পার্বত্য দার্জিলিঙে কি শান্তি ও সুস্থিতির অনুকূল পরিবেশ রচিত হইতেছে? সোমবার মহাকরণে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার শীর্ষ নেতা বিমল গুরুঙ্গের সহিত বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বতন্ত্র গোর্খাল্যান্ড রাজ্য দিবার আশ্বাস দেন নাই। তিনি ইতিপূর্বেই ঘোষণা করিয়া দিয়াছেন যে, পশ্চিমবঙ্গকে পুনরায় বিভক্ত করার প্রশ্নই ওঠে না। এমনকী গোর্খা স্বায়ত্তশাসনের ভৌগোলিক সীমানায় ডুয়ার্স বা শিলিগুড়িকে অন্তর্ভুক্ত করার আশাও তিনি জাগান নাই। তথাপি বিমল গুরুঙ্গ ও মোর্চা নেতৃত্ব মুখ্যমন্ত্রীর সহিত আলোচনা করিয়া খুশি। খুশি মনেই তাঁহারা পাহাড়ে ফিরিতেছেন। তাঁহাদের ধারণা হইয়াছে, নূতন মুখ্যমন্ত্রীর মধ্যে কোনও ঔদ্ধত্য নাই, বরং তিনি আন্তরিক। মন দিয়া সকলের কথা শোনার, প্রান্তিক মানুষদেরও গুরুত্ব ও মর্যাদা দিবার এবং তাহাদের অভাব-অভিযোগ দূর করার ব্যাপারে আগ্রহী। গোর্খাদের তাচ্ছিল্য করার কোনও প্রবণতাও তাঁহার নাই। মোর্চা নেতৃত্বের মনে হইয়াছে, মহাকরণের তরফে পাহাড়ের প্রতি এই সহমর্মিতা ও হৃদয়বত্তা দ্বিপাক্ষিক আলোচনা নূতন করিয়া শুরু করার পক্ষে যথেষ্ট।
একটু সৌজন্য, সামান্য সহানুভূতি, ‘পর’ ভাবিয়া দূরে সরাইয়া না রাখিয়া কাছে টানার সচেতন প্রয়াস জনজাতীয় রাজনীতিতে কী চমৎকার ঘটাইতে পারে, গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার নেতৃত্বের ভঙ্গি-পরিবর্তনে তাহা স্পষ্ট। মনে রাখা ভাল, তাঁহারা যে রাজনীতিকের সৌজন্য, শিষ্টাচার ও আন্তরিকতায় সন্তুষ্ট, অতীতে তিনিও রাজ্য-রাজনীতিতে অগ্নিকন্যা বলিয়াই গণ্য হইতেন। কিন্তু তাঁহার সহিত আলোচনার পর মোর্চা নেতৃত্ব এমনকী পৃথক গোর্খাল্যান্ডের দাবিও তোলেন নাই, বরং ওই দাবিকে ‘হৃদয়ে রাখিয়া’ আপাতত পাহাড় ও ডুয়ার্সের উন্নয়নে মুখ্যমন্ত্রীর কর্মসূচি রূপায়ণে শামিল হইতে চাহিয়াছেন। গোর্খাল্যান্ড ‘পরে হইবে’ বলিয়া বিমল গুরুঙ্গের ঘোষণা সমতলের মানুষ ও রাজ্যের প্রশাসনকে হুমকি দেওয়া, ভীতি-প্রদর্শন করা কিংবা ৯৬ ঘণ্টার বন্ধ পালনকরার পরিচিত রাজনৈতিক প্রকরণ হইতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। বস্তুত, মমতা-গুরুঙ্গ বৈঠক সমতল ও পাহাড়ের মধ্যে যে হার্দ্য পারস্পরিকতা সূচিত করিয়াছে, দার্জিলিঙের জনজীবনে তাহার ইতিবাচক প্রভাব পড়িতে বাধ্য। সেটাই সেই কাঙ্ক্ষিত আবহ, যাহাতে ঠান্ডা মাথায় দুই পক্ষ নিজেদের বাধ্যবাধকতা লইয়া মতবিনিময় করিতে পারে। শিলিগুড়ির রাস্তায় সেনাবাহিনীকে রুট-মার্চ করাইয়া কিংবা সশস্ত্র পুলিশ দিয়া অবরোধ ভাঙিয়া তাহা অর্জন করা যায় না, সমতলকে পাহাড়ের বিরুদ্ধে প্ররোচিত কিংবা সমাবেশিত করিয়া তো নয়ই।
মোর্চা নেতৃত্বের বাধ্যবাধকতাগুলি এত দিনে আর অস্পষ্ট নয়। বাংলা বিভাজন করিয়া পৃথক রাজ্য হাসিলের দুরাশা তাঁহারা এত দিনে ছাড়িয়া দিয়াছেন। অথচ সুবাস ঘিসিং যতটুকু পার্বত্য দার্জিলিঙের জন্য হাসিল করিয়াছিলেন, তাহার বেশি তাঁহাদের আদায় করিতে হইবে। অন্যথায় পার্বত্য দার্জিলিঙে তাঁহাদের জনসমর্থনের মাটি আলগা হইয়া পড়িবে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকারের প্রতি মোর্চা নেতৃত্বের যে মনোভাব ছিল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের প্রতি মনোভাবের পরিবর্তনের রহস্য সেটাও। তা ছাড়া, মমতা সরকারের পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণের কথা তো আগেই উল্লেখিত। এখন দেখিবার, নূতন সরকার গোর্খা নেতৃত্বের জন্য কতটা কী ভাবিয়াছে? ওই নেতৃত্বকে একঘরে ও অপ্রাসঙ্গিক করিয়া পাহাড় ও ডুয়ার্সের ক্ষমতাবিন্যাসে নূতন সমীকরণ রচনার বামপন্থী অপকৌশল এই সরকার অবলম্বন করিবে না, ইহা আশা করা যায়। উত্তরবঙ্গের জন্য পৃথক প্রশাসনিক সচিবালয়, বর্ধিত তহবিল ও অতিরিক্ত বিকেন্দ্রীভূত ক্ষমতার যে প্রতিশ্রুতি মমতা দিয়াছেন, তাহাও এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য। রাজ্যবাসী সেই সম্ভাবনাময় আগামীর দিকে চাহিয়া রহিয়াছে। |