|
একুশের গান |
সীমান্তে ক্যামেরা |
এ পার বাংলা, ওপার বাংলা, মধ্যে কাঁটাতার... ওপারে ফেলে আসা ভিটে, স্বজন, স্মৃতিমাখা কপোতাক্ষ, মধুমতী কী শঙ্খ নদীর ঘাট। বছরভর তাকিয়ে থাকা একুশের দিকে। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি...’। সালাম, জব্বার, বরকত, রফিকের রক্তে রাঙা ফেব্রুয়ারির এই দিনটি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। কিন্তু বনগাঁর মানুষের কাছে দিনটির আলাদা তাৎপর্য। এই দিনেই যে উদার হয়ে যান চোয়াল-শক্ত সীমান্তরক্ষীর দল। কিছু ক্ষণের জন্য হলেও উঠে যায় কড়াকড়ি। সীমান্ত টপকে মিশে যায় দু’পারের হাসিকান্না। কাঁটাতারের বেড়ার দু’পাশে হাজির হয়ে যান মানুষ। আগল তুলে নেওয়া মাত্র একে অপরকে জড়িয়ে ধরা। এ বার কিন্তু আগাম ঘোষণা ছিল, বেড়া ঘুচবে না। নিরাপত্তা বড় বালাই। ওপারে পুলিশের তাড়া খেয়ে গা-ঢাকা দিয়ে রয়েছে যে সব জঙ্গি-দুষ্কৃতী, গোয়েন্দারা খবর পেয়েছেন তারাও নাকি তাকিয়ে রয়েছে একুশের দিকেই। |
|
পেট্রাপোল সীমান্ত স্টেশনে গান গাইছেন প্রতুল মুখোপাধ্যায়। |
এক বার সীমান্তের বাধা ঘুচলেই তারা মিশে যাবে এ পারের জনারণ্যে। তবুও ভিড় কি কম ছিল? না। বারাসত বা মধ্যমগ্রামে বসত করা সমীর, কমল, সীমার সঙ্গে ফোনের যোগসাজসে ওপারে যথারীতি হাজির সাতক্ষীরার সেলিমভাই, খুলনার ফুলতলার আবুল বা যশোরের অনুপকুমার দাস। বেড়া না-তুললেও সকলকে তারের ধার পর্যন্ত যেতে দিয়েছিলেন রক্ষীরা। তা-ই বা কম কিসের? হাতে-হাতে স্পর্শ নেওয়া, দুটো প্রাণের কথা বলা। আর এই সবই ক্যামেরায় ধরে রাখলেন তনভির মোকাম্মেল। এর আগে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁর তথ্যচিত্র ‘৭১’ নজর কেড়েছে। দেশভাগের শিকার মানুষগুলোর আবেগ এ বার তথ্যচিত্রে ধরে রাখতে চান বাংলাদেশের এই চলচ্চিত্রকার। এখনও বহু কাজ বাকি। তবু পেট্রাপোল সীমান্ত স্টেশনে গায়ক প্রতুল মুখোপাধ্যায় ও লেখক অমর মিত্রকে হাজির করে তাঁদের কথা-গান চলচ্ছবিতে ধরে রাখল তনভির সাহেবের ইউনিট। কাজ একটু এগিয়ে রাখা। |
জেলার পথে |
অযোধ্যা পাহাড়ের সবচেয়ে উঁচু শৃঙ্গের নাম কী? ভূগোলের পাঠ্যবই বলবে, গোর্গাবুরু। কিন্তু বইয়ের খবরে এতটুকু বিশ্বাস নেই রত্না ভট্টাচার্য আর শক্তিপদ ভট্টাচার্যের। পথ চলেই বাংলাকে জানতে চান তাঁরা। সেই চাওয়া থেকেই দম্পতি খুঁজে বের করলেন নতুন তথ্য সবচেয়ে উঁচু শৃঙ্গটার নাম গোর্গাবুরু নয়, চামতু। সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার ম্যাপের সঙ্গে মেলালেন। তার পরে লিখলেন পায়ে পায়ে পুরুলিয়া বইয়ে। সারা বছর ধরেই ওঁরা বারবার ঘোরেন একটি জেলায়। পরে সেই জেলা নিয়ে একটি বই। বেরিয়েছে জেলা পরিচয় গ্রন্থমালার হুগলি, হাওড়া, বীরভূম, পুরুলিয়া এবং এ বছর নদিয়া। সব ক’টিরই প্রকাশক ‘পরশপাথর’। ট্যুরিস্ট স্পটের ইতিহাস-ভূগোলের আঁতিপাতি তো আছেই, লজ-হোটেলের সন্ধানের সঙ্গে রয়েছে অল্পপরিচিত সরকারি ব্যবস্থারও হদিস। শক্তিপদবাবু জানালেন, এখন কাজ চলছে বাঁকুড়া নিয়ে। |
মঞ্চে ও বাইরে |
|
নাটক দেখতে চাইলে টিকিট কেটে প্রেক্ষাগৃহে গেলেই হয়। তার জন্য নাট্যোৎসব বা নাট্যমেলার প্রয়োজন হয় না। উৎসব বা মেলা শব্দের মধ্যে আনন্দের যে বাড়তি আয়োজন থাকে, তাতে নাট্যাভিনয়ের সঙ্গে জুড়ে যায় তর্ক, আলোচনা, কর্মশালা, প্রদর্শনী। সব মিলিয়ে যাকে বলা চলে ‘নাট্যচর্চা’। গত আঠারো বছর ধরে চন্দননগরের যুগের যাত্রী তাদের নাট্যমেলায় এই চর্চাটাই চালিয়ে এসেছে। নাট্যব্যক্তিত্বদের দিয়ে কর্মশালা যেমন করাা হয়েছে, আয়োজন হয়েছে প্রদর্শনীরও। এ বারের প্রদর্শনীর বিষয় এই নাট্যমেলারই গত এক দশকের নানা মুহূর্ত। আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ২ মার্চ শহরের রবীন্দ্রভবনে মঞস্থ হবে সাতটি নাটক। হুগলিরই ব্যান্ডেল বা বাঁশবেড়িয়ার পাশাপাশি উত্তর ২৪ পরগনার গোবরডাঙা বা জলপাইগুড়ি থেকে নাট্যদল আসছে। |
প্রবীণে নবীনে |
দুঃস্থ বয়স্ক শিল্পী আর অযত্নে পড়ে থাকা নবীন প্রতিভা। দুইয়েরই পরিচর্যার দায়িত্ব নিতে ২০০৮-এর ডিসেম্বরে হাওড়ার বাগনানে শিল্পী ও শিল্পানুরাগীরা মিলে গড়ে তুলেছিলেন ‘সম সংহতি।’ যার মূল কাজ প্রবীণ গুণী মানুষদের সংবর্ধিত করা, অসহায় রোগাক্রান্ত দুঃস্থ শিল্পীর পাশে দাঁড়ানো এবং সম্ভাবনাময় নবীনদের উপযুক্ত মঞ্চে আনা। সংগঠনের ব্যাপ্তি হাওড়া, পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা জুড়ে। তিন জেলা থেকে কাজ করতে চেয়ে নাম নথিভুক্ত করেছেন প্রায় দেড়শো জন। ফি শুক্রবার সভা বসে। যাত্রা অভিনেত্রী থেকে সাহিত্যিক, নট থেকে গায়ক বা কারুশিল্পী সংবর্ধনা পেয়েছেন অনেকেই। অসহায় ও অসুস্থ শিল্পীদের আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। |
কেয়াবাত কাশিমবাজার |
কিছু ট্রেনে আগেই ছিল। এ বার ‘বায়ো টয়লেট’ বসল মুর্শিদাবাদের কাশিমবাজার স্টেশনে। দেশে প্রথম। মাটির তলায় শতাধিক লিটার জল ধরে এমন কড়াইয়ে রয়েছে বিশেষ এক ব্যাক্টেরিয়া। যার কাজ বর্জ্যকে পরিচ্ছন্ন জল বা গ্যাসে রূপান্তরিত করা। দুর্গন্ধ গায়েব। এক বার বসালে বছর তিরিশ খরচ নেই বললেই চলে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রক ও রেলের এই যৌথ আবিষ্কারের উদ্বোধন করে রেল প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরী বলেন, “৪০০টি কোচে এ রকম শৌচালয় রয়েছে। স্টেশনে এই প্রথম।” |
হাজার চাঁদ |
জন্মাবধি হাজার পূর্ণচন্দ্র দেখার সৌভাগ্য ক’জনের হয়? যাঁদের হয়, সেই সব অশীতিপর মানুষই বা কতটা স্বচ্ছন্দ বোধ করেন দ্রুত পাল্টে যেতে থাকা সমাজ-সংসারে? এই ভাবনা থেকেই ২০০৯-এ সিউড়িতে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ‘শ্রদ্ধা’ নামে এক সংস্থার। যাদের একটাই কাজ, বীরভূমের কেউ হাজার পূর্ণচন্দ্র অতিক্রম করলে তাঁকে সংবর্ধনা জানানো। আসলে বার্তা দেওয়া যে জীবনসায়াহ্নে তিনি নিঃসঙ্গ, বিস্মৃত, অবহেলিত নন। সহ-নাগরিকেরা তাঁর পাশেই আছেন। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি সিউড়ির ৮৬ বছরের রাধারানি মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে গিয়ে তাঁকে সংবর্ধনা দিয়েছেন সংস্থার সদস্যেরা। তালিকায় তিনি ৪৬তম। সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা লক্ষ্মণ বিষ্ণু জানান, গুজরাত ও রাজস্থানে পারিবারিক ভাবে এই প্রথা চালু আছে। সেটাই ছিল প্রাথমিক প্রেরণা। |
ফের খৈয়াম |
ধুলোর আড়ালেই পড়ে ছিল বইটা। পকেটবুক সাইজের অক্টাভো সংস্করণ। সিপিয়া রঙে অকল্পনীয় সূক্ষ্ম সব ছবিতে সাজানো। তাক থেকে নামিয়ে ধুলো ঝেড়ে এডওয়ার্ড মার্লবরো ফিটজারেল্ড অনূদিত ‘রুবাইয়াত অফ ওমর খৈয়াম’ থেকে সেই সব কাব্যপঙ্ক্তি বাংলায় তর্জমা করেছেন রামরাজাতলার অমিতাভ ভট্টাচার্য। রুবাইয়ের সঙ্গে বাঙালির পরিচয় ইতিপূর্বেই করিয়ে দিয়েছেন কান্তিচন্দ্র ঘোষ এবং নরেন্দ্র দেব। কাজী নজরুল ইসলাম-কৃত তর্জমার সঙ্গেও পাঠকের যৎকিঞ্চিৎ আলাপ রয়েছে। আবার কেন? অমিতাভর কথায়, ‘স্পর্ধায় নয়, একান্ত ভালবাসার তাগিদেই।’ রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম নামে সেই ইরানি ভালবাসা সদ্য শেষ হওয়া কলকাতা বইমেলায় মাটিতে পা রেখেছে। |
অক্ষরশহরে হরফ |
|
শ্রীরামপুরের আর এক নাম ‘অক্ষরশহর’। কেরিসাহেব আর পঞ্চানন কর্মকারের উদ্যোগে প্রথম বাংলা হরফ তৈরি হয়েছিল হুগলির এই মফস্সল শহরে। ১৮০০ সালের গোড়ায় বাঙালি হাতে পেয়েছিল মিশন প্রেস থেকে ছাপা প্রথম বাংলা বই। শ্রীরামপুরের প্রথম আর্ট গ্যালারির নাম ‘হরফ’ দেওয়ার সময়ে সম্ভবত এই ইতিহাসটাই মনে ছিল উদ্যোক্তাদের। কলকাতা ও ভারতের নামজাদা চিত্রকরদের ছবি প্রদর্শনের পাশাপাশি স্থানীয় তরুণদের নিয়ে করা হচ্ছে কর্মশালা। শিল্প-সাহিত্য-চারুকলা নিয়ে আড্ডা বসছে। গঙ্গাপাড়ের প্রাচীন এই শহরটির পরিবেশ ও স্থাপত্য সংরক্ষণের জন্য ডেনমার্কের জাতীয় মিউজিয়ামের সহায়তায় ‘শ্রী’ (শ্রীরামপুর হেরিটেজ রেস্টোরেশন ইনিশিয়েটিভ) নামে যে নাগরিক সংগঠন গড়ে উঠেছে, তারও মূল কর্মস্থল এই গ্যালারিই। ঠিকানাটা পঞ্চানন কর্মকারের বাড়ির ঠিক পাশেই। ইতিহাসের রসিকতা? |
ঝাড়গ্রাম-২ |
|
উন্নত মানের কাজু বাদামের চারা তৈরি করেছে নদিয়ার মোহনপুরের বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। সেই চারা বসানো হয়েছে পশ্চিম মেদিনীপুরের ঝাড়গ্রামে আঞ্চলিক গবেষণা কেন্দ্রে। নাম দেওয়া হয়েছে ‘ঝাড়গ্রাম-২’। কাজু নিয়ে গবেষণার জন্য দেশে যে প্রায় ১৪টি কেন্দ্র রয়েছে, লাল ও কাঁকুড়ে মাটির কারণে ঝাড়গ্রাম তার অন্যতম। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রী, উদ্যানবিদ মিনি পদুওয়াল বছর তেরো হল সেখানে গবেষক হিসাবে কাজ করছেন। তিনি জানান, এমনিতে একটি গাছে বছরে ৭-১০ কেজি কাজু পাওয়া যায়। প্রতিটি কাজুর ওজন ৩-৪ গ্রাম। নতুন চারা থেকে বছরে প্রায় ১৩ কেজির ফলন পাওয়া যাবে। ওজন হবে ৮-৯ গ্রাম করে। উপাচার্য চিত্তরঞ্জন কোলে বলেন, “ঝাড়গ্রাম-২ চাষের সাফল্য পশ্চিমাঞ্চলের আর্থিক বিকাশ ত্বরান্বিত করবে।” |
শুধু সুন্দরবন |
‘রাতে খাবার পর জ্যোৎস্না-পক্ষ হলে নদীর পাড়ে গিয়ে বসে থাকতাম। চারদিক নিস্তব্ধ নিস্তরঙ্গ। মনে হত এই নদী, এই জ্যোৎস্নাস্নাত প্রকৃতি আমাকে দান করে সূর্য বিদায় নিয়েছে।’ প্রায় অর্ধশতক সুন্দরবনের মানুষদের সঙ্গে কাজ করেছেন তুষার কাঞ্জিলাল। তাঁর আত্মকথা এখন ধারাবাহিক ভাবে বেরোচ্ছে ‘শুধু সুন্দরবন চর্চা’ পত্রিকায়। জ্যোতিরিন্দ্র লাহিড়ীর সম্পাদনায়, হুগলির গুড়াপ থেকে। সাম্প্রতিক একটি সংখ্যায় রয়েছে গত তিনটি জনগণনা থেকে প্রাপ্ত সুন্দরবনের বিভিন্ন ব্লকের নানা তথ্য। গোসাবার ইতিহাস লিখছেন কানাইলাল সরকার। ‘গোসাবা’ নামকরণ নিয়ে প্রচলিত নানা মতের উল্লেখ করেছেন কানাইবাবু। যার একটি, সাপ (সা) আর বাঘ(বা) থেকে গরু (গো) রক্ষা করার তাগিদে তিনটির আদ্যাক্ষর জুড়ে দিয়েছিলেন স্থানীয় মানুষরা। |
মাটির নাটক |
উচ্চতা মেরে-কেটে সাড়ে পাঁচ ফুট। রোগা পাতলা চেহারা। নিজে বেড়ে উঠেছেন বীরভূমের দ্বারন্দায় সাঁওতাল পল্লিতে। তাই আদিবাসী না হলেও আদিবাসী সংস্কৃতি ঢুকে পড়েছে তাঁর রক্তে। তা তিনি ছাড়তেও চাননি, বরং আরও আত্মীকৃত করেছেন। থিয়েটার নিয়ে পড়াশুনো বিশ্বভারতীর কলাভবনে। পরে রবীন্দ্রভারতীতে পড়ার সময় যোগাযোগ তৈরি হয় ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামার (এনএসডি) সঙ্গেও। গুরু মানেন রতন থিয়ামকে। গত পাঁচ বছর ধরে তাঁরই কাছে শিখছেন নানা প্রকরণ। কিন্তু নিজের জন্য তৈরি করেছেন অপর জগত। “আদিবাসী নাচ-গানের দীর্ঘ ঐতিহ্য থাকলেও নাটক সে ভাবে নেই। সেই নাটকই তৈরি করতে চাইছি” বলছেন পার্থ গুপ্ত। ইলামবাজারের চৌপাহাড়ি জঙ্গলে ৩০টি আদিবাসী গ্রামের ছেলে-মেয়ে, জোয়ান-বুড়োকে থিয়েটারের নেশা ধরিয়ে দিয়েছেন তিনি। আদিবাসীদের নিয়েই গড়ে তুলেছেন বীরভূম ব্লসম্স থিয়েটার। পারিবারিক অর্থে স্থায়ী মঞ্চ গড়েছেন গ্রামে। সেই দ্বারন্দা গ্রামকেই তাদের প্রথম আদিবাসী সংস্কৃতি উৎসব ‘আদি বিম্ব’-র জন্য বেছে নিয়েছিল এনএসডি। রতন থিয়ামের কথায়, “পার্থ এই মাটির ছেলে, এখানকার মানুষের সঙ্গে ওর ভাল সংযোগ।” পার্থর লেখা ও নির্দেশিত আধ ঘণ্টার সাঁওতালি নাটক হাসা ওরা বেরিয়া সেরেঙ্গ (মাটির ঘরের গান) দিয়েই মঙ্গলবার শেষ হল উৎসব। |
|
|
|
|