তেমন কোনও মালমশলা ছিল না এ বারের বাজেটে। যেন রোগীর পথ্য। বাজেট যে নিরামিষ হবে, তা এক রকম জানাই ছিল। তাই তেমন কোনও প্রত্যাশা ছিল না এই ‘ভোট অন অ্যাকাউন্ট’ থেকে। নির্বাচনের বছরে এ রকমই হয়ে থাকে। এই জায়গায় দাঁড়িয়ে চিদম্বরম যে-অন্তর্বর্তী বাজেট গত সোমবার পেশ করেছেন, তা কিন্তু মোটের উপর খুশিই বয়ে এনেছে বাজারে।
প্রত্যক্ষ কর নিয়ে নাড়াচাড়া না-করলেও পরোক্ষ করের মাধ্যমে অল্প-বিস্তর প্রসাদ বিতরণ করেছেন শিল্প, বাণিজ্য এবং মধ্যবিত্তদের মধ্যে। অর্থমন্ত্রীর পেশ করা নানা পরিসংখ্যান নিয়ে বিতর্ক থাকলেও ‘ছোট’ বাজেট নিয়ে সাধারণ মানুষ অখুশি নয়।
২০১৩ সালে গাড়ি বিক্রি বৃদ্ধির হার গত ১০ বছরের মধ্যে সবথেকে কম ছিল। গাড়ির উপর নির্ভরশীল আরও অনেক শিল্প এবং কর্মসংস্থান। কম দামের একটি গাড়ি এখন মধ্যবিত্তের অন্যতম বাসনা। চড়া দাম এবং উঁচু সুদের কারণে একটু একটু করে নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছিল চার চাকার এই যানটি। বিক্রিতে মন্থরতা দেখা যাচ্ছিল স্কুটার-বাইক শিল্পেও। ফলে গাড়ি এবং বাইকের উপর উৎপাদন শুল্ক হ্রাস করায় খুশি মধ্যবিত্ত, শিল্পমহল এবং শেয়ার বাজার।
উৎপাদন শুল্ক কমানো হয়েছে এক শ্রেণির মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, কিছু বৈদ্যুতিন ভোগ্যপণ্য এবং ফ্রিজ, এসি ইত্যাদির মতো বাড়িতে ব্যবহৃত বিভিন্ন যন্ত্রে। এতে সংশ্লিষ্ট শিল্পের যেমন চাহিদা বাড়বে, তেমনই খুশি হবেন আপামর ভোটদাতা। অর্থাৎ এক ঢিলে দু’পাখি মারার ব্যাপারে ভালই সফল হয়েছেন পি চিদম্বরম। শুল্ক কমানো হয়েছে কিছু মূলধনী পণ্যেরও। শিক্ষাঋণের ব্যাপারে ছাড় পাবে কমবেশি ৯ লক্ষ ছাত্রছাত্রী, যারা ২০০৯ সালের আগে ঋণ নিয়েছে। বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে বড় রকমের উদার হওয়ার কোনও জায়গা ছিল না। এই অবস্থায় যা পাওয়া গেল তাই বা মন্দ কী! |
বাজেট পেশের আগে অর্থমন্ত্রী।—ফাইল চিত্র। |
লগ্নিকারীদের জন্য আলাদা করে বিশেষ কিছু নেই এই বাজেটে। তবে একই ডি-ম্যাট অ্যাকাউন্টে সব ধরনের লগ্নিপত্র রাখার যে-চিন্তাভাবনা চলছে, তাতে ভবিষ্যতে মানুষের বেশ সুবিধা হবে বলে মনে করা হচ্ছে। প্রস্তাব অনুযায়ী একই ডি-ম্যাট অ্যাকাউন্টে রাখা যাবে শেয়ার, বিমা পলিসি, মিউচুয়াল ফান্ড ইউনিট, বন্ড, ডাকঘর সঞ্চয় প্রকল্পে লগ্নি ইত্যাদির মতো সব ধরনের লগ্নিপত্র। এর ফলে লগ্নি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকবে না, থাকবে একটি ‘পাত্রে’।
বাজেটে শেয়ার বাজার মোটের উপর খুশি। সূচকই তার ইঙ্গিত। বাজেট ঘোষণার আগে সেনসেক্সের অবস্থান ছিল ২০,৩৬৭ অঙ্কে। বাজেট ঘোষণার পর ৫ দিনের মধ্যে ৪ দিনই বাজার উঠেছে। শুক্রবার বাজার বন্ধের সময়ে সেনসেক্স থেমেছে ২০,৭০১ পয়েন্টে। সেনসেক্সের সর্বকালীন রেকর্ড ২১,৪৮৪ থেকে খুব একটা পিছনে নয়। বাজেটের সুফল ছাড়াও চলতি খাতে বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেন ঘাটতি (বৈদেশিক মুদ্রা আয়-ব্যয়ের ফারাক) হ্রাস এবং বিশ্ব বাজারের তেজী অবস্থাও মদত জুগিয়েছে দুই ভারতীয় সূচককে।
শেয়ার সূচকের অবস্থান বেশ উপরে হলেও মোটের ওপর বাজারের স্বাস্থ্য কিন্তু তেমন ভাল নয়। সূচক দাঁড়িয়ে আছে মূলত তথ্যপ্রযুক্তি, ওষুধ এবং গাড়ি শিল্পকে ভর করে। মিড ক্যাপ এবং স্মল ক্যাপ তো বটেই, বেশ কিছু লার্জ ক্যাপ শেয়ারেরও অবস্থা বেশ খারাপই বলতে হবে।
এক রকম ধুঁকছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কিং শিল্প। জমে উঠেছে অনাদায়ী ঋণের পাহাড়। এই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসা কিন্তু খুব সহজ নয়। সেনসেক্সের শেয়ারগুলির ক্ষেত্রে দাম ও আয়ের অনুপাত এখন ১৬.৮১, নিফ্টির ১৭.৫৯, যা খুব উঁচু নয়। অর্থাৎ আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে, দাম বাড়ার জায়গা আছে। তবে মনে রাখতে হবে, মূল দুই সূচক ওঠা মানেই কিন্তু সামগ্রিক ভাবে বাজার ওঠা নয়। সামনে নির্বাচন। বাজারের গতিবিধির অনেকটাই নির্ভর করবে প্রাক্ এবং নির্বাচন-উত্তর পর্বে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কেমন থাকে, তার উপর। নজর থাকবে আগামী দিনে বিদেশি লগ্নি-প্রবাহের উপরেও, যা বাজারের একটি বড় শক্তি।
পাইকারি এবং খুচরো মূল্যবৃদ্ধি কিছুটা কমলেও তাতে আহ্লাদে আটখানা হওয়ার কারণ নেই। শীতকালে সব্জির দাম কিছুটা কমেই থাকে। দেখতে হবে শীতের শেষে আগামী মাসগুলিতে মূল্যমান কোথায় থাকে। এই কথা মাথায় রেখে রঘুরাম রাজন সুদ কমানোর কথা এখনও মাথায় স্থান দেননি। শিল্পের দুর্দিনে অর্থনীতিকে বড় মদত জুগিয়েছিল কৃষি। গত এক বছরে কৃষি উৎপাদন বেড়েছে ৪.৬ শতাংশ হারে। অদূর ভবিষ্যতে শিল্পোৎপাদনে বড় কোনও উত্থানের আশা নেই। অর্থাৎ এ বারও কৃষি যদি আগের মতো ইন্ধন না-জোগায়, তবে আগামী দিনে বড় বিপদ। সেই কারণে সবার এখন নজর থাকবে বর্ষা সম্পর্কে পূর্বাভাসের উপরে। |