নতুন সাজ
ল্যাপটপে বিদেশি সিরিয়াল...
আইপডে জাস্টিন টিম্বারলেক। কিংবা ইও ইও হানি সিং....শপিং মলে উইন্ডো শপিং...মাঝে মাঝে বাংলা ব্যান্ড। বা বড়জোর ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও....’
নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নেওয়া নতুন প্রজন্মকে অনাবিল বিনোদনের মাটিতে নামিয়ে আনতেই এক বছর বন্ধ থাকার পর আবারও ফিরে আসছে এক সময়ে মিনার্ভা রেপার্টরি থিয়েটারের প্রযোজনায় বক্সঅফিস সফল নাটক ‘দেবী সর্পমস্তা’। আলো, পোশাক, সেট, সব নিয়ে রিহার্সাল চলছে অহীন্দ্র মঞ্চে। আর নাচ-গান-বাদ্য তো আছেই।
মঞ্চে দেখা গেল তীক্ষ্ন কাঠামো সাজানো জ্যামিতিক গড়নে। তাতে মাঝে মাঝে রঙের ছোঁয়া। যা আগেও ছিল। কিন্তু এই সব কাঠামোর মধ্যেই এ বার নতুন ধরনের কিছু দৃশ্যবিভঙ্গ যোগ করছেন পরিচালক দেবেশ চট্টোপাধ্যায়। আম দর্শক তো বটেই, নতুন প্রজন্মেরও মন মাতাতে।
দেবেশের মতে মঞ্চসজ্জায়, কাঠামোর ( স্ট্রাকচার) বুদ্ধিদীপ্ত ব্যবহার খুব পছন্দ করে আজকের ছেলেমেয়েরা। আরও বেশি ছন্দোময়, গতিময় করতে প্রথম দৃশ্যের বিখ্যাত সেই গান ‘ও দেবী তোর কেমন পা’র পুরো কোরিওগ্রাফিটাই বদলে গিয়েছে সেই জন্য। এ বার, আগের কোরিওগ্রাফির সঙ্গে উদয়শঙ্কর ঘরানার নাচের সংমিশ্রণ করছেন অমলাশঙ্করের ছাত্রী ও কোরিওগ্রাফার কস্তুরী চট্টোপাধ্যায়। আগে নাটকে ছিল একমাত্র সূত্রধর। এখন অনেকেই কথক। একজন মূল গায়েনের বদলে সব শিল্পীই প্রায় গান গাইছেন এ বার। ‘একটা জমজমাট মিউজিকালের চেহারা দিতে চাইছি আরও বেশি করে,’ বলছেন দেবেশ।
কিন্তু দেবেশের ‘উইঙ্কল টুইঙ্কল’ বা ‘বিকেলে ভোরের সর্ষে ফুল’য়ের মতো নাটকেও তো হাউজফুলের বোর্ড ঝোলে। তা হলে হঠাৎ এই নাটকটার জন্য এত উদ্দীপনা? “কারণ একদম অচেনা শিল্পীদের পারফর্ম্যান্স বা টিম ওয়ার্ক ভাল হলে দর্শক যখন ওদের প্রশংসা করেন আমার আনন্দ হয় স্রষ্টা বা পরিচালক হিসেবে। একটা চ্যালেঞ্জ কাজ করে,” বলছেন দেবেশ।
ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল
লোকনৃত্যের উদ্দাম ফিউশন, ধামসা-মাদলের দ্রিমিদ্রিমি, মঞ্চ জুড়ে রঙিন পোশাকে সাতাশ জন টগবগে তরুণ শিল্পীর দুরন্ত গতিময় শরীরের বাঁকঝোঁক, লোকায়ত সুরে মেদুর গানসব নিয়ে এই নাটক এক সময় ঘোর লাগিয়েছিল দর্শকের চোখে।
আর সেই দর্শকের একটা অংশ ছিল অবশ্যই জেন ওয়াই। যারা সব সময়ই অভিনবত্বকে স্বাগত জানায়। “অল্পবয়েসি দর্শকরা যাতে নাটকের সঙ্গে নিজেদের ‘আইডেনটিফাই’ করতে পারে তাই বিখ্যাত শিল্পী নিইনি। দেখেছি আজকালকার শহুরে ছেলেমেয়েরা ‘ফোক’ ভালবাসে। এ বারের নাটকে আসছে মণিপুর, মেঘালয়, কুচবিহারেরও লোকনৃত্য। তবে নাটকের উপস্থাপনার নকশাটা খুবই ‘আরবান’ অর্থাৎ শহুরে নাটকের আদলে। যেটা এই জেনারেশন পছন্দ করে বলেই আমার মনে হয়,” বলছেন পরিচালক।
নাট্যরসিকেরা অবশ্য বলেন ‘মাধব মালঞ্চী কইন্যা’র বহু দিন পর ‘দেবী সর্পমস্তা’ই নাকি আবার সেই রকমই এক রূপকথা নাটক। গল্পটা ঠিক কেমনবিভিন্ন লেখায় আগেই বেরিয়েছে। তবু আর এক বার একটু ধরিয়ে দিতেই বলা, সর্পমস্তা লোকদেবী নয়। নাট্যকার মনোজ মিত্রেরই কল্পনা। একশো আট মরকত রত্নে গাঁথা মালা পরা সর্পমস্তার বিগ্রহ জঙ্গলের কিরাত আদিবাসীদের কাছ থেকে চুরি করে এনে সিংহগড়ের রাজপ্রাসাদে ঠাঁই দিয়েছিলেন এক রাজা। কিন্তু কালে কালে সেই রত্নমালার দিকে চোখ পড়ল ব্রিটিশদের। রাজশক্তি তখন বিপন্ন। রাজাকে লোকবলের সহযোগিতা পেতে শেষমেশ এসে দাঁড়াতেই হল জঙ্গলের প্রান্তবাসী ব্যাধ সমাজের কাছে।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের প্রাক্তন এক ছাত্রী বললেন, “ভারতের অন্য প্রদেশের নাটকে ফোকের ফর্ম আমরা দেখছি অনেক দিন ধরেই। কিন্তু বাংলা নাটকে আমরা খুব বেশি সেটা দেখি না। হয় ঘরোয়া মধ্যবিত্তদের গল্প, নয় রাজনীতি, নতুবা ক্লাসিকের নতুন ইন্টারপ্রিটেশন। সেখানে ‘দেবী সর্পমস্তা’ যেন কর্ণ জোহরের সিনেমা। হাসি, কান্না, মান, অভিমান, ত্রিকোণ প্রেম, কামনাবাসনা, নাচ, গান, কস্টিউম, সেট সব নিয়ে একটা ‘ভাইব্র্যান্ট এন্টারটেনমেন্ট।’ নাটকটা একবার শুরু হলে অন্যমনস্ক হওয়ার কোনও সুযোগই নেই।”
মিনার্ভা রেপার্টরির আর এক নাটক ‘কিং লিয়ার’ চুক্তি শেষ হয়ে যাওয়ার পর বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এ পর্যন্ত ফিরে আসার কেনও লক্ষণ নেই। “শুধু কিং লিয়র নয়, রেপার্টরির পক্ষ থেকে ‘চন্দ্রগুপ্ত’ নাটককে নতুন করে মঞ্চে আনার জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছিল পরিচালক সুমন মুখোপাধ্যায় ও কৌশিক চট্টোপাধ্যায়কে। কিন্তু তার উত্তরে পরিচালকেরা কোনও চিঠি দেননি এখনও। আমিই প্রথম রেপার্টরির পুরনো প্রযোজনা হিসেবে ‘দেবী সর্পমস্তা’ আবারও মঞ্চস্থ করতে চলেছি।” আর ‘দেবী সর্পমস্তা’ নতুন করে চুক্তিবদ্ধ হয়ে যে ফিরে আসছে তাতে খুশি নতুন প্রজন্ম।
নাট্যকার মনোজ মিত্র মনে করছেন নতুনদের যদি দেশ, কাল, সমাজ, ইতিহাস, পাহাড়, জঙ্গল, প্রকৃতি, মাটির গন্ধএ সবের কাছে টেনে আনতেই হয়, তা হলে স্রেফ ইন্টারনেট দিয়ে হবে না। ‘দেবী সর্পমস্তা’র মতো প্রযোজনা দিয়েই ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা যেতে পারে জীবন ও সংস্কৃতির শিকড়ে। তারাই তো দেশের আগামী দিন।
এ নাটকে ব্রিটিশদের ষড়যন্ত্রে বিপন্ন রাজা যখন এসে দাঁড়ায় জঙ্গলে, শক্তি ভিক্ষা চাইতে, প্রান্তিক সমাজের মধ্যে লেগে যায় তুমুল বাগবিতণ্ডা। রাজাকে সাহায্য করতে চায় না তারা। কীই বা পেয়েছে তারা রাজার কাছে? শুধুই বঞ্চনা! এক ব্যাধ তখন বলে ওঠে “শুনলি না তোরা পুরাণ কথা? রাম-রাঘব যবে এসেছিল বনবাসে, কাহারা দিল রে ঠাঁই? মোদেরই পূর্বপুরুষ। রাজ্যহারা পাণ্ডব যবে এল, মোদেরই পূর্বপুরুষ পরাণ দিল জতুগৃহে, হরিশ্চন্দ্র রাজায় ঠাঁই দিলে চণ্ডালে। সিংহগড়ের রাজারেও ঠাঁই দেব মোরা।’ বিনোদনের মশলা ঠাসা ‘সর্পমস্তা’ আপাতদৃৃষ্টিতে রংমশালের মতো মনে হলেও, নতুন প্রজন্মকে মনে করিয়ে দেবে এটাওরাজনীতি, রাজশক্তির পাসওয়ার্ডটা জানে কেবল সাধারণ মানুষই।
নাটক দেখে অভিভূত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আনন্দবাজার পত্রিকার ‘যা দেখি যা শুনি একা একা কথা বলি’ কলামে লিখেছিলেন, “নাটকটি দেখেছি বিভোর হয়ে। শেষ হওয়ার পর বেরুবার সময় আমি গুনগুন করেছি এর মূল গান, ‘ও দেবী তোর কেমন পা, ধুলা লাগে না, ধুলায় গড়া পুতলি ধুলা ধরে না।’ আমার সঙ্গে যে কয়েক জন বন্ধুবান্ধব গিয়েছিল তাদের একজন বলল, ‘নাটকটা আবার দেখতে হবে।’ ঠিক কথা। নাচে গানে মাতানো এমন নাটক বারবার দেখা যায়।”
১৪ মার্চ রবীন্দ্র সদনে সেই নাটক প্রদর্শিত হবে আবার।
শুধু সুনীলের দ্বিতীয়বার আর দেখা হবে না। তবে তাঁর নীললোহিত-মন ছড়িয়ে আছে আপামর রসিক বাঙালির মধ্যে। যে মন কেবলই পৌঁছে যেতে চায় গ্রাম, নগরের অলিতেগলিতে, জঙ্গলে, পাহাড়ে, বিচিত্র মানুষের কাছে। মানুষের বিচিত্র মনের আলোআঁধারির খোঁজে।
তাঁদেরই জন্য ‘দেবী সর্পমস্তা’ আবার আসছে একশো আটটা মরকত মণিহারের হাসিকান্না নিয়ে।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.