|
||||
গাঁধীজির জন্মস্থানে সর্বধর্ম সমন্বয়ের ‘কীর্তি মন্দির’ | ||||
কল্পিতা চক্রবর্তী | ||||
পোরবন্দর এসে পৌঁছনোর পর থেকেই গাঁধীজির জন্মস্থান দেখার ইচ্ছেটা কেমন জাঁকিয়ে বসছিল। যে রাস্তায় গাঁধী পরিবারের সেই বিখ্যাত বাড়ি, সেখানে গাড়ি নিয়ে ঢোকা বা বেরোনো খুবই মুশকিল। তা ছাড়া, ‘নো এন্ট্রি’র নিষেধাজ্ঞা রয়েছে দু’দিকেই। তাই ঝক্কি এড়াতে, এক রবিবার বন্ধুর বাইক ধার করে দেখতে চলে গেলাম গুজরাতের পোরবন্দরের বিশ্বখ্যাত সেই বাড়ি। সংকীর্ণ রাস্তা আর দু’পাশে প্রচুর দোকান। মোড় থেকে ডান দিকে তাকালেই দেখা যায় হলুদ খয়েরি রঙে সাজানো বাড়িটা। গেট দেখে ভাবলাম, পুরনো বাড়ির সংস্কার করে এমন নতুন করে বানানো হয়েছে। জুতো খুলে ভিতরে গিয়ে দেখি সামনের সাজানো বাড়িটা স্মারকসৌধ ‘কীর্তি মন্দির’ আর পাশের সাদা সবুজ বাড়িটা আসল ‘জন্মস্থল’। ১৮৬৯ সালের ২ অক্টোবর এখানেই জন্মেছিলেন ‘জাতির জনক’। তাঁর জন্মস্থান চিহ্নিত করা আছে ‘স্বস্তিকা’ চিহ্ন দিয়ে। সেখানে রোজ বাগানের ফুল রাখা হয়। গাঁধীজি তাঁকে ভগবান বানাতে নিষেধ করেছিলেন বলে তাঁর কোনও ছবিতে মালা দেওয়া হয় না। ফোটো তোলা যায়, তবে ভিডিও নয়, স্থিরচিত্র। বাড়ির বাইরে মালিকের নাম এবং কার কাছ থেকে কেনা হয়েছে, সে সংক্রান্ত একটি বোর্ড লাগানো আছে। আগা খান প্যালেস থেকে ১৯৪৪ সালে ব্রিটিশ সরকার শেষ বারের মতো ছেড়ে দিল গাঁধীজিকে। সে সময়েই পোরবন্দরের মানুষজন তাঁর জন্মস্থলে একটি স্মারকসৌধ নির্মাণের পরিকল্পনা করলেন। এ ব্যাপারে যথেষ্ট উদ্যোগী হয়েছিলেন, পোরবন্দরের মহারাজা মহারানা নটোবর সিংহজি এবং রাজরত্ম শ্রীনানজিভাই কালিদাস মেহতা ও তাঁর স্ত্রী সন্তোকবেন মেহতা। মহাত্মার প্রপিতামহ হরজীবন রাইদাস গাঁধী মুন্নিবেন বলে স্থানীয় এক মহিলার কাছ থেকে প্রায় ২০০ বছরের আগে বাড়িটি কিনেছিলেন। স্মারকসৌধের জন্য সেই বাড়িটিই ফের নানজিভাই গাঁধীজির পরিবারের তখনকার সদস্যদের কাছ থেকে কিনে নিয়েছিলেন। সপ্তদশ শতকে হরজীবন রাইদাস গাঁধী যখন এটি কিনেছিলেন, তখন বাড়িটি ছিল এক তলা। মহাত্মার ঠাকুরদাদা এটিকে দোতলা আর বাবা তিন তলা পর্যন্ত বর্ধিত করেছিলেন। তবে, এত বড় বাড়ি ১৬০ বছর আগে তাঁদের পক্ষে করা সম্ভব হয়েছিল, কারণ, গাঁধীজির ঠাকুরদাদা উত্তমচন্দ, কাকা তুলসীদাস এবং বাবা কর্মচন্দ ছিলেন পোরবন্দর রাজার মুখ্যমন্ত্রী বা দেওয়ান। আইনি পদক্ষেপ হিসেবে, মহাত্মা গাঁধী নিজের হাতে দলিলে স্বাক্ষর করে নানজিভাইকে এই স্মারকসৌধ নির্মাণের অনুমতি দিয়েছিলেন। সেই দলিলও আছে কীর্তি মন্দিরের মিউজিয়ামে। গাঁধীজির ৭৯ বছরের জীবনকালের সঙ্গে মিলিয়ে বাড়িটির উচ্চতা ৭৯ ফুট। সেটি বানানো হয় সর্বধর্ম সমন্বয়ের স্থান হিসেবে। সেখানে ছ’টি ধর্ম হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন ও পারসিদের মন্দির এবং গির্জা ও মসজিদের স্থাপত্যশৈলীর প্রভাব আছে। ঢোকার মুখে সদ্য বিবাহিত গাঁধীজি আর কস্তুরবার বিশাল পেইন্টিং। সংস্কার আর মেমোরিয়াল বানাবার পর ১৯৫০ থেকে বাড়িটির নাম হয় কীর্তি মন্দির। এখন এটা জাতীয় মনুমেন্ট। প্রতিদিন সকাল সাড়ে সাতটা থেকে একটা আর বিকেল দু’টো থেকে সন্ধে সাতটা অবধি খোলা থাকে। পুরো বাড়ি দেখাবার জন্য গাইড থাকেন, গাইডের কোনও খরচা নেই। সব তথ্য পাওয়া যায় এঁদের কাছে। প্রথম তলায় রান্নাঘর আর পুজোর ঘর, উপরে যাওয়ার সিঁড়ি খুব সংকীর্ণ এবং কাঠের তৈরি। ১৬০ বছরের পুরনো হলেও উঠতে তাতে অসুবিধা হয় না। প্রথম তলায় গাঁধীজির বাবার একা ছবি আছে। পুরো বাড়িতে পাথরের মোমদানি আছে ৭৯টি। তখন এ ভাবেই অন্ধকার দূর হত। এটিও গাঁধীজির জীবদ্দশার সঙ্গে মিলিয়ে করা হয়েছে। কীর্তি মন্দির বানানোর ভাবনা শুরু হয় ১৯৪৪ সালে। তবে তার প্রথম কাজ শুরু হয় ১৯৪৭-এ গাঁধীজির জীবদ্দশায়। তত্ত্বাবধানে ছিলেন দরবার গোপালদাস দেশাই। এই নির্মাণের প্রধান আর্কিটেক্ট ছিলেন পোরবন্দরেরই পুরুষোত্তমভাই মিস্ত্রি। তবে কীর্তি মন্দির নির্মাণের পুরো কৃতিত্বই কিন্তু ব্যবসায়ী নানজিভাই মেহতার। তিনি শুধু এই পরিকল্পনার উদ্ভাবকই নন, বাড়ি কেনার পুরো টাকাও দিয়েছিলেন। এমনকী কীর্তি মন্দির নামক নতুন ভবন নির্মাণেও তাঁর অর্থনৈতিক অবদান যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এই সৌধের কাজ শেষ হয় গাঁধীজির মৃত্যুর দু’বছর পর। ১৯৫০ সালের ২৭ মে বাড়িটির উদ্বোধন করেন স্বাধীন ভারতের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সদ্দার বল্লভভাই পটেল। পরে সুদৃশ্য এই স্মারক সৌধটি ভারত সরকারের হাতে তুলে দেওয়া হয়। |
||||
|
||||
|
||||
ছবি: লেখক |
||||
রোজের আনন্দবাজার • এ বারের সংখ্যা • পুরনো সংস্করণ | ||||