এ যাবৎ দাম বলতে বোঝাতো শুধু বিদ্যুৎ মাসুল। অর্থাৎ এনার্জি চার্জ। এ বার তাতে যোগ হবে স্থায়ী মাসুল, মানে ফিক্সড চার্জ। সিইএসসি-কে বিক্রি করা বণ্টন সংস্থার বিদ্যুতের দামের সঙ্গে এই নতুন মাসুল আদায় করতে চাইছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার।
নবান্ন-সূত্রের খবর: সরকারের এই সিদ্ধান্তে রাজ্য বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ কমিশন সিলমোহর দিলে নয়া ব্যবস্থা চালু হয়ে যাবে। এতে রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থার ঘরে অতিরিক্ত প্রায় দু’শো কোটি টাকা আসবে। যদিও এর জেরে সিইএসসি-র গ্রাহকদের উপরে বাড়তি খরচের বোঝা চাপার আশঙ্কাও রয়েছে।
এ হেন পরিকল্পনার কথা কথা শুনে বিদ্যুৎ-শিল্পমহলের অন্দরে প্রশ্নও উঠেছে। একটি মহলের বক্তব্য: বণ্টন-এলাকায় বিদ্যুৎ-মাসুল ছাঁটাইয়ের কথা বিধানসভায় ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অথচ তাঁরই সরকার যদি সিইএসসি’র উপরে এ ভাবে আলাদা মাসুলের ভার চাপিয়ে দেয়, তা হলে পরিণামে কলকাতা-হাওড়াবাসীর বিদ্যুৎ-বিল চড়বে। এতে দুই সংস্থার গ্রাহকদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টির একটা আশঙ্কা থাকছে বলে এই অংশের অভিমত। প্রসঙ্গত, বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী জানান, বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে ব্যয় কমিয়ে সরকার আগামী অর্থবর্ষে অন্তত দেড় হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করতে চায়। আর তারই সুবিধা দেওয়া হবে বণ্টন-গ্রাহকদের, মাসুল-হার হ্রাসের মাধ্যমে।
এবং সরকারি সূত্রের খবর: স্থায়ী মাসুলের সুবাদে সিইএসসি-কে বিদ্যুৎ বিক্রি খাতে অতিরিক্ত যে দেড়শো-দু’শো কোটি টাকা আদায়ের পরিকল্পনা, তাকে পরিকল্পিত ‘সাশ্রয়ের’ ওই দেড় হাজার কোটিরই অংশ হিসেবে ধরা হচ্ছে। সিইএসসি নিজের চাহিদা মেটাতে বছরভর বণ্টন সংস্থা থেকে বিদ্যুৎ কেনে, যার পরিমাণ বছরে ৬০০-৭০০ মেগাওয়াট। এ যাবৎ তার দাম হিসেবে শুধু বিদ্যুৎ মাসুল বা এনার্জি চার্জ নেওয়া হতো। হঠাৎ তাতে ফিক্সড চার্জ জোড়ার কারণ কী? স্থায়ী মাসুল ব্যাপারটাই বা কী?
বিদ্যুৎ-কর্তাদের ব্যাখ্যা: বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য সারা বছর তেল-জল-কয়লা ও অন্যান্য পরিকাঠামো মজুত রাখতে হয়। এর পিছনে একটা স্থায়ী খরচ আছে। এত দিন এ বাবদ আলাদা ভাবে টাকা আদায় করা হতো না। এখন হবে। স্থায়ী মাসুল হিসেবেই সেটা নেওয়া হবে। বিদ্যুৎ-কর্তাদের বক্তব্য: বিদ্যুৎ বিক্রির চুক্তি থাকলে এনার্জি চার্জ ও ফিক্সড চার্জ জুড়ে দাম আদায়ের রীতি বর্তমানে চালু আছে। এ ক্ষেত্রেও দাম ধরা হয় প্রতি ইউনিট হিসেবে। বস্তুত বণ্টন কোম্পানি নিজে যখন পশ্চিমবঙ্গ বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগম বা এনটিপিসি-র কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনে, তখন তারাও এ ভাবে দাম চুকিয়ে থাকে। “তা হলে সিইএসসি দেবে না কেন?” প্রশ্ন বিদ্যুৎ দফতরের এক কর্তার। রাজ্যের বিদ্যুৎ-সচিব গোপালকৃষ্ণ বুধবার বলেন, “অন্যান্য গ্রাহকদের থেকেও ফিক্সড চার্জ আমরা আদায় করে থাকি। তাই সিইএসসি’র কাছ থেকেও নিতে অসুবিধে নেই।”
সিইএসসি’র বক্তব্য কী?
সিইএসসি-কর্তৃপক্ষ এ প্রসঙ্গে সরাসরি কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে তাঁদের একাংশের বক্তব্য: স্থায়ী মাসুল দিতে হলে সাধারণ নিয়মেই সংস্থার অতিরিক্ত খরচ হতে পারে। আবার সেই টাকাটা গ্রাহকদের উপরে বাড়তি কিছু মাসুল চাপিয়ে তুলেও নেওয়া যেতে পারে। অর্থাৎ, ইউনিটপিছু বিদ্যুতের দাম কিছুটা বাড়িয়ে অতিরিক্ত ব্যয় মেটানোর রাস্তা খোলা থাকছে। সিইএসসি’র একটি মহলের মতে, আগামী অর্থবর্ষে সংস্থার হলদিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ কলকাতায় আনা শুরু হলে সিইএসসি-র মাসুল এক লাফে বেশ খানিকটা বেড়ে যাওয়ার কথা (কারণ, নতুন তাপ-বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিদ্যুতের দাম গোড়ায় একটু বেশিই হয়)। পাশাপাশি বণ্টনের বিদ্যুৎ-দরে স্থায়ী মাসুল আরোপের সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে সিইএসসি’র গ্রাহকদের আর্থিক বোঝাবৃদ্ধির আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
তবে স্থায়ী মাসুলের ভার কিছুটা লাঘবের পথও রয়েছে সিইএসসি’র সামনে। কী রকম?
বিদ্যুৎ-শিল্পে বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ জানাচ্ছেন, বাজার (এ ক্ষেত্রে জাতীয় গ্রিড) থেকে বিদ্যুৎ কেনা এখন অনেক সহজ। দর-দাম করলে সস্তাতেও মেলে। নতুন নিয়মে যদি দেখা যায় বণ্টনের বিদ্যুৎ কিনতে খরচ অনেকটা বেশি পড়ে যাচ্ছে, সে ক্ষেত্রে জাতীয় গ্রিড থেকে স্বল্পমেয়াদি সময়ের জন্য বিদ্যুৎ কিনতে পারে সিইএসসি।
অর্থাৎ, তেমন পরিস্থিতিতে রাজ্যের বিদ্যুৎ তুলনায় কম পরিমাণে কিনে কলকাতা-হাওড়ায় ইউনিটপিছু গড় মাসুল নিয়ন্ত্রণে রাখাটা সিইএসসি’র পক্ষে একেবারে অসম্ভব নয় বলে মনে করছেন ওঁরা। |