ব্যাগ গুছিয়ে...

পৌঁছে যাব আর
এক নতুন জীবনে
পাসনা এক্সপ্রেস হরিদ্বার পৌঁছতে বাড়তি একুশ ঘণ্টা সময় নিল আর আমার বেড়ানোর একটা দিন উধাও। মুষড়ে পড়া মনটাকে টেনে নিয়ে উঠলাম স্টেশন পেরিয়ে এক হোটেলে। সে রাতের আশ্রয়। পর দিন সকালে হারিয়ে যাওয়া একটা দিনের কথা মাথায় রেখে আর বাসস্ট্যান্ডে নয়। সোজা ট্যাক্সি আড্ডায় হাজির। ঋ
ষিকেশ হয়ে দেবপ্রয়াগ, সেখান থেকে শ্রীনগর, রুদ্রপ্রয়াগ, অগস্ত্যমুনি পার করে...পথে মন্দাকিনী আর অলকানন্দার মেশামেশি দেখতে দেখতে...পাঁচ ঘণ্টার পথ শেষে এসে পৌঁছই উখিমঠ। মন্দাকিনীর বাঁ দিকে উখিমঠ, ছোট গঞ্জ। কর্মব্যস্ত ছোট বাসস্ট্যান্ডটা পার হয়ে হিমালয়ের খুব কাছাকাছি। কেদারনাথের পর্যটকদের ভিড় এখানে নেই, তাই আপাত নিরিবিলি আর নির্ঝঞ্ঝাট জায়গা। শহরের কোলাহল নেই। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অনাবিল। বরফে-ঢাকা পাহাড় আর মন্দাকিনী, দুই-ই নজরে আসে। বাসরাস্তা থেকে ছোট রাস্তা নেমে গেছে মন্দিরের দিকে।

উখিমঠের এই মন্দির কিন্তু গাড়োয়ালের প্রথম সারির মন্দিরের মধ্যে। এ পথে চলতে চলতে নীচের স্কুল বাড়ি নজরে আসে। পাশ দিয়ে বিনুনি বাঁধা স্কুলের দু’-তিনটি ছোট মেয়ে গড়গড়িয়ে নেমে চলে তাদের লাল টুকটুকে গালে হাসির ঝিলিক তুলে। শোনা যায়, পুরাকালের মহারাজ মান্ধাতা তীর্থভ্রমণে বেড়িয়ে এসে পৌঁছন এই উখিমঠে। শুরু করেন শিবের নামগান ও কঠোর তপস্যা। তপস্যায় তুষ্ট মহাদেব মান্ধাতার প্রার্থনা অনুসারে বর দেন এই উখিমঠ দর্শন করলেই সমস্ত কেদারখণ্ড দর্শনের পুণ্য পাওয়া যাবে।

আগের রাতে বলে রাখা জিপ পর দিন সকালে এসে হাজির। ঠান্ডা হাওয়া বয়ে আনছে পাখির ডাক...সাদা মেঘেরা ভেসে যেতে ভুলেছে...সূর্যটাও যেন আজ মুখ দেখাবে না ঠিক করেছে। আঁকাবাঁকা রাস্তা। মান্তুরা ছাড়িয়ে লাফাতে লাফাতে ঝাঁপাতে ঝাঁপাতে সে গাড়ি পৌঁছে দিল সারিগ্রাম। এখান থেকে দুটো রাস্তা গেছে দেওরিয়া তালে। আমি যে রাস্তাটি মনে মনে বেছে নিই তার চড়াইটা কম। তবে চলতে হবে বেশি পথ। ক্ষতি কী! আমি তো দেখতেই এসেছি। তবে আপাতত এক কাপ গরম চা আর তার পরেই...আমার পা রাস্তায়। চলার পথের শুরুটা কিছুটা সময় দম নিতে দেয়। তার পর ডান দিকে পায়ে চলা পথ উঠে যায়। ছড়ানো-ছিটানো পাথুরে রাস্তা। হাল্কা জঙ্গল। মাঝে দু-একটা বাড়ি। রামদানার খেত। ছোট বাচ্চারা হাসি মুখে ‘নমস্তে’ জানায়।

ওদের মুখের হাসিগুলো ওদের ছোট্ট ছোট্ট মুঠোয় আমার দেওয়া লজেন্সগুলোর থেকেও মিষ্টি। হঠাৎ করে জঙ্গল শেষ। সুয্যিটার মান ভেঙেছে। ঘামের ফোঁটা নামছে। হঠাৎই চোখের সামনে হাজির চৌখাম্বা। পলকের বিস্ময়...থমকে দাঁড়ানো...তার পর আবারও পা ফেলা জঙ্গলের পথে। হাসি মুখে জঙ্গল পথে আচমকা হাজির সারিগ্রামের এক দিদি। তাঁর পোষা ছাগলদের নিয়ে নামছেন। একমুঠো জংলি স্ট্রবেরি দিয়ে বললেন, ‘খেতে খেতে যাও।’ সত্যি সত্যি ওই টক-মিষ্টি বুনো ফলগুলোর মহিমা একেবারে হাতেনাতে প্রমাণ পেয়েছিলাম। মুখে দিতেই যেন এক লহমায় সব ক্লান্তি উধাও। দিদির হাসি মুখ ধরে রাখি ক্যামেরায়।

জঙ্গল স্যাঁতসেতে...আলো-ছায়া। ধীরে ধীরে উঠে আসি উপরে। এক খণ্ড নীল হঠাৎই নজরে আসে। ভাবি, এমনটা কী করে হয়, আকাশ কি নেমে আসে পৃথিবীর বুকে! আরও একটু উপরে এগোই...। আর তখনই চোখ জুড়ানো সবুজে ঘেরা টলটলে জলে ভরা দেওরিয়া তাল বা লেক। উত্তরে সার বেঁধে কেদারনাথ, মন্দাকিনী, সুমেরু, চৌখাম্বা, ভাতৃঘুণ্টা। হঠাৎ হঠাৎ লুকিয়ে পড়া রোদে কেউ বা মুখ লুকোচ্ছে, কেউ বা ঝকঝকে হাসিতে মন ভরিয়ে দিচ্ছে। আকাশ যদি থাকে ফিরোজা নীল, সূর্য যদি হয় অকৃপণ তবে টলটলে লেকের জলে মৌমাছির মতো লেপ্টে থাকা হাওয়ায় তিরতির করে কাঁপতে দেখবেন ওই সব তুষারশৃঙ্গের প্রতিচ্ছবি।

তালের শুরুতে অনেকটা ঘাসজমি। তাতে কয়েকটা তাঁবু লাগানো। ঘাসজমি নিচু হয়ে মিশেছে লেকের পাড়ে। পাথর বসানো পথ। সে রাস্তা ছেড়ে ঘাসের ঢাল ধরে চলার ছেলেমানুষিতে পেয়ে বসে। পরিক্রমা শেষে শুয়ে পড়ি ঘাসজমিতে, দু’চোখ বুজে। লেকের জল, নীল আকাশ আর পাহাড় চূড়াকে মনে নিয়ে। পাখিরা ডাকছে...রডোডেনড্রনের ডাল আমার মুখের উপর ঝুঁকে এসেছে...গা শিরশিরে হাওয়া...মনে মনে ভাবি, মৃত্যু যখন আসবে তখন যেন এমনই জায়গায়, এমনই হঠাৎ করে আসে। এমনই ভাবেই পৌঁছে যাব আর একটা জীবনে। কালকের ভোরবেলাকার প্রথম সূর্যের নরম লাল আলোতে সেই জীবনের আস্বাদ নিতেই থেকে যাই এখানে, আরও একটা দিন।

 
কী ভাবে যাবেন
কলকাতা থেকে ট্রেনে হরিদ্বার। স্টেশনের কাছে জি ও এম ইউ বাসস্ট্যান্ড থেকে সকালের বাসে উখিমঠ।
না হলে সরাসরি স্টেশনের পাশেই ট্যাক্সি আড্ডা থেকে ট্যাক্সি ভাড়া নিয়ে আসা যায় উখিমঠ। উখিমঠ
থেকে সারিগ্রাম জিপ ভাড়া করে। সারি থেকে দেওরিয়া তাল ঘণ্টা দুয়েকের হাঁটা পথ।
কোথায় থাকবেন
হরিদ্বারে অজস্র হোটেল, হলিডে হোম, ধর্মশালা আছে। উখিমঠে সরকারি ব্যবস্থাপনায় লজ আছে।
বেসরকারি হোটেলও আছে। আছে ভারত সেবাশ্রমের আশ্রম। সারিতে থাকতে চাইলে লজ ও
বেসরকারি হোটেল আছে। দেওরিয়া তালে রাত কাটাতে চাইলে তাঁবুর ব্যবস্থা আছে।
মনে রাখবেন
বর্ষা ছাড়া উখিমঠে যে কোনও সময় যাওয়া যায়। দেওরিয়া তালে শীতে কিন্তু বরফ পড়ে। এখন দেওরিয়া
তালে খাবার করে দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। তবুও হাল্কা শুকনো খাবার ও জল সঙ্গে রাখুন। হাল্কা গরম
জামা সঙ্গে থাকুক। সারিগ্রাম থেকে দেওরিয়া তাল যেতে কোনও গাইডের প্রয়োজন নেই।
Previous Item

Kolkata

Next Item

 



অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.