মমতার আমলে প্রতিকার পাবেন, আশাবাদী ভারতী
ড়াইয়ের দু’টি মুখ যেন। এক জন রাজনৈতিক নেত্রী। অন্য জন ‘প্রাক্তন’ সরকারি কর্মী।
প্রথম জনকে মহাকরণের অলিন্দ থেকে ধাক্কা দিয়ে বার করে দেওয়া হয়েছিল ১৯৯৩-এর জানুয়ারিতে। তাঁর নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দ্বিতীয় জন ভারতী শর্মা তখন অর্থ দফতরের অ্যাকাউন্টস বিভাগের আপার ডিভিশন অ্যাসিস্ট্যান্ট। দিনের পর দিন যিনি দফতরের সামনে ‘সত্যাগ্রহ’ চালিয়ে গিয়েছিলেন ১৯৯২-এর মার্চ থেকে ১৯৯৫-এর জানুয়ারি পর্যন্ত।
আজ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে বসেছেন। ভারতী দেবীর দুর্দশা কিন্তু এখনও ঘোচেনি।
গত ১৬ বছর ধরে মণীন্দ্র রোডের সরকারি আবাসনের চার তলার ছোট্ট ফ্ল্যাটে কার্যত বন্দিদশা কাটাচ্ছেন। পেনশন পাননি। পাননি বাকি পাওনাগণ্ডাও। মঙ্গলবার দুপুরে সেই ফ্ল্যাটে বসেই ভারতী দেবীর প্রশ্ন, তাঁর সঙ্গে যে ‘চূড়ান্ত অবিচার’ হয়েছে, তার প্রতিকার কি এ বার হবে?
বামফ্রন্টের আমলে ‘বঞ্চনার শিকার’ ভারতী শর্মা। নিজস্ব চিত্র

১৯৬৫ সালে প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেনের আমলে মহাকরণে অর্থ দফতরের অ্যাকাউন্টস বিভাগে চাকরিতে ঢুকেছিলেন ভারতী। বাবা ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পর ভারতীকে ডিঙিয়ে তাঁর চেয়ে জুনিয়র কর্মীদের পদোন্নতি দেওয়া শুরু হয়। সেই নিয়ে টানাপোড়েন চরমে পৌঁছয় ১৯৮৬-তে। দফতর থেকে তাঁর বসার চেয়ার, টেবিল সরিয়ে দেওয়া হয়। তাঁকে কোনও কাজ দেওয়া হত না। কাজ না করে বেতন নেওয়ার ব্যাপারে তাঁর আপত্তির কথা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বারবার জানিয়েও লাভ হয়নি। ১৯৯২-এর মার্চ থেকে ভারতী মহাকরণের বারান্দায় অবস্থান-সত্যাগ্রহ শুরু করেন। ভারতী দেবীর মতে, তাতে কোনও শৃঙ্খলাভঙ্গ হয়নি। কারণ, পুরোদস্তুর সরকারি কর্মী হওয়া সত্ত্বেও তাঁর বসার জায়গা দেয়নি সরকার।
ভারতী দেবীর ‘অপরাধ’? তাঁর নিজের কথায়, ‘মহাকরণের তৎকালীন দোর্দণ্ডপ্রতাপ বামপন্থী সরকারি কর্মচারী সংগঠনের কথা মতো না চলা, সংগঠনে চাঁদা না দেওয়া এবং বামপন্থীদের ডাকা একের পর এক ‘সর্বাত্মক’ বন্ধের দিনগুলিতে নিয়ম করে মহাকরণে হাজিরা দিতে যাওয়া।’ ১৯৯২-এর মার্চ থেকে ১৯৯৫-এর জানুয়ারি পর্যন্ত মহাকরণের বারান্দায় অর্থ দফতরের পদস্থ আধিকারিকের কার্যালয়ের সামনে বসে টানা অহিংস ‘সত্যাগ্রহ’ চালিয়েছিলেন ভারতী। মাইনে বন্ধ হয়ে যায় ১৯৯৩-এর শুরুতেই। যজমান স্বামীর সংসারে দুই ছেলেকে নিয়ে বছরের পর বছর অনাহারে, অর্ধাহারে দিন কাটিয়েছেন। তখন মহাকরণের সেন্ট্রাল গেটের সামনে থেকে প্রতিদিন তাঁকে চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে যেতেন মহিলা পুলিশেরা। ভ্যানে তুলে প্রথমে লালবাজার, তার পর হেয়ার স্ট্রিট থানা ঘুরিয়ে অনেক রাতে তাঁকে ছাড়া হত। দীর্ঘদিন মাইনে না পেয়ে সপরিবার অভুক্ত ভারতী শর্মা তাঁর লড়াই ১৯৯৫-এর জানুয়ারির পরে আর মহাকরণ পর্যন্ত গিয়ে চালাতে পারেননি। সুবিচারও মেলেনি।
মানসিক যন্ত্রণার চরমে পৌঁছনো ভারতী দেবীর আক্ষেপ, তাঁকে সুষ্ঠু ভাবে চাকরি করতে দেওয়া হলে এত দিনে তিনি উপসচিব হিসেবে অবসর নিতেন। প্রয়াত স্বামীর চিকিৎসা করাতে গিয়ে দেশের বাড়ির গ্রামে গিয়ে আর্থিক সাহায্য চাইতে হত না। মেধাবী ছোট ছেলে আবুকে উচ্চ মাধ্যমিকের পর পড়াশোনা ছেড়ে দিতে হত না। অনেক লড়াই করে বড় ছেলে প্রতাপ এখন নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে সংসারের হাল সামলাচ্ছে।
মহাকরণে গিয়ে নতুন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করবেন? ভারতীর জবাব, ‘‘না, আমি কারও দয়া চাইব না। তবে মুখ্যমন্ত্রী চাইলে আমি নিশ্চয় তাঁর সঙ্গে দেখা করব। তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এত বড় অবিচারের প্রতিকার মুখ্যমন্ত্রী করবেন।” ভারতী দেবী ভুলে যাননি, শ্রমিক-কর্মীদের স্বার্থরক্ষাকারী আইনগুলি সম্পর্কে জানতে এক সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেই আইএনটিইউসি কার্যালয়ে ‘ক্লাস’ করতেন। তার পর কখনও সখনও সেখান থেকে মমতা তাঁদের নিয়ে যেতেন কালীঘাটের বাড়িতে। ‘মাসিমা’ তাঁর ‘মেয়ের বন্ধু’দের যে ভাবে নিজের হাতে টিফিন করে খাওয়াতেন, সে কথা বলতে বলতে শত হতাশার মধ্যেও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে ভারতী শর্মার মুখ!

Previous Story Calcutta Next Story




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.