সম্পাদকীয় ২...
বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ

শ্চিমবঙ্গের নূতন সরকার অনেক নূতন পরিকল্পনা করিতেছে, অনেক নূতন উদ্যোগ লইতেছে। চৌত্রিশ বছরের স্থিতাবস্থার পরে নূতন কেবল ভাল নয়, অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু যে কোনও নূতন উদ্যোগই ভাল, এমন কথা মনে করিবার কারণ নাই। পশ্চিমবঙ্গে একটি আইন বিশ্ববিদ্যালয় তৈয়ারি করিবার পরিকল্পনা করিতেছে রাজ্য সরকার। রাজ্যে আইন শিক্ষা দিবার জন্য যে কলেজগুলি রহিয়াছে, তাহাদের এই নূতন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছত্রচ্ছায়ায় আনা হইবে। রাজ্যের প্রযুক্তি শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলিকে এই কারণেই একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আনা হইয়াছিল। শিক্ষার সমন্বয় সাধনের উদ্দেশ্যটি সাধু। কিন্তু তাহার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কেন? আইন, ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিক্যাল, ম্যানেজমেন্ট ইত্যাদি বিষয়ক শিক্ষা প্রকৃত অর্থে বৃত্তি-অভিমুখী শিক্ষা, এই শিক্ষায় শিক্ষিত হইলে বিভিন্ন পেশায় যোগ দেওয়া যায়। বৃত্তি বা পেশা গুরুত্বপূর্ণ, তাহার জন্য বিশেষ শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ অর্জন করা বহু মানুষের পক্ষেই জরুরি। বস্তুত, এই দেশে, বিশেষত এই রাজ্যে বৃত্তি-উপযোগী শিক্ষার প্রসার যথেষ্ট হয় নাই, ইহা একটি বড় সমস্যা। ইঞ্জিনিয়ারিং বা মেডিক্যাল শিক্ষার সুযোগ অতিমাত্রায় সীমিত বলিয়া রাজ্যের শিক্ষার্থীদের বিরাট সমস্যায় পড়িতে হয়। গত কয়েক বছরে আপাতদৃষ্টিতে এই সমস্যার কিছুটা সুরাহা হইয়াছে রাজ্যে প্রযুক্তি-শিক্ষার প্রতিষ্ঠান সংখ্যায় বিস্তর বাড়িয়া গিয়াছে। কিন্তু তাহাদের গুণমান সম্পর্কে বিস্তর প্রশ্ন, বহু সংশয়। বৃত্তি-অভিমুখী শিক্ষার উন্নতির জন্য নূতন সরকার চেষ্টা করিবে, ইহা প্রত্যাশিত। আইন শিক্ষার ক্ষেত্রেও উন্নতির অবকাশ প্রচুর। আইন শিখাইবার যে প্রতিষ্ঠানগুলি আছে, সেগুলির মধ্যে সমন্বয় সাধনও নিশ্চয়ই আবশ্যক।
কিন্তু তাহা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ হইতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয় কাহাকে বলে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কী করণীয়, সেই বিষয়ে সম্যক ধারণার অভাবই এই ধরনের পরিকল্পনার জন্ম দিতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র, সর্বোচ্চ স্তরের কেন্দ্র। জ্ঞানচর্চা কী, সেই বিষয়ে কালক্রমে সমাজে কিছু ভুল ধারণা তৈয়ারি হইয়াছে। জ্ঞানের সহিত বৃত্তি বা পেশা জড়াইয়া গিয়াছে। কী পড়িলে ভাল চাকুরি পাওয়া যায়, তাহাই জ্ঞানের উদ্দেশ্য এবং বিধেয় হিসাবে গণ্য হইতেছে। ইহা ভুল ধারণা। প্রকৃত জ্ঞানচর্চার সহিত বৃত্তি-শিক্ষার পার্থক্য কী, বহু ভাবে তাহার উত্তর সন্ধান করা যায়। কিন্তু তাহার মূল কথাটি বলিয়াছিলেন মৈত্রেয়ী। যাজ্ঞবল্ক্য যখন তাঁহাকে বিষয়সম্পত্তি এবং জ্ঞানতপস্যার মধ্য হইতে আপন পথ বাছিয়া লইতে বলিয়াছিলেন, তখন তাঁহার জবাব ছিল: যাহা অমৃতের সন্ধান দিবে না, তাহা লইয়া তিনি কী করিবেন? গভীর অর্থে জ্ঞান অমৃতের সন্ধান দেয়, তাহা পার্থিব সম্পদ বা সাফল্যের হাতিয়ার নয়। সন্দেহ নাই, সে মৈত্রেয়ীও নাই, সেই তপোবনও নাই। কিন্তু জ্ঞানের মূল ধর্ম বা আদর্শটি অবিচল। যাঁহারা যথার্থ উচ্চ শিক্ষার অন্বেষণ করেন, যাঁহারা অধ্যাপনা ও গবেষণার পথে উচ্চ স্তরের জ্ঞানচর্চায় ব্যাপৃত, জ্ঞান অর্জনের নিজস্ব আকর্ষণই তাঁহাদের মস্তিষ্ককে চালনা করে, জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে আপন বোধকে সমৃদ্ধ করিবার লক্ষ্যেই তাঁহারা উত্তরোত্তর অগ্রসর হন। তাহার সহিত পার্থিব সাফল্যের অভিলাষও মিশ্রিত থাকে না, এমন কথা বলিলে বাস্তবতার হানি হইবে, কিন্তু শুধুমাত্র সেই সাফল্যের প্রেরণা বা তাড়না যথার্থ জ্ঞানান্বেষণের উৎস নয়, আজও নয়। বিশ্ববিদ্যালয় এই উচ্চতর জ্ঞানের আলয়। তাহার সহিত বৃত্তিশিক্ষার কোনও সম্পর্ক নাই।

Previous Item Editorial Next Item




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.