গ্রামবাসীরা বলছেন, তাঁরা রাজনীতি চান না। কিন্তু, পোলবার ধর্ষণ-কাণ্ডে পুরোদস্তুর লেগে গেল রাজনীতির রং।
ধর্ষিতা স্কুলছাত্রীর পরিবারের ‘পাশে দাঁড়াতে’ গিয়ে গ্রামের মহিলাদের তুমুল বিক্ষোভের মুখে পড়লেন প্রদেশ কংগ্রেস নেতারা। বিক্ষোভকারীদের হাতে ছিল লাঠিসোঁটাও। নেতাদের গাড়িতে চড়চাপড় পড়ে। ইট-পাটকেল উড়ে এসে লাগে গাড়ির কাচে। জনরোষের মুখে পড়ে ওই কিশোরীর সঙ্গে দেখা না করেই কোনও ক্রমে গাড়িতে উঠে এলাকা ছাড়েন প্রদীপ ভট্টাচার্য, আব্দুল মান্নান, অমিতাভ চক্রবর্তী-সহ প্রদেশ কংগ্রেস নেতারা। |
বিক্ষোভের মুখে কংগ্রেস নেতারা। রবিবার পোলবায়। —নিজস্ব চিত্র। |
রবিবার দুপুরে হুগলির পোলবার কামদেবপুর গ্রামে ঢোকার রাস্তায় পুলিশের সামনে এই ঘটনা ঘটলেও প্রথম দিকে কয়েকশো গ্রামবাসীর (বিশেষ করে মহিলারা) ক্ষোভ সামাল দিতে পারেনি তারা। পরে বিশাল বাহিনী এসে পরিস্থিতি আয়ত্তে আনে। কামদুনির মতোই কামদেবপুরের বাসিন্দাদের বড় অংশ বলে দিচ্ছেন, ‘‘ধর্ষণ নিয়ে রাজনীতি নয়।’’ গ্রামের বধূ দীপিকা মাইতি, মমতা ওরাঁও বলেন, “রাজনীতির লোকেরা স্বার্থপর। ওঁরা নিজেদের স্বার্থরক্ষার জন্যই এসেছিলেন। কংগ্রেস, সিপিএম, তৃণমূল, বিজেপি কাউকে গ্রামে ঢুকতে দেব না।” গ্রামবাসী অনন্ত বাউরির কথায়, “একটা ঘটনা নিয়ে রাজনীতির লোকেরা যে নোংরামি করছে, এটা অত্যন্ত লজ্জার। ওঁদের এত মাথাব্যথার কারণ কী? এটা কি রাজনীতির জায়গা?”
যদিও ঘটনা হল, এ দিন সকালেই ওই গ্রামে গিয়েছিলেন শাসকদলের স্থানীয় বিধায়ক (চুঁচুড়া) অসিত মজুমদার। দীপিকা বলেন, “ওঁকেও একই কথা বলেছি। আমাদের গ্রামের মেয়ের সর্বনাশ হয়েছে। ওর বাবা-মা দিনমজুর। আমরাই ঠিক করব ওঁদের কী হবে। আর কাউকে লাগবে না। ওর স্কুলেও কথা বলব আমরা।” আর গ্রামে যাওয়া নিয়ে অসিতবাবুর যুক্তি, আমি শুধু মেয়েটাকে হাসপাতাল থেকে নিজের গাড়িতে চাপিয়ে বাড়ি পৌঁছতে গিয়েছিলাম। গ্রামের লোক যখন চাইছেন না, তখন এ সময়ে ওখানে না যাওয়াই উচিত।”
কংগ্রেস নেতৃত্ব অবশ্য গোটা ঘটনায় তৃণমূলের ‘ইন্ধন’ থাকার অভিযোগ তুলেছেন। প্রদেশ কংগ্রেসের সদ্য প্রাক্তন সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যের দাবি, “পরিকল্পিত ভাবে হামলা হয়েছে। তৃণমূলের পোষা গুণ্ডারা লাঠিসোঁটা, রিভলভার, বন্দুক নিয়ে হাজির হয়েছিল। এ তো সাংঘাতিক ব্যাপার!” হুগলিরই বাসিন্দা আব্দুল মান্নান বলেন, “শাসকদলের লোকজন ধর্ষকদের পক্ষ নিয়ে আমাদের উপরে হামলা চালিয়েছে।” ঘটনার প্রতিবাদে কংগ্রেসের কর্মী-সমর্থকেরা রবিবার বিকেলে পোলবায় দিল্লি রোড অবরোধ করেন। আজ, সোমবার প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীকে নিয়ে তাঁরা ফের পোলবায় আসবেন বলেও জানিয়ে দিয়েছেন প্রদীপবাবু। এ দিনের ঘটনা এবং কিছু দিন আগে হুগলিরই মগরায় যুব কংগ্রেস নেতা অভিজিৎ রহমানকে খুনের প্রতিবাদে সোমবার অধীরবাবুর নেতৃত্বে চুঁচুড়ায় মৌনী মিছিল করবে কংগ্রেস। কংগ্রেসের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে তৃণমূল বিধায়ক অসিতবাবুর বলেন, “গ্রামবাসীরাই ওঁদের ঢুকতে দেননি। এর সঙ্গে তৃণমূলের কোনও যোগ নেই। যেখানে সরকার উপযুক্ত ব্যবস্থা নিচ্ছে, সেখানে রাজনীতির দরকারটাই বা কী!”
পোলবা থানায় কংগ্রেস তৃণমূলের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছে। গ্রামবাসীদের তরফে কংগ্রেসের বিরুদ্ধেও অভিযোগ হয়েছে। জেলার পুলিশ সুপার সুনীল চৌধুরী বলেন, “দু’পক্ষই অভিযোগ করেছে। তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।” পুলিশের দাবি, তাদের অন্ধকারে রেখেই কংগ্রেস নেতারা এ দিন কামদেবপুরে গিয়েছিলেন। আর মহিলা পুলিশকর্মী না থাকায় বিক্ষোভ প্রথম দিকে সামাল দেওয়া যায়নি।
গত শুক্রবার বিকেলে স্কুল থেকে ফেরার সময় পোলবার সুগন্ধায়, দিল্লি রোডের পাশে একটি পানশালার পিছনের আমবাগানে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রীটিকে স্থানীয় চায়ের দোকানি কালু মাহাতো ধর্ষণ করে বলে অভিযোগ। পানশালার লোকজন সব জেনেও প্রতিবাদ করেননি বলে অভিযোগ তুলে ওই দিনই পানশালাটিতে যথেচ্ছ ভাঙচুর চালায় জনতা। মারধর করা হয় পানশালার মালিকের ছেলেকে। ওই দিনই গ্রেফতার হয় কালু। তাকে পুলিশের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিতে চেয়েছিল জনতা। তাই নিয়ে পুলিশের সঙ্গে খানিক ধস্তাধস্তিও হয়েছিল।
অসুস্থ মেয়েটিকে ভর্তি করানো হয় চুঁচুড়া ইমামবাড়া হাসপাতালে। সেখান থেকে রবিবার সকালেই ছাড়া পেয়েছে সে। এ দিনই কংগ্রেসের প্রতিনিধিদল নির্যাতিতার পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে গ্রামের দিকে রওনা দেয়। কংগ্রেস নেতাদের সফরসূচি জেনে গিয়েছিলেন কামদেবপুরের মানুষ। গ্রামে ঢোকার মুখেই জড়ো হয়েছিলেন কয়েকশো মহিলা। হাতে লাঠিসোঁটা, গাছের ডাল। হাতের প্ল্যাকার্ডে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা ‘গ্রামে রাজনীতি করতে দেব না’। বিক্ষোভকারীদের হাতে ছিল কালো পতাকা, মুখে স্লোগান, “ধর্ষণ নিয়ে রাজনীতি চাই না।” প্রদীপবাবুদের গাড়ি গ্রামে ঢোকার মুখেই আটকে দেওয়া হয়। নেতারা গাড়ি থেকে নেমে গ্রামে ঢোকার চেষ্টা করতেই শুরু হয় ধাক্কাধাক্কি। গাড়িতে চড়চাপড়, লাঠির ঘা পড়ে। ভিড়ের মধ্যে গাড়ি থেকে নেমে প্রদীপবাবু চেঁচিয়ে বলেন, “আমরা মেয়েটির পরিবারের পাশে দাঁড়াতে চাই। আইনি সহায়তা দিতে চাই।” ভিড়ের মধ্যে সেই আওয়াজ অবশ্য চাপা পড়ে যায়। জনতা উল্টে গর্জে ওঠে, “আপনাদের কিচ্ছু করতে হবে না! রাজনীতির নামে অশান্তি ছড়াতে এসেছেন। ফিরে যান।” এ সবের মধ্যেই বিক্ষোভকারীদের মধ্যে থেকে ইট-পাটকেল উড়ে আসে নেতাদের গাড়ি লক্ষ করে। বেগতিক বুঝে গাড়িতে উঠে পড়েন নেতারা। লাঠি নিয়ে খানিক দূর পর্যন্ত তাঁদের ধাওয়াও করেন স্থানীয় কিছু যুবক।
গ্রামবাসীদের সুরেই এলাকার কংগ্রেস নেত্রী, কামদেবপুরের বাসিন্দা লিপিকা দাস (গত পঞ্চায়েত ভোটে দলের টিকিটে প্রার্থী হয়েছিলেন) বলেন, “আমার দল কংগ্রেস, সিপিএম, তৃণমূল বা অন্য কোনও রাজনৈতিক দলকেই এই গ্রামে চাইছি না। গ্রামের সমস্যা গ্রামবাসীরা মিলেই মেটাব। আমরা শুধু চাই, অপরাধীদের শাস্তি হোক। আর দিল্লি রোডের ধারের ওই পানশালাটা পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হোক।” নির্যাতিতার বাবাও এ দিন বলে দিলেন, “যে ভাবে রাজনীতি শুরু হয়েছে, ভাল লাগছে না। গ্রামের মানুষ সব সময় আমাদের পাশে আছেন। আমরা চাই না, রাজনীতির লোক এখানে আসুক।” |