হেড অফিসে যেতে হবে শুনলেই যেন গায়ে জ্বর আসে গঙ্গাধর দাসের। বছর দুয়েক পরেই বিডিও অফিসের করণিক পদ থেকে অবসর নেবেন তিনি। টানা ২৬ বছর ধরে তাঁর হেড অফিসে যাতায়াত। তবু হেড অফিসের নাম শুনলেই কেন বুকে কাঁপুনি শুরু হয় গঙ্গাধরবাবুর? কারণ তাঁর ব্লক অফিস থেকে হেড অফিস যেতে পাড়ি দিতে হয় প্রায় ২২০ কিলোমিটার পথ। বাস বদল করে শুধুমাত্র যাতায়াতে লেগে যায় ১২ ঘণ্টারও বেশি সময়।
কুমারগ্রাম বিডিও অফিস থেকে নানা বিল, অফিসের কর্মীদের ছুটির মঞ্জুরি সহ নানা কাজ করতে মাসে অন্তত ৬ বার জলপাইগুড়ি জেলা শাসকের দফতরে যেতে হয় গঙ্গাধর দাসের। ভোর পাঁচটায় কুমারগ্রাম থেকে বাস ধরে আলিপুরদুয়ারে পৌঁছতে হয় ৫৮ ছুঁইছুঁই গঙ্গাধরবাবুকে। সেখান থেকে বাস ধরে জলপাইগুড়ি শহর। বাস থেকে নেমে অটো বা রিকশা ধরে জেলাশাসকের অফিসে যখন তিনি পৌঁছোন ততক্ষণে অন্তত ৭ ঘণ্টা কেটে গিয়েছে। ফের দুপুর তিনটেয় আলিপুরদুয়ারের বাস ধরার তাড়া। মাঝের দু’ঘণ্টায় সরকারি কাজ করবেন কখন-ই বা দুপুরের খাবার খাবেন? অফিসেই চা-বিস্কুট খেয়ে বাস ধরে যখন তিনি বাড়ি পৌঁছলেন ততক্ষণে ঘড়ির কাঁটা রাত দশটার আশেপাশে। গঙ্গাধরবাবুর কথায়, “আর মাত্র দু’বছর বাকি আছে। তার পরে অবসর নিলে এই দুর্ভোগ থেকে মুক্তি। যদি আলিপুরদুয়ার পৃথক জেলা হয় তবে পরবর্তী প্রজন্মকে আর আমার মত দুর্ভোগে পড়তে হবে না।”
একই দশা কুমারগ্রামের মদন সিংহ হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক সুশান্ত বাগচীরও। তাঁকেও মাসে অন্তত দু’বার অন্তত জলপাইগুড়িতে জেলা শিক্ষা পরিদর্শকের দফতরে যাতায়াত করতে হয়। সুশান্তবাবুর কথায়, “ছ’ঘণ্টার পথ পেরিয়ে জলপাইগুড়ি পৌঁছে কাজ করে সে দিন বাড়ি ফিরতে পারব কি না তা নিয়ে সংশয়ে থাকি। মাত্র এক দিনের কাজে গিয়ে সেখান থেকে আর ফেরা হয় না। আলিপুরদুয়ার জেলা হলে দু’ঘণ্টার মধ্যে কাজ সারা সম্ভব।” কুমারগ্রাম ব্লকের মতোই আলিপুরদুয়ার মহকুমার বারোবিসা, ভাটিবাড়ি, বীরপাড়া জয়গাঁ, ফালাকাটা সহ গোটা মহকুমার বাসিন্দাদের একই দশা।
সরকারি কর্মীদের মতোই দুর্ভোগে পড়েছেন মূলস্রোতে ফিরে আসা প্রাক্তন কেএলও সদস্যও। প্রাক্তন কেএলও সদস্য ভুপেশ দাস ওরফে কালিয়া ২০১১ সালে জেল থেকে ছাড়া পান। তাঁর নামে বর্তমানে চারটি খুনের মামলা চলছে। তার মধ্যে একটি রয়েছে জলপাইগুড়ি জেলা আদালতে। সেখানে হাজিরা দিতে মাসে দু’বার জলপাইগুড়িতে যেতে হয়। ভূপেশবাবুর কথায়, “যাতায়াতের খরচ পড়ে প্রায় ২০০ টাকা। অর্থাৎ মাসে অন্তত ৪০০ টাকার ধাক্কা। টাকা জোগাড়ের সমস্যা যেমন, তেমনিই যাতায়াতের ধকল।” অফিস-আদালত সহ অনগ্রসর সংশাপত্র পেতেও হয় বাসে নয়ত গাড়ি ভাড়া করে জলপাইগুড়ি শহরে যেতে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে সাধারণ বাসিন্দাদের। পৃথক জেলা হলে এই হয়রানি পোহাতে হত না বলেই তাঁদের দাবি।
আলিপুরদুয়ার কলেজের অবসর প্রাপ্ত শিক্ষক সুধীররঞ্জন ঘোষের কথায়, “আগের সরকার জেলা ঘোষণা নিয়ে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। নতুন সরকার ঘোষণা করায় আশার আলো দেখতে শুরু করি। খোদ মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেন জেলার দাবি পূরণ হবে বলে। অপেক্ষায় আছি।” শহরের বাসিন্দা গৃহবধূ অনিতা বিশ্বাসের কথায়, “কবে থেকে শুনে আসছি আমাদের শহর জেলা শহরের মর্যাদা পাবে বলে। কিন্তু হচ্ছে কোথায়? প্রশাসনিক নানা কাজ সারতে জলপাইগুড়ি যাতায়াত করতে হয়।” আলিপুরদুয়ার অভিভাবক মঞ্চ সম্পাদক ল্যারি বসু বলেন, “আজ হবে, কাল হবে এমনটাই দু’বছর ধরে শুনে আসছি। প্রতিশ্রুতি আর আশ্বাস ছাড়া কিছু বাস্তবে দেখতে পাচ্ছি না।”
২০১১ সালে বিধানসভা ভোটের অব্যবহিত পরেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আলিপুরদুয়ার জেলা হবে বলে ঘোষণা করেন। আলিপুরদুয়ার পুরসভা নির্বাচনেও তৃণমূলের প্রচারের মূল প্রতিশ্রুতি ছিল আলিপুরদুয়ার জেলা গঠন। যদিও আলিপুরদুয়ারের পুরবোর্ড এখনও অধরা থেকে গিয়েছে তৃণমূলের। পৃথক জেলার স্বীকৃতির প্রশাসনিক প্রস্তুতিও থমকে গিয়েছে বলেও অভিযোগ তুলেছেন বাসিন্দাদের একাংশ।
|