কৃষিজমি রক্ষার আন্দোলন করে নির্বাচনে সাফল্য পেলেও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখন রাজ্যে শিল্পায়ন ও দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ টানতে অত্যন্ত সক্রিয়। শিল্পায়নের বিষয়টিকে তিনি যে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন, সেই বার্তা দিতেই ১৭ বা ১৮ জুন কলকাতায় দেশের বিশিষ্ট শিল্পপতিদের নিয়ে তিনি একটি সম্মেলন করতে চলেছেন। তাঁর নির্দেশে অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র এবং শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় সম্মেলনটি সফল করতে জোরকদমে নেমে পড়েছেন।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখন এই বার্তা দিতে চাইছেন যে, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনের অর্থ রাজ্যে শিল্পায়নের বিরোধিতা নয়। বরং মমতা বলেন, “বামেদের সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে প্রশাসনিক ব্যর্থতার যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তার আশু বদল প্রয়োজন।” অমিতবাবু ও পার্থবাবু বলছেন, ‘শিল্প ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জনই এখন সব থেকে বড় কাজ।’
এই আস্থা ফেরানোর জন্যই সম্মেলনের আয়োজন। সম্মেলনে যোগ দিতে মুকেশ অম্বানী, অনিল অম্বানী থেকে শুরু করে রতন টাটা পর্যন্ত দেশের সমস্ত প্রথম সারির শিল্পপতিকে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের হর্ষ নেওটিয়া, সঞ্জীব গোয়েন্কারা তো থাকছেনই। পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগকারী জিন্দল, ভিডিওকনের বেণুগোপাল ধুতের মতো শিল্পপতিকেও আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে। কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রদূতকেও আমন্ত্রণ জানানোর কথা ভাবা হচ্ছে। শিল্পায়নের ক্ষেত্রে তিনি কী ভাবছেন, তাঁর পরিকল্পনাই বা কী, সম্মেলনে সে কথাই বলবেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর সঙ্গে অমিত মিত্র, পার্থ চট্টোপাধ্যায়রাও বক্তব্য রাখবেন।
মুখ্যমন্ত্রী হয়েই মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে মমতা সিঙ্গুর নিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সেখানে ঠিক হয়, অনিচ্ছুক চাষিদের জমি ফেরত দেওয়া হবে। এই জমি ফেরত দেওয়া নিয়ে বিশেষ কোনও আইনি জটিলতা নেই বলেই মমতা মনে করেন। আইনগত দিকটি বিচার করেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। জমি ফেরত দেওয়ার বিষয়টি রাজ্য সরকার কোনও ভাবেই টাটাদের সঙ্গে সংঘাতে গিয়ে করছেন না। আলোচনার ভিত্তিতেই তা করা হচ্ছে। অনিচ্ছুক কৃষকদের জমি ফেরত দেওয়ার পর বাকি জমিতে কারখানা হলেও মমতার আপত্তি নেই। মুখ্যমন্ত্রী যে টাটাদের সঙ্গে সংঘাতে যেতে চান না, তা শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে টাটাদের আহ্বান জানিয়ে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। মমতার বক্তব্য হচ্ছে, সিঙ্গুরে যা হয়েছিল তা টাটা-বিরোধী আন্দোলন ছিল না। সেখানে অনিচ্ছুক কৃষকদের জমি ফেরত দেওয়ার দাবিতে আন্দোলন হয়েছিল। রেলমন্ত্রী হয়েও টাটাদের কোনও দরপত্র তিনি নাকচ করেননি। সাঁকরাইলের কারখানা করার সময়ও তিনি টাটার প্রতিনিধিদের ডেকেছিলেন। কাজেই পুরো বিষয়টি তিনি খোলা মনেই করতে চান।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর এই উদ্যোগে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ও খুব খুশি। তারা মনে করছে, এটা খুবই ভাল সিদ্ধান্ত। এক দিকে মমতা টাটাদের সঙ্গে সংঘাতে না গিয়ে সিঙ্গুর সমস্যার সমাধান করতে চাইছেন। আবার লগ্নির জন্য শিল্পপতিদের ডাকছেন। তৃণমূল নেতৃত্ব যে শিল্পবিরোধী নয়, এর ফলে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মধ্যে সেই বিশ্বাস ফিরে আসবে। মমতার এই প্রচেষ্টায় খোদ প্রধানমন্ত্রী মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নিতে পারেন।
কলকাতায় শিল্পপতিদের সম্মেলনের পাশাপাশি মমতা আর একটি পরিকল্পনা করেছেন। তা হল, তিনি মুম্বইয়ে গিয়েও শিল্পপতিদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। কলকাতায় মুকেশ অম্বানী ও অনিল অম্বানীদের ডাকা হলেও তাঁরা আসতে পারবেন কি না, তার নিশ্চয়তা নেই। কারণ দু’জনেরই ওই সময় বিদেশে থাকার কথা। তবে তাঁদের প্রতিনিধিরা কলকাতার সম্মেলনে থাকতে পারেন। শিল্পপতিদের ব্যস্ততা বিষয়টি মমতা বোঝেন। তাই মুম্বই গিয়েই ‘ক্যাপ্টেন্স অফ দ্য ইন্ডাস্ট্রি’-র সঙ্গে বৈঠক করতে চান তিনি। মুম্বই যাওয়ার আগে ১৩ জুন মুখ্যমন্ত্রী দিল্লি আসতে পারেন। ওই সময় যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়ার সঙ্গে যোজনা বরাদ্দ নিয়ে বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। তখন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও তাঁর বৈঠক হতে পারে। সেখানেও শিল্পায়নের জন্য প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নেবেন তিনি। এক সময় বুদ্ধদেবকেও শিল্পায়নের জন্য সাহায্য করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকাও নিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে সাফল্য আসেনি। প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় মনে করে, এর কারণ তদানীন্তন রাজ্য সরকার কোনও ‘হোমওয়ার্ক’ ছাড়াই মাঠে নেমে পড়েছিল। এখন মমতা সেই ভুল করবেন না বলেই প্রধানমন্ত্রীর আশা।
তাই শিল্পায়নের জন্য আগে থেকেই কয়েকটি প্রস্তুতি নিয়ে রাখছেন মমতা। এক, গুজরাত, কর্নাটকের মতো রাজ্যে যেখানে শিল্পায়ন সফল হয়েছে, তাদের মডেল খতিয়ে দেখা হবে। এ জন্য পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। অন্যান্য রাজ্যে শিল্পায়নের প্রক্রিয়া খতিয়ে দেখে তিনি মুখ্যমন্ত্রীকে রিপোর্ট দেবেন। প্রয়োজনে গুজরাত বা কর্নাটকেও যাবেন তিনি। কথা বলবেন কেন্দ্রীয় শিল্প মন্ত্রকের সঙ্গেও।
দুই, শিল্পের জন্য জমি দেওয়ার ক্ষেত্রেও মমতার কোনও ছুঁৎমার্গ নেই। তবে জমি পাওয়ার কত বছরের মধ্যে শিল্প করতে হবে, তার জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হবে। নতুন যে জমি-নীতি তৈরি হচ্ছে, তা-ও শিল্প বিরোধী হবে না। তিন, বিনিয়োগে ইচ্ছুক শিল্পপতিদের জন্য ‘সিঙ্গল উইন্ডো’ ব্যবস্থা চালু হবে। যাতে এ রাজ্যে বিনিয়োগে তাদের কোনও অসুবিধা বা হয়রানি না পোয়াতে হয়। চার, শিল্পের জন্য পরিকাঠামোগত সুবিধা-অসুবিধার দিকটিও আগে থেকে দেখা হবে। জল বা বিদ্যুতের মতো প্রয়োজনীয় উপাদানের যাতে অভাব না হয়, তার ব্যবস্থাও করা হচ্ছে বলে রাজ্যের শিল্প দফতরের দাবি। |