ষাট ফুট লম্বা। প্রস্থে অন্তত ১৫ ফুট। দু’টি পাল। আট থেকে দশ দাঁড়ির সেই নৌকা ভাঁটার টানে পাথর বয়ে আনত দক্ষিণবঙ্গের বিস্তৃত এক জনপদে। কখনও পাথর আসত কাঠের ভেলায়। বড় বড় গাছের গুঁড়ি পাশাপাশি বেঁধে তার উপরে আড়াআড়ি করে শুইয়ে নদীপথে নিয়ে আসা হত পাথরের খণ্ড। সেই সঙ্গেই আসতেন পাথর কুঁদে মূর্তি বা মন্দির-মঠের অঙ্গসজ্জা তৈরি করার শিল্পীরাও। একাধিক শিল্পী এক সঙ্গে আসতেন।
এখনকার দক্ষিণ ২৪ পরগনার ডায়মন্ড হারবারের কাছাকাছি রায়দিঘি, দক্ষিণ বিষ্ণুপুর, খাঁড়ি, মথুরাপুর, কাশীনগর, গোবর্ধনপুর, ছত্রভোগ অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন এলাকায় নবম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে পাথর ব্যবহারের সেই প্রমাণ পেয়ে পুরাতত্ত্ববিদদের অনুমান, পাল-সেন যুগে এই এলাকায় সমৃদ্ধ জনপদ ছিল। ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের প্রাক্তন মহানির্দেশক গৌতম সেনগুপ্ত জানান, পলিমাটি দিয়ে গড়া এই নিম্ন গাঙ্গেয় এলাকায় পাথরের ব্যবহার করতে হলে শক্তিশালী প্রশাসনিক পরিকাঠামোর প্রয়োজন হত। তা ব্যয়সাপেক্ষও ছিল। তাই এই এলাকায় সমৃদ্ধ জনবসতি যে ছিল, তা অনুমান করা যায়। বোঝা যায়, এই এলাকার সঙ্গে পূর্ব ভারতের বিভিন্ন অংশের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগও ছিল। সভ্যতার আরও অনেক বিচ্ছিন্ন প্রমাণও এখান থেকে পাওয়া গিয়েছে। তাঁর কথায়, “কিন্তু এখনও পর্যন্ত যে ধরনের পুরাবস্তু এখান থেকে উদ্ধার হয়েছে, তা থেকে সেই জনপদের সামগ্রিক পরিচয় ভাল ভাবে জানা যায়নি। আমাদের এখনও সাহিত্য ও লেখমালা থেকে সাহায্য নিতে হয়।”
সেই পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণের খোঁজেই এ বার রায়দিঘির কাছে কঙ্কণদিঘিতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে খননকার্য শুরু হয়েছে পুরাতত্ত্ববিদ দুর্গা বসুর নেতৃত্বে। কঙ্কণদিঘির পিলখানায় তাঁরা খননকার্য শুরু করেছেন। কেন কঙ্কনদিঘিকেই বেছে নিলেন তাঁরা? দুর্গাদেবীর কথায়, “এখানে মাটির নীচে বেশ কয়েকটি ইটের কাঠামো রয়েছে। সেগুলি থেকে জনবসতির পরিচয় জানা যাবে। সেই সঙ্গে আমরা এখানে চেষ্টা করব মানুষের দৈনন্দিনের ব্যবহার্য জিনিসপত্রেরও সন্ধান করতে।” তিনি বলেন, “খনন সবে শুরু হয়েছে। যে ইটের কাঠামোটি পাওয়া গিয়েছে, তা দেখে আমাদের প্রাথমিক ভাবে মনে হচ্ছে, এই ইটের কাঠামো আনুমানিক অষ্টম-নবম শতকের।” গৌতমবাবুর বক্তব্য, এই এলাকার মধ্যে কঙ্কণদিঘিতেই বেশ কিছু পাথরের পুরাবস্তুর প্রমাণ মিলেছে, তাই সেখানে উৎখনন করলে ধর্মীয় স্থাপত্য, ভাস্কর্যের পাশাপাশি এই এলাকার আদি মধ্যযুগের জনপদের অন্য পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন মেলার আশা উজ্জ্বল। পুরাতত্ত্ববিদ মুনমুন মণ্ডল বলেন, “এই উৎখননে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদেরও নিয়ে আসা হয়েছে।” নৌবিশেষজ্ঞ স্বরূপ ভট্টাচার্য বলেন, “মণি নদীর ধারে কঙ্কণদিঘিতে পাথর আসত যে নৌকায়, তা মেড়লি বা গলইয়া হতে পারে। এই দুই ধরনের পণ্যবাহী নৌকাই আদি মধ্যযুগ থেকে ভাগীরথীর বুকে দেখা গিয়েছে। গলইয়া বেশ বড় নৌকা। মেড়লি গলইয়ার চেয়েও বড়।” এই এলাকা থেকে যেমন পাওয়া গিয়েছে মন্দিরের দ্বারদেশের ফলকে পাথরের নবগ্রহ, তেমনই মিলেছে পাথরের বৌদ্ধ তারা প্রতিমা। আদি মধ্য যুগ থেকেই বাংলার বৌদ্ধ ও হিন্দু রাজাদের কাছে এই এলাকার গুরুত্ব ছিল। কিছু ইতিহাসবিদ মনে করেন, ধর্মপালের খালিমপুর তাম্রশাসনে এই এলাকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। লক্ষ্মণ সেনেরও তিনটি তাম্রশাসন বা তামার পাতে খোদাই করা নির্দেশ থেকে এই অঞ্চলের ভূমিদান ও কৃষি ব্যবস্থার নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে। মিলেছে সেন রাজাদের সমসাময়িক স্থানীয় এক ভূস্বামী ডোম্মন পালের লেখ-ও। জয়নগর-মজিলপুরের কালিদাস দত্ত বিংশ শতকের প্রথম দিকে এই অঞ্চলের পুরাতাত্ত্বিক গুরুত্বের কথা উল্লেখ করেছিলেন। |