যাই হোক, হঠাৎ আমার চোখ পড়ল পাশের একটা খাঁচায়। তার মধ্যে রয়েছে বেশ স্বাস্থ্যবান, গাবলু-গুবলু চেহারার গোটা পাঁচেক বেড়াল। প্রথমটায় আমি বুঝতে পারিনি, তার পর খটকা লাগতেই আমি আমার সঙ্গিনী দোভাষিণীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমরা কি বেড়ালও খাও নাকি? সে আমার দিকে ফিরে গভীর বিস্ময়-ভরা নয়নে বলেছিল, সে কি, তোমরা বেড়াল খাও না? বেড়াল তো ডেলিকেসি! আমার মনে হল, সর্বনাশ, তা হলে বোধহয় আমাকেও এর মধ্যে বেড়ালের মাংস খাইয়ে দিয়েছে। দোভাষীরাও ইংরিজি এত কম জানে যে রেস্তোরাঁর টেবিলে যখন অনেক রকম খাদ্য আসে, তখন বেশ কয়েকটার নাম ওরা বুঝিয়ে বলতে পারে না। আমি আগেই জানিয়ে দিয়েছিলাম যে, আমি শুধু কুকুর আর বাঁদর খাব না, কারণ কুকুর আমরা বাড়িতে পুষি, আর বাঁদর আমাদের পূর্বপুরুষের বংশ, এ ছাড়া আর সব কিছুই আমি স্বাদ নিয়ে দেখতে পারি। তখন অবশ্য বেড়ালের কথা আমার মনে পড়েনি।
সে বারে চিনের বিভিন্ন শহরের রাস্তাঘাটে কুকুর-বিড়াল, ষাঁড় কিংবা পাখি-টাখি কিছুই চোখে পড়েনি। কারণ, শুনেছি, চিনেরা এ সবই খেয়ে ফেলে, পোকা-মাকড় পর্যন্ত। তবে আরশোলা খাওয়াটা বোধহয় নিছক গুজব।
এ বারে, এই মে মাসে, ২০১১ চিন সফরের সময় আমার অন্য সঙ্গী সাত জনের কেউই আগে এ দেশে আসেননি। দ্রষ্টব্য স্থানগুলি তাঁরা তো ঘুরে দেখছেনই। আমি ভাবলাম, অভিনব অভিজ্ঞতার জন্য ওঁদের সাংহাইয়ের সাপের বাজারটা দেখিয়ে আনি। এ যাত্রা আমাদের দোভাষী ও সঙ্গীর সংখ্যা তিন জন। তাদের ইংরিজি জ্ঞান আগের থেকে একটু ভাল। আমি তাদের ওই বাজারের কথা জিজ্ঞেস করতেই এক জন বলল, কোনও বাজারে তো সাপ বিক্রি হয় না! আমি জিজ্ঞেস করলাম, বাজারে বিক্রি হয় না। তা হলে তোমরা খাওয়ার জন্য সাপ পাও কোথা থেকে? অল্পবয়সি একটি মেয়ে সাপ খাওয়ার কথা শুনে খুবই বিস্মিত। অপেক্ষাকৃত বয়স্ক পুরুষটি বললেন, এক কালে খাওয়া হত, এখন বন্ধ হয়ে গেছে। আর ব্যাঙ? তা-ও খুব কম দোকানে পাওয়া যায়। পরিবেশ রক্ষার কারণে ও-সব খাদ্য নিষিদ্ধ। কথাবার্তায় যা বুঝলাম, সাপ-ব্যাঙ-কুকুর-বেড়াল-পোকামাকড় খাওয়ার অভ্যেস এরা ত্যাগ করেছে। আধুনিক চিনা নারী-পুরুষের পোশাক ও পোশাকের ফ্যাশন, হাবভাব (ইংরিজি ভাষা বাদ দিয়ে) পুরোপুরি পশ্চিমী দেশগুলির মতন, কিংবা তার চেয়েও বেশি। অর্থাৎ, চিনেরা আর চিনে থাকছে না, সাহেব হয়ে যাচ্ছে! শিগ্গিরই তারা ইংরিজিও শিখে নেবে।
আমার বেশি অবাক লাগল এই ভেবে যে, একটা দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা হঠাৎ ওলটপালট হয়ে যেতে পারে, অর্থনৈতিক উন্নতিও হতে পারে ধাঁ-ধাঁ করে। কিন্তু সামাজিক পরিবর্তন কি পনেরো-কুড়ি বছরে এতখানি হওয়া সম্ভব? আমরা যাদের দেখলাম, তারা খাদ্য-অভ্যেস একেবারে বদলে ফেলেছে। হোটেল, রেস্তোরাঁয় যে-সব খাবার পাওয়া যায়, তা রান্নার পদ্ধতির জন্য অবশ্যই চাইনিজ ফুড, কিন্তু খাদ্যবস্তুগুলোর সঙ্গে ইউরোপ-আমেরিকার খাদ্যের কোনও তফাত নেই। মাংস বলতে এখন শুয়োর-গরু-ভেড়া ও হাঁস-মুরগি, মাছ নানা রকম এবং চিংড়ি সুলভ। লোকের ক্রয়ক্ষমতাও বেড়েছে। বিয়ার তো ছিলই। রেড ওয়াইনও অস্ট্রেলিয়া-ফ্রান্স-ব্রাজিলের মতন না হলেও বেশ ভাল। হুইস্কি-রাম বিশেষ কেউ খায় না। ওদের জাতীয় পানীয় মাওতাই। মদ্যপান বিষয়ে চিনে শুচিবাই আগেও ছিল না, এখনও নেই। চিনের বড় শহরগুলিতে চোখ ধাঁধানো হর্ম্যসারি দেখলে তাক লেগে যায়। এবং প্রশস্ত রাস্তা ও পরিচ্ছন্নতা... অনেকেই বলতে শুরু করেছেন, আর দশ বছরের মধ্যে চিন ছাড়িয়ে যাবে আমেরিকাকে। একদলীয় সরকার এখনও কিছু কিছু অনুশাসন জারি রেখেছে। রাষ্ট্রের কড়া সমালোচনা করলে কারাদণ্ড হয়। এ বারের নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রাপক তো এখনও জেল খাটছেন। তবু কমিউনিজমের লাল রং অনেকটা ফিকে হয়ে এসেছে বোঝা যায়। লাল ঝান্ডা দেখাই যায় না। নিষিদ্ধ নগরীর সামনে ছাড়া আর কোথাও মাও জে দং কিংবা অন্য কোনও নেতার ছবি চোখে পড়ল না। দু’-একটা ছোট গল্পে লোকাল কমিটির দাদাগিরি নিয়ে বিদ্রুপ-মশকরাও পড়ে ফেললাম। যাই হোক, সবচেয়ে দর্শনীয়, চিনের রাস্তায় রাস্তায় ফুলের বাহার। সত্যি অপূর্ব। ফরাসি দেশেও এত ফুলের সজ্জা নেই। ভারতে বুঝি এত ফুল ফোটে না?
বেজিং-এ বঙ্গ ভাষা
সেই একুশ বছর আগে গোটা সফরে একজনও বাঙালির সঙ্গে দেখা হয়নি। সে বারে ভ্রমণ ছিল অনেকটা ঘেরাটোপের মধ্যে। বাংলা শুনেছিলাম একবারই। বেজিং-এ, বেশ নাটকীয় ভাবে। এক সন্ধেবেলা বেজিং-এর সরকারি লেখক সংস্থার সঙ্গে আমাদের আলাপচারিতার ব্যবস্থা হয়েছিল। আমি, কমলেশ্বর ছাড়া আর সবাই চিনে লেখক। এর আগে ভারত সরকারের রাষ্ট্রদূত আমাদের ডেকে অনুরোধ করেছিলেন যে, আমরা যেন তিয়েনানমেন স্কোয়ারের ঘটনা নিয়ে কোনও প্রশ্ন না করি কোথাও। মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেই বেজিং-এর ওই বিশাল পার্কে ছাত্রবিদ্রোহ দমন করার জন্য সামরিক বাহিনী ট্যাঙ্ক এনে, গুলি চালিয়ে নৃশংস ভাবে সে বিদ্রোহ দমন করে। চিন সরকার সেই ভয়াবহ কাহিনি যাতে সারা বিশ্বে না ছড়ায়, তার জন্য বিশেষ তৎপর। সেই লেখক সংস্থার মিটিং-এ ওই প্রসঙ্গ একেবারে বাদ। আমরা শান্তি ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক বিষয়ে মিষ্টি মিষ্টি কৃত্রিম কথা চালিয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ ও দিক থেকে একটি চিনে মেয়ে উঠে এসে আমার কাছ ঘেঁষে বসে ফিসফিস করে পরিষ্কার বাংলায় বলল, জানেন তো, তিয়েনানমেন স্কোয়ারে অন্তত তিন হাজার ছেলেমেয়ের মৃতদেহ পড়ে ছিল। আরও কত যে নিরুদ্দেশ! সরকার সব চেপে দিচ্ছে। কত যে মা-বাবা কাঁদছে...। মেয়েটি শান্তিনিকেতনে ছিল, ভাল বাংলা জানে, তার কথা আমি ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারছে না ঠিকই। তবু আমার মনে হয়েছিল, যদি ওর বডি ল্যাঙ্গোয়েজে বোঝা যায় যে ও কোনও রাষ্ট্রবিরোধী কথা বলছে? তাই তার নিরাপত্তার কথা ভেবেই আমি বলেছিলাম, চুপ, চুপ।
এ বারে শুনলাম অনেক বাংলা কথা। ভারতীয় দূতাবাসের সংস্কৃতি কেন্দ্রে একটি আলোচনাসভায় যত শ্রোতা উপস্থিত, তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই বাংলাভাষী! ভারতীয় বাঙালিরা তো আছেনই, তা ছাড়াও ছিলেন অনেক বাংলাদেশি। আর বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দূতাবাসের কয়েক জন প্রতিনিধি। আমি বিদেশে যেখানেই যাই, বাংলাদেশিদের দেখে খুব আত্মীয়তা অনুভব করি। আমাদের কলকাতা অফিসে টেলিগ্রাফ পত্রিকার এক সহকর্মী চিত্রলেখা বসুও এখন তো চিনের একটি ইংরেজি পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত। তার দেখা পাওয়া মানে যাকে বলে প্লেজান্ট সারপ্রাইজ। টাইমস অব ইন্ডিয়ার স্থায়ী চিনা প্রতিনিধিও একজন বাঙালি। শৈবাল দাশগুপ্ত। সেই দম্পতির সঙ্গে আড্ডা হল এক সন্ধ্যায়। একটি হাস্যমুখী চিনা মেয়ে আমারই লেখা একটি বই সই করতে এনে বলল, লিখুন, আমার নাম সুস্মিতা। আমি হকচকিয়ে যেতেই সে বলল, না, তার বাবা-মা কেউই বাঙালি নয়। সে নিজেই এই নাম নিয়েছে। তার আসল নাম ইউকুই ইয়াঙ্গ। সে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা পড়ায়। (কমিউনিকেশন ইউনিভার্সিটি অব চায়না/ফরেন ল্যাঙ্গোয়েজ কলেজ/ডিপার্টমেন্ট অব এশিয়ান অ্যান্ড আফ্রিকান ল্যাঙ্গোয়েজেস)। আমি সেই মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি বাংলা পড়াও, তোমার ক্লাসে বাংলার ছাত্র-ছাত্রী হয়? সে বেশ ফুরফুরিয়ে হেসে বলল, হ্যাঁ, হয়। ভালই। আরও দু’জন চিনে মধ্যবয়সি ভদ্রলোক রাত্তিরে হোটেলে দেখা করতে এলেন আমার সঙ্গে। তাঁরা বেশ সহজ বাংলা বলেন। বাংলা পড়তেও পারেন। এবং কী আশ্চর্যের কথা, আমার মতন একজন সামান্য লেখকেরও কয়েকটা বই তাঁরা পড়ে ফেলেছেন। তাঁরা কর্মসূত্রে বাংলাদেশে থেকেছেন অনেক দিন। বাংলা ভাষা শিখেছেন সেখানেই। সেই রাত্রে শুয়ে শুয়ে আমার মনে হল, যদি একুশে ফেব্রুয়ারি, বাহান্ন সালে ঢাকায় গুলি চালনা না ঘটত, যদি পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশের জন্ম না হত, তা হলে কি আমরা বাংলা ভাষার গৌরবের পতাকা উঁচুতে তুলে ধরতে পারতাম? পশ্চিমবাংলায় আমাদের হাত মাঝে মাঝে কম্পমান। বাংলাদেশিদেরই মুষ্টি অনেক দৃঢ়।
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যিনি গবেষণা করছেন, যাঁকে গত বছর কলকাতায় বাংলা অ্যাকাডেমিতে সম্মান জানানো হয়েছিল, তিনি এখনও রবীন্দ্র রচনাবলি অনুবাদে ব্যাপৃত। আগের বারও দেখেছি, এ বারেও শুনলাম, সব লেখকই রবীন্দ্রনাথের কোনও না কোনও কবিতা পড়েছেন। একজন জানালেন যে, চিনের উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি মাত্রই রবীন্দ্রনাথের নাম জানে। (চিনে শিক্ষিতের হার শতকরা আটানব্বই)। পশ্চিমী দেশগুলিতে রবীন্দ্রনাথের এমন পরিচিতি এখন আর নেই। অনেক আধুনিক লেখক রবীন্দ্রনাথের নামই জানে না। সেই তুলনায় চিনা সাহিত্যের কতটুকু আমরা জানি? চিনা ভাষায় আধুনিক সাহিত্যের পথিকৃৎ লু সুন-এর লেখা আমরা ক’জন পড়েছি? আমাদের সঙ্গে অন্য ভাষার যে ক’জন লেখক ছিলেন, তাঁদের মধ্যে অর্ধেক লু সুন-এর নামও শোনেনি। কনফুসিয়াস? তিনি কি লেখক না দার্শনিক না গুরু? দু’-চারটে বাণী হয়তো কেউ কেউ দেখে থাকবেন। মাও জে দং-এর কবিতা এবং লাল বই এক সময় বাংলার তরুণ বিপ্লবীদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল। এখনকার মাওবাদীরা তাও পড়েন কি না জানি না!
আমি কলকাতায় থাকি শুনে একজন চিনা লেখিকা বললেন, কলকাতা? সে তো বিশ্বের প্রধান দশটির মধ্যে একটি। তাই না? আমি জোর করে হেসে বললাম, পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে তা ছিল ঠিকই, এখন আর তা নেই।
দীর্ঘশ্বাস চেপে মনে মনে বললাম, এখন তো কলকাতা প্রায় একটা মফস্সল শহর হয়ে গেছে।
একটি সংক্ষিপ্ত সংবাদ
মে মাসের ন’তারিখ। রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে দিল্লির সমস্ত জাতীয় ইংরেজি সংবাদপত্রে একটি খবর বেরিয়েছে, সেটির অনুবাদ করে দিচ্ছি:
‘‘তিরুবনন্তপুরম: আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে কেরলের সমস্ত স্কুলের ছাত্রদের মালয়ালম ভাষা আবশ্যিক ভাবে শিক্ষা করতে হবে। নতুন রাজ্য সরকারের এই নির্দেশ। রাজ্যের এডুকেশন রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং কাউন্সিলের সুপারিশক্রমে এই নির্দেশ জারি হয়েছে। একটি সরকারি প্রেস রিলিজে জানানো হয়েছে যে, আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে এই নির্দেশ কার্যকর করার জন্য ডি পি আই-কে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।’’
আর পশ্চিমবাংলায়? |