে কাচের আড়ালে রেখে তা বিক্রি করতে হবে।

কলকাতার উত্তর থেকে দক্ষিণে লাইসেন্সপ্রাপ্ত মাংসের দোকান ছাড়াও প্রচুর বেআইনি মাংসের দোকান গজিয়ে উঠেছে। কোনও ক্ষেত্রেই পুরসভার বিজ্ঞপ্তি বা সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মানা হচ্ছে না। রাস্তার ধারে বা ফুটপাথে যে ক’টি মুরগির মাংসের দোকান আছে সব ক’টিই বেআইনি। প্রতিটি ক্ষেত্রেই মুরগিগুলিকে ক্রেতাদের সামনে কাটা হয়। এমনকী, কাটার আগেও প্রাণীগুলিকে যে জায়গায় বা খাঁচায় রাখা হয় তা-ও আইন লঙ্ঘন করে।
এই বেআইনি কাজ দিনের পর দিন কী ভাবে চলছে? সুব্রত মুখোপাধ্যায় মেয়র থাকাকালীন কঠিন বর্জ্য বিভাগের মেয়র পারিষদ ছিলেন মালা রায়। মালাদেবী বলেন, “এটা স্বাস্থ্য বিভাগের অধীন হলেও বিধিনিষেধ পর্যবেক্ষণে অভিযান চালানোর দায়িত্বভার কঠিন বর্জ্য বিভাগের। সেই সূত্রে বহু বার সোচ্চার হয়েছিলাম। নির্দেশিকা কড়া ভাবে মেনে চলতে বাধা পেয়েছিলাম নানা তরফ থেকে।”
কলকাতা পুরসভার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের কথায়: “নিয়মভঙ্গ যে হচ্ছে জানতে পেরেছি। সময় হয়েছে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার। তবে এত বড় পুর এলাকায় সে রকম পরিকাঠামো নেই যে, প্রতিটি জায়গায় নজরদারি চালানো যাবে। তবে, প্রত্যেক পুর-প্রতিনিধিকে বলতে হবে যে, তাঁরা যেন নিজেদের এলাকার বাজারগুলি
পরিদর্শন করেন।”

কিন্তু দক্ষিণের গড়িয়া মোড় থেকে শুরু করে দেশপ্রাণ শাসমল রোড, আনোয়ার শাহ মোড়, টালিগঞ্জ ফাঁড়ি, চক্রবেড়িয়ায় ফুটপাথের উপর যদুবাবুর বাজার, ভবানীপুরের বিভিন্ন মাংসের দোকান, ল্যান্সডাউন বাজার, উত্তরের মানিকতলা অঞ্চলে ব্লাড ব্যাঙ্কের সামনের ফুটপাথে, বিধান শিশু হাসপাতালের উল্টো দিকে, কাশীপুর উদ্যানবাটী সংলগ্ন ফুটপাথে, অরবিন্দ সেতু থেকে নেমে উল্টোডাঙা যাওয়ার রাস্তার ফুট থেকে শুরু করে প্রতিটি ফুটপাথের বাজারে চলছে এই অনিয়ম। পুরসভার আওতাধীন এমনই এক বাজারের দেখভালের দায়িত্বে থাকা সুপারিন্টেন্ডেন্ট বললেন, ‘‘আমাদের বাজারের মধ্যে তিন-চারটে মাংসের দোকান আছে যার মধ্যে একটি বন্ধ থাকে। বাকিগুলোকে পুর আইন মেনে চলার কথা বলা হলেও সব সময় তা মানা হয় না।’’ তিনি স্বীকার করেন, পুরসভার পক্ষ থেকেও কোনও পর্যবেক্ষক দল আসে না।

এ ব্যাপারে সচেতনতা কতটা? গত ৪০ বছর মানিকতলা বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক পদে থাকা সুভাষ সাহা বললেন, “নিয়মটা আমার জানা নেই। তবে গত দশ বছরে পুরসভার পক্ষ থেকে কেউ এ বিষয়ে কিছু বলতে আসেননি। আগে ইনস্পেক্টর, চিকিৎসক আসতেন। বহু দিন সে সব বন্ধ। যদিও মেয়র পারিষদ (স্বাস্থ্য) অতীন ঘোষ বলেন, “প্রায়ই পুরসভার স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে আমরা অভিযান চালাই এবং প্রচুর বেআইনি মাংস বাজেয়াপ্ত করা হয়।” তাঁর কথায়: “সাধারণত রাস্তার ধারের দোকানগুলিতে খোলা জায়গায় মাংস কাটা হয় না। দোকানের পিছনে আলাদা জায়গায় মাংস কাটার নির্দেশ দেওয়া আছে। তবে অনেক জায়গাতেই আর কাচের ঘরে মাংস রাখা হয় না। সেগুলি আমরা অভিযান চালিয়ে বন্ধ করি।” তিনি জানান, গত পুরবোর্ডের সময় থেকেই স্বাস্থ্য বিভাগের বিভিন্ন গড়িমসির জন্য বহু কাজই আটকে গিয়েছে। নতুন করে ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিয়েছেন মেয়র পারিষদ।

পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের মুখ্য আইন আধিকারিক বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় প্রকাশ্যে মাংস কাটা ও বিক্রির ব্যাপারে বললেন, ‘‘সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ রয়েছে, যে জায়গায় মাংস বিক্রি হবে সেই জায়গা কালো কাচে ঢাকা থাকবে এবং প্রকাশ্যে কোনও জীবকেই হত্যা করা যাবে না। একই সঙ্গে কসাইখানায় মাংস কাটার পরে যে রক্ত বা বর্জ্য পদার্থ পড়ে থাকে তা ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের মধ্য দিয়ে পরিশোধিত করতে হবে।’’ কিন্তু ফুটপাথে বা রাস্তার উপরে যে মাংসের দোকান রয়েছে সেখানে মাংস কাটার পরে রক্ত বা অন্যান্য বর্জ্য পড়ে থাকে তা গিয়ে মেশে রাস্তার পাশে নর্দমায়। বিশ্বজিৎবাবু বলেন, ‘‘এ ধরনের কোনও অভিযোগ আমাদের কাছে এলে তা খতিয়ে দেখি এবং সংশ্লিষ্ট পুরসভাকে সতর্কীকরণ পাঠাই যাতে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হয়। সাধারণত এ ব্যাপারে বিধি লঙ্ঘন হলে তা দেখার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট পুর কর্তৃপক্ষের।”

Previous Story

Kolkata

Next Story

 



অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.