নিজের সংসার চালাতে ভর্তুকি লাগছে। তবু এই শহরের দ্রষ্টব্য কিছু স্থান ঘুরিয়ে দেখাতে এসি ট্রাম চালানোর পরিকল্পনা করেছে ট্রাম কোম্পানি! এই ট্রাম চালিয়ে লোকসান হয়েছে পর্যটন দফতরের। ট্রাম কোম্পানির কর্তাদের দাবি, তাঁরা লাভের মুখ দেখবেন।
পর্যটকদের জন্য এসি ট্রাম চালানোর মূল পরিকল্পনাটি ছিল পর্যটন দফতরের। যাত্রীপিছু ২৬০ টাকা ভাড়া নিয়ে, যাত্রাপথে কিছু হাল্কা জলখাবারের ব্যবস্থা করে ট্রাম চালিয়েছিল তারা। ‘চরৈবেতি’ নামে এই ট্রামে চড়ে বিবাদী বাগ থেকে যাত্রা শুরু করে জোড়াসাঁকো, নাখোদা মসজিদ-সহ কয়েকটি ঐতিহাসিক স্থান দর্শন করতেন পর্যটকরা। ফেরার পথে স্কটিশ চার্চ কলেজ, কলেজপাড়া, প্রেসিডেন্সি কলেজ, ঠনঠনিয়া কালীবাড়ির মতো কয়েকটি পরিচিত স্থানেরও দেখা পেতেন। সপ্তাহে পাঁচ দিন করে মাস আটেক সেই ট্রাম চালিয়ে তা বন্ধ করে দিয়েছে পর্যটন দফতর। দফতরের কর্তাদের বক্তব্য, ট্রাম চালিয়ে মাসে লাভ হত প্রায় দু’লক্ষ টাকা। |
কিন্তু ট্রাম কোম্পানিকে মাসে ভাড়া গুনতে হত পাঁচ লক্ষ টাকা। ফলে লাভের গুড় খেত সিটিসি। উল্টে দফতরের তহবিল থেকে মাসে তিন লক্ষ টাকা চলে যেত।
অতএব বোঝা না বাড়িয়ে ট্রাম কোম্পানিকে তাদের ট্রাম ফিরিয়ে দিয়েছে পর্যটন দফতর। আর তা হাতে পেয়ে নিজেরাই চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংস্থা। ঘটা করে তার উদ্বোধনও করেন পরিবহণ মন্ত্রী মদন মিত্র। প্রশ্ন উঠেছে, সংস্থার কর্মীদের বেতন ও পেনশন দেওয়া, দৈনন্দিন খরচ চালাতে ট্রামকে ভর্তুকি দেয় সরকার। তা-ও যেখানে কঠিন হয়ে উঠেছে, সেখানে এসি ট্রাম চালানোর মানে কী? কর্তাদের একাংশের দাবি, এসি ট্রাম চালানোর জন্য কোনও ভর্তুকি দিতে হবে না। উল্টে লাভ হবে সংস্থার। কী ভাবে? তাঁদের হিসেব, সপ্তাহে তিন দিন, তিনটি রুটে ট্রাম চালানো হবে। এগুলি হল ধর্মতলা থেকে খিদিরপুর, ধর্মতলা থেকে কালীঘাট ও ধর্মতলা থেকে শ্যামবাজার। বাকি দিনগুলি বিয়ে, বিভিন্ন সংস্থাকে কনফারেন্স করার জন্য ভাড়া দেওয়া হবে। সব মিলিয়ে সপ্তাহে খরচ হবে আড়াই লক্ষ টাকার মতো। আয় হবে পাঁচ লক্ষ টাকা।
কর্তাদের অন্য একটি অংশ অবশ্য এই দাবি মানেন না। তাঁদের বক্তব্য, ট্রাম চালিয়ে এমনিতেই লাভ হয় না। তা-ও পর্যটন দফতরকে ভাড়া দিয়ে মাসে পাঁচ লক্ষ টাকা আয় হচ্ছিল। তার মধ্যে বিদ্যুৎ এবং রক্ষণাবেক্ষণে দু’লক্ষ টাকা খরচ হত। বাকি তিন লক্ষ আসত সিটিসি-র ঘরে। এ বার নিজেরা চালানোয় সেটাও হবে না। এর সাফল্য নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্ট সংস্থাও। যেমন, ক্লাব সেভেন হলিডেজ-এর রডনি সিপি জিলেট-এর মতে, “এই ধরনের পর্যটন মূলত বাইরের পর্যটকদের জন্য। তাই এর সাফল্য পেতে প্রচারটাই মুখ্য। এ জন্য হোটেল, স্টেশন, বিমানবন্দরের মতো নানা জায়গায় ব্যাপক প্রচারের প্রয়োজন।” রডনির মতে, “এই ট্রামের ভাড়া বেশি নয়। বিদেশি পর্যটকদের কাছে তো নয়ই। কিন্তু তাঁদের জন্য বিনোদনের ব্যবস্থা মানে উন্নত মানের স্ন্যাক্স-বার ইত্যাদি রাখা প্রয়োজন। তাতে এ ধরনের পর্যটন খুবই সফল হবে।” প্রচারটাই যে মূল, তা মানছেন লক্ষ্মীনারায়ণ ট্রাভেলসের প্রধান দিব্যেন্দু ঘোষও। তিনি বলেন, “ভিন্ রাজ্যের এবং বিদেশি পর্যটকেরা অনেক সময়েই আমাদের কাছে কলকাতার ট্রামের খোঁজখবর নেন। কিন্তু তাঁদের জন্য আমরা নির্দিষ্ট কিছু প্যাকেজের কথা বলতেই পারি না। কারণ, আমাদের কাছে বিস্তারিত তথ্য থাকে না।” এসি ট্রামের উদ্বোধন হয়ে যাওয়ার পরে ট্রামের কর্তারা এখন বলছেন, পর্যটকদের আকর্ষণ করতে কী ভাবে প্রচার করা দরকার, তা ঠিক করতে শীঘ্র ট্রাভেল এজেন্ট সংস্থাগুলির সঙ্গে বৈঠক হবে। তাদের পরামর্শ মতোই এগোনো হবে। তবু ভর্তুকিতে চলা পর্যটক-ট্রামের সাফল্য নিয়ে সংশয় থাকছেই। পরিবহণ কর্তাদের কয়েক জনের আগাম পূর্বাভাস, এখন স্বীকার না করলেও বছরখানেক চালিয়ে লোকসানের বহর আরও কিছুটা বাড়িয়ে তার পর হয়তো এই ট্রাম বন্ধ করার সিদ্ধান্ত হবে। যেমন কয়েক মাস চালিয়ে পর্যটন দফতর করেছে। |