কলিকাতার নগর দায়রা আদালতে শামলা অর্থাৎ ‘কোর্ট-গাউন’ পরিয়া আইনজীবীদের সওয়াল করার বাধ্যতা হইতে সাময়িক অব্যাহতি দেওয়া হইয়াছে। কারণ আর কিছুই নয় প্রচণ্ড গরম আবহাওয়া। জ্যৈষ্ঠের এই তীব্র দাবদাহের মধ্যে আদালতকক্ষে দাঁড়াইয়া সওয়াল করার সময় এমনিতেই আইনজীবীদের দরদর করিয়া ঘামিতে হয়। ঘামিতে হয় উপস্থিত অন্যদেরও। কিন্তু তাঁহারা অন্তত হাল্কা সুতির পোশাক পরিয়া গরমের অস্বস্তি হইতে কিছুটা রক্ষা পান। আইনজীবীদের সে সুবিধা নাই। তাঁহাদের কালো রঙের কোর্ট-গাউন পরিয়াই থাকিতে হয়। কারণ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমল হইতে ইহাই আইনজীবীদের পোশাক বলিয়া সাব্যস্ত হইয়াছে। এবং অদ্যাবধি সেই পোশাক-বিধিই ভারতীয় আদালতগুলিতে অপরিবর্তিত রাখা হইয়াছে। কলিকাতার নগর দায়রা আদালতের মুখ্য বিচারপতির মনে হইয়া থাকিবে, এই প্রচণ্ড গরমে ওই পোশাক পরিয়া সওয়াল করিতে আইনজীবীদের রীতিমত কষ্ট হইতেছে। তাই তিনি সাময়িক ভাবে শামলা পরার বিড়ম্বনা হইতে আইনজীবীদের মুক্তি দিয়াছেন।
ঐতিহাসিক কারণেই নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়া প্রথা বা রীতি প্রচলিত হয়। তাহার যেমন কিছু ঔপচারিক উপযোগিতা আছে, তেমন প্রায়শ একটি প্রথা বা রীতি একটি প্রতিষ্ঠান বা প্রণালীর প্রতীকও হইয়া ওঠে। যাঁহারা কথায়-কথায় প্রথা ভাঙার পক্ষপাতী, তাঁহারা প্রায়শ সমাজের তুলনায় নিজের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠায় অধিকতর উৎসাহী হইয়া ওঠেন। আবার এ কথাও ঠিক যে, কখনও কখনও প্রথা বা রীতির প্রতি অতিরিক্ত নিষ্ঠা প্রগতির পথেই অন্তরায় হইয়া ওঠে। সমাজসংস্কার আন্দোলন তো সামাজিক প্রথা বা রীতি লঙ্ঘন করিয়াই সংঘটিত হইতে পারে। প্রথা বা রীতিকে, নিয়ম-বিধিকে সেখানে যান্ত্রিক ভাবে আঁকড়াইয়া থাকা অগ্রগতি ও পরিবর্তনের পক্ষে বাধাস্বরূপ হইয়া ওঠে। সংস্কারকরা তাই পুরানো প্রথা বাতিল করিয়া নূতন বিধি প্রবর্তন করেন। পোশাক-বিধি নিঃসন্দেহে একটি প্রথা, যাহা মানিয়া চলিলে মহাভারত অশুদ্ধ হইয়া যায় না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনের সময় অধ্যাপক-শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীরা যে কালো গাউন পরিয়া থাকেন, বছরে এক বারই তাঁহাদের তাহা পরিতে হয়। ডিগ্রিধারীরা অন্তত ওই গাউন পরিতে বিরক্ত হন, এমন প্রমাণ নাই, বরং তাঁহারা ওই পোশাকে সজ্জিত হইয়া ছবি তোলাইতে বেশ উৎসাহই বোধ করেন। সমাবর্তন সমারোহে গাউন খুলিয়া ফেলার মধ্যে তাই চমক থাকিতে পারে, শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ অত সহজ প্রতীকী কর্মে অর্জিত হয় না। তাহা আরও গভীর, দীর্ঘস্থায়ী সংস্কারের কাজ। আদালতের পোশাক-বিধির মধ্যে সাবেকিয়ানার যে উপাদান রহিয়াছে, তাহাও সকলের পছন্দ না হইতে পারে। কিন্তু সে জন্যই রঙচঙে জামা পরিয়া আইনজীবীরা আদালতে হাজির হইলে কমলাকান্ত চক্রবর্তীরা তখন হাকিমকে সহজে চিনিলেও শামলা-বর্জিত উকিলকে সহসা চিনিতে পারিবেন না। নগর দায়রা আদালতের মুখ্য বিচারপতি তাই শামলাকে নির্বাসিত করেন নাই, সাময়িক ভাবে অন্য পোশাক পরার অনুমতি দিয়াছেন মাত্র। ব্যবস্থা ও বন্দোবস্ত নিশ্চয় গুরুত্বপূর্ণ, কেননা দীর্ঘ কাল ধরিয়া তিল-তিল করিয়া তাহা গড়িয়া ওঠে। আবার সেই কারণেই মানুষ তাহার প্রয়োজনে যেমন আইনের পরিবর্তন ঘটায়, তেমনই বিধিরও পরিমার্জন ঘটাইতে পারে। |