ইংরেজিতে ২৫। ভূগোলে ১। দশম শ্রেণির টেস্টে নম্বর এমনই! তবু অ্যাডমিট কার্ডের প্রত্যাশায় মধ্যশিক্ষা পর্ষদের গেটে দাঁড়িয়ে কিশোর। একটাই দাবি, “পরীক্ষায় বসতে দিতে হবে। আমি ঠিক ভাল ফল করব।” পাশে দাঁড়ানো তার এক বন্ধুর প্রত্যয় আরও এক ধাপ উপরে। মাধ্যমিকে বসলে অন্তত পাঁচটা বিষয়ে লেটার সে পাবেই।
রবিবার সল্টলেকে পর্ষদের অফিসের সামনে অ্যাডমিট কার্ড নিতে আসা পড়ুয়ার ভিড়ে দেখা মিলল এমনই দুই পড়ুয়ার। শেষ পর্যন্ত তাদের অবশ্য ফর্ম পূরণের সুযোগ দেওয়া হয়নি। ফর্ম পূরণ করতে না-পারার তালিকায় ছিল অনেকেই। কেউ অসুস্থতার জন্য ফর্ম পূরণ করতে পারেনি। কেউ বা সেই কাজটা করে উঠতে পারেনি প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে মারামারিতে জড়িয়ে পড়ায়!
অ্যাডমিট কার্ড নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করা হয়েছিল কাঁকিনাড়ার হাইস্কুলের ৪১৩ জন পড়ুয়ার তরফে। পর্ষদ সূত্রের খবর, শনিবার খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আশ্বাসের পরে সেখানকার ৩৭৫ জন ছাত্রকে ফর্ম পূরণ করিয়ে অ্যাডমিট কার্ড দেওয়া হয়েছে। বাকি ৩৮ জন ফর্ম পূরণ করতে আসেনি। অ্যাডমিট কার্ড দেওয়া হয়েছে অন্য কয়েকটি স্কুলের পড়ুয়াদেরও। তারা আগেই ফর্ম পূরণ করেছিল। কিছু ত্রুটির জন্য অ্যাডমিট কার্ড পাচ্ছিল না। তা শুধরে নিয়ে তাদের অ্যাডমিট কার্ড দেওয়া হয়েছে।
শুক্রবার হাইকোর্ট জানিয়ে দেয়, কাঁকিনাড়ার স্কুলটির ৪১৩ জন পড়ুয়াকে মাধ্যমিকে বসার অনুমতি দেওয়া যাচ্ছে না। তার পরে কিছু পড়ুয়া আদালতেই বিক্ষোভ দেখায়। পরে তারা মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির দিকে এগোতে থাকে। |
হাজরা মোড়ে তাদের আটকে দেয় পুলিশ। শনিবার বিক্ষোভ আরও ছড়িয়ে পড়ে। রাস্তা অবরোধ করা হয়। তার পরেই মুখ্যমন্ত্রী নির্দেশ দেন, যে-সব পড়ুয়া সময়মতো ফর্ম পূরণ করতে পারেনি, তাদের ফের সুযোগ দেওয়া হবে। এ দিন সেই নির্দেশের ভিত্তিতেই বিভিন্ন স্কুলের পড়ুয়ারা ভিড় করে পর্ষদের সামনে।
পর্ষদ সূত্রের খবর, পরীক্ষার্থীদের চিনিয়ে দেওয়ার জন্য বিভিন্ন স্কুলের প্রধান শিক্ষক বা শিক্ষিকাকেও আসতে বলা হয়েছিল। পড়ুয়া ও অভিভাবকেরা সকালে চলে এলেও বেশির ভাগ প্রধান শিক্ষকই আসেননি। যেমন শ্যামনগরের গারুলিয়া মিউনিসিপ্যাল হাইস্কুল। ওই স্কুলের দুই ছাত্রী মেঘা কুর্মি ও সুষমা সাউ জানায়, তারা অসুস্থতার জন্য ফর্ম পূরণ করতে পারেনি। তাদের মতো আরও কয়েক জন রয়েছে। যদিও তাদের কাছে রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট ছাড়া টেস্টে পাশ করার কোনও প্রমাণও নেই। প্রধান শিক্ষিকা লিপিকা বসু না-আসায় বিকেলে পর্ষদ ভবনের সামনে ধর্নায় বসে তারা। সমস্যায় পড়েছে ভগবানপুর হাইস্কুলের পড়ুয়ারাও। ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক সুনয়ন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “ওই পড়ুয়ারা কেন অ্যাডমিট কার্ড পায়নি, তা ওদেরই জিজ্ঞাসা করুন।” কোনও কোনও প্রধান শিক্ষক অবশ্য টিভিতে খবর দেখে পর্ষদ ভবনে হাজির হন। কিন্তু সময় পেরিয়ে যাওয়ায় তাঁদের স্কুলের পড়ুয়াদের ফর্ম পূরণের সুযোগ দেওয়া হয়নি। এই নিয়েও সন্ধ্যা পর্যন্ত বিক্ষোভ চলে।
ডোমজুড়ের শেখ আনজামুল হাসানের কপাল ভাল। তার স্কুল, কেশবপুর হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক হারাধন কোঁয়র ছাত্রকে নিয়ে সকাল-সকালই ভিতরে গিয়েছিলেন। দুপুরে বেরিয়ে এলেন অ্যাডমিট কার্ড হাতে। স্কুলের বাইরে তখন আনজামুলের বাবা ও মায়ের চোখে আনন্দের জল! তবে পর্ষদে এসেও অ্যাডমিট কার্ড জোগাড় করতে পারেননি হুগলির কবুড়া হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক বিকাশচন্দ্র ঘোষ। কারণ, তাঁর ছাত্র টেস্টে পাশ করলেও পর্ষদের রেজিস্ট্রেশন ছিল না তার। বিকাশবাবুর বক্তব্য, “বারবার বলা হলেও নবম শ্রেণিতে রেজিস্ট্রেশন করায়নি ওই ছাত্র। তবু কাল মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার পরে ছাত্রের অনুরোধেই পর্ষদের দফতরে এসেছিলাম।”
অ্যাডমিট কার্ড ঘিরে আশা-হতাশার পাশাপাশি পর্ষদের সামনে বিচিত্র কিছু ছবিও দেখা গেল! টিভি ক্যামেরা দেখলেই ঘিরে দাঁড়াচ্ছিলেন অনেকে। কোনও কোনও পড়ুয়া বা অভিভাবক শশব্যস্ত হয়ে বাড়িতে ফোন করে জানতে চাইছিলেন, টিভিতে তাঁদের দেখাচ্ছে কি না! আবার এক দল পড়ুয়া পাশের চায়ের গুমটিতে বসে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিল। পরীক্ষা যে সোমবারেই।
পর্ষদ ঘিরে দিনভর এই চলচ্ছবির মধ্যেই প্রশাসক কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায় জানান, কাঁকিনাড়া হাইস্কুল ছাড়াও অন্য কয়েকটি স্কুলের পড়ুয়াদের সমস্যা ছিল। সেগুলিও মিটে গিয়েছে। তবে প্রধান শিক্ষক বা শিক্ষিকা না-আসায় কিছু ক্ষেত্রে অ্যাডমিট কার্ড দেওয়া হয়নি। কারণ, পড়ুয়ারা বৈধ কি না, তা চিহ্নিত করার জন্য প্রধান শিক্ষক বা শিক্ষিকার দরকার ছিল। কল্যাণবাবু বলেন, “সকাল ৮টায় পর্ষদের অফিস খুলেছে। যাঁরা এসেছিলেন, প্রত্যেককেই সাহায্য করা হয়েছে।”
তাল কেটেছে তারাতলার শ্রী শম্ভু সদন বিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের বিক্ষোভে। ওই স্কুলের পড়ুয়ারাও কাঁকিনাড়ার স্কুল থেকে মাধ্যমিক দিচ্ছে। পরীক্ষা কেন্দ্র বিধাননগর মিউনিসিপ্যাল স্কুলে। ফর্ম পূরণের পরে তাদের বলা হয়েছিল, আজ, সোমবার সকালে তারাতলার স্কুল থেকে অ্যাডমিট কার্ড নিতে হবে। কিন্তু পড়ুয়ারা জানায়, সকালে তারাতলার স্কুল থেকে অ্যাডমিট কার্ড নিয়ে বিধাননগরের পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌঁছতে অসুবিধা হবে। রবিবার রাতেই অ্যাডমিট কার্ডের দাবিতে পর্ষদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে তারা। শেষ পর্যন্ত রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ তাদের অ্যাডমিট কার্ড দেওয়া হয়। ওই স্কুলের পড়ুয়া কাজল সিংহ, সোনালি বাল্মীকি বলে, “খুব ভাল লাগছে। অনেক প্রতীক্ষার পরে অ্যাডমিট কার্ড পেলাম।” কেউ কেউ আবার ‘মুখ্যমন্ত্রী জিন্দাবাদ, শিক্ষামন্ত্রী জিন্দাবাদ’ স্লোগানও দিতে থাকে।
তবে অ্যাডমিট কার্ড দেওয়ার সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি প্রশ্নও উঠছে কিছু কিছু। অনেকেই বলছেন, যে-সব স্কুলের দোষে অ্যাডমিট কার্ড নিয়ে এত বিভ্রাট, সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেবে কি? প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি অনুষ্ঠানের শেষে এই প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু বলেন, “সরকার এখন এ-সব নিয়ে ভাবছে না।” তবে স্কুলগুলি পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষার ফর্ম পূরণের টাকা নিয়েও ঠিকমতো কাজ করেনি, এমন অভিযোগ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান শিক্ষামন্ত্রী। |