শাগরেদ থেকে প্রতিপক্ষ হয়ে এলাকা দখলের যুদ্ধে
ক সময়ে সে ছিল ঘনিষ্ঠ শাগরেদ, এখন প্রতিপক্ষ। আর এর ফলেই উল্টে যেতে বসেছে রেলের ছাঁট লোহার ব্যবসা থেকে অন্ধকার জগতে ‘গুন্ডা ট্যাক্স’ (জিটি) আদায়ের সমীকরণ।
এদের এক জন রেলের ছাঁট লোহা নিলামের কারবারের মুকুটহীন সম্রাট অমিত চৌধুরী। গত দু’দশক ধরে যার ‘খোঁজ’ পাচ্ছে না চার রাজ্যের পুলিশ। অপর জন অমিতেরই দলের এক সময়ের অন্যতম মাথা, বিহারের সংযুক্ত জনতা দলের প্রাক্তন বিধায়ক সুনীল পাণ্ডের ছোট ভাই হুল্লাস পাণ্ডে।
পুলিশ সূত্রের খবর, সুদূর দুবাই বা নেপালে বসে মোবাইলে রাজ্যপাট সামলানো অমিতের সঙ্গে সম্প্রতি সম্পর্কে ছেদ পড়েছে হুল্লাসের। কারণ, আলাদা দল তৈরি করে গুন্ডা ট্যাক্স আদায়ে নেমে পড়েছে হুল্লাস। দক্ষিণ-পূর্ব রেলের খড়্গপুর, ভুবনেশ্বরে ছাঁট লোহার নিলামে নিয়মিত হাজির থাকছে তার দলবল। অমিতকে ‘গুন্ডা ট্যাক্স’ না দিয়ে তা হুল্লাসকে দেওয়ার জন্য শাসানো হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। এ সব নিয়েই শুরু হয়েছে অন্ধকার জগতের দুই মাফিয়ার চরম শত্রুতা। শুরু হয়েছে এলাকা দখলের লড়াই।
সম্প্রতি ভর সন্ধ্যায় ডন বস্কো মোড়ের কাছে একটি ছাঁট লোহার গুদামের ভিতরে নৃশংস ভাবে গুলি করে ও কুপিয়ে খুন করা হয় এলাকার কুখ্যাত দুষ্কৃতী ও তোলাবাজ পলাশ দাসকে। কিন্তু কেন ফের রক্তাক্ত হয়ে উঠল বেলুড়, বজরংবলী এলাকা? বেলুড় এলাকার এক শ্রেণির ছাঁট ব্যবসায়ীদের ঘনিষ্ঠ পলাশকে খুনের পিছনে কার হাত আছে? তার মৃত্যুতে কাদেরই বা লাভ? এ নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। উত্তর খুঁজতে গিয়ে পুলিশের কাছে যে তথ্য উঠে এসেছে, তা কার্যত এই খুনের পিছনে আন্তঃরাজ্য দুষ্কৃতীদের জড়িয়ে থাকার সম্ভবনাকেই প্রবল করেছে।
নিহত পলাশ।
ছবি: রণজিৎ নন্দী

প্রাথমিক তদন্তের পরে পুলিশ জানায়, পলাশের এলাকা ছিল উত্তর ২৪ পরগনা থেকে হুগলি পর্যন্ত। মূলত জমি-বাড়ির দালালি, প্রোমোটারি ছাড়াও দক্ষিণ-পূর্ব রেলের ছাঁট লোহা নিলাম থেকে নিয়মিত তোলা আদায় করত সে। ওই এলাকায় সে-ই ছিল শেষ কথা। পাশাপাশি, ‘ডন’ অমিতকে গুন্ডা ট্যাক্স দিতে গোপনে বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের ‘সিন্ডিকেট’-এর সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে চলত সে।
এ দিকে পুলিশ জেনেছে, এলাকা দখল করতে অমিতের মতো পাল্টা দল তৈরি করে হাওড়াতেও জাল পাতে হুল্লাস। দলে যোগ দেয় হাওড়ার কিছু লোহা ব্যবসায়ী ও দুষ্কৃতী। মূলত হাওড়ায় হুল্লাসের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে তার দলের লোকজন এশিয়ার সবচেয়ে বড় ছাঁট লোহার কারবার বেলুড় ও বজরংবলী দখল করার জন্য উঠেপড়ে লাগে। কিন্তু এলাকার দখলদারি রাখতে প্রতি ক্ষেত্রে বাধা দেওয়ায় পলাশের সঙ্গে গণ্ডগোল বাধে রামনিবাস গিরি, গালকাটা রানাপ্রতাপ ও কিষণলাল জৈন খুনের মামলায় ধৃত রাজ্য পুলিশের প্রাক্তন কর্মী শঙ্কর শর্মা ওরফে ভোলার। নির্বাচনের আগে ভোলার সঙ্গে হাতাহাতিও হয় পলাশের। একই সঙ্গে ‘সিন্ডিকেটে’ ঢুকতে বাধা দেওয়ায় সম্প্রতি হুল্লাসের দলে যোগ দেওয়া ডানলপের বাসিন্দা এক ব্যবসায়ীও তার শত্রু হয়ে যায়। তাঁর বাড়িতে গিয়ে ভয়ও দেখিয়ে আসে পলাশ। পুলিশ জেনেছে, ওই ব্যবসায়ীই হাওড়ায় হুল্লাসের মূল এজেন্ট।
প্রাথমিক ভাবে তদন্তকারীদের ধারনা, ‘পথের কাঁটা’ সরাতে বাইরে থেকে শার্প-শু্যটার দিয়ে পলাশকে খুন করার ছক কষা হয়। পুলিশ নিশ্চিত, পলাশকে লক্ষ করে যে দুষ্কৃতী মুঙ্গেরের তৈরি নাইন এমএম পিস্তল দিয়ে গুলি চালায়, তাকে আগে কেউ দেখেননি। প্রায় ৬ ফুট লম্বা, টুপি পরা ওই দুষ্কৃতীর নিশানাও ছিল অব্যর্থ। এই খুনের পিছনে অন্য কিছু সম্ভাবনাও খতিয়ে দেখছে পুলিশ। পুলিশের অনুমান, জমি-বাড়ির প্রোমোটারি করতে গিয়ে উত্তর ২৪ পরগনা থেকে হাওড়া-হুগলি পর্যন্ত প্রচুর শত্রু তৈরি হওয়ায় খুন হতে পারে পলাশ।
জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুমনজিৎ রায় বলেন, “এটা ভাবা ঠিক নয় যে বিদেশ থেকে লোক এনে পলাশকে খুন করা হয়েছে। ওই ঘটনায় স্থানীয় দুষ্কৃতীও যেমন ছিল, বাইরে থেকে ভাড়া করে আনা শার্প শু্যটারও থাকতে পারে। সমস্ত সম্ভাবনাই খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”

Previous Story South Next Story




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.