|
|
|
|
|
শুধু ভাল থেকো বলাটাই সব নয়
আপনাকে আরও আন্তরিক হতে হবে। তবেই না সম্পর্কটা জমবে!
লিখছেন ঋতা ভিমানি। |
|
বেশ কিছু দিন ধরে একটা নতুন রেওয়াজ চালু হয়েছে।
কারও সঙ্গে হঠাত্ দেখা হলে, অতিথিকে বাড়ির দরজা অবধি এগিয়ে বিদায় জানাতে হলে বা টেলিফোনে কথা শেষ করার সময় আমরা বলি ‘টেক কেয়ার’। বা ‘ভাল থাকবেন।’
কিন্তু একটু ভেবে দেখুন! এই ‘ভাল থেকো’ কথাটা কী অর্থহীন... কী ইউজলেস!
আমার ব্যক্তিগত ধারণা, যাঁদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আমরা ‘ভাল থেকো’ দিয়ে শেষ করি, তাঁদের সম্পর্কে একটু বেশি জানা দরকার। শুধু ‘ভাল থেকো’ বললেই হবে না, যাঁকে উদ্দেশ্য করে এমন কথা বলছেন তিনি কী ভাবে ভাল থাকবেন তার একটা ইঙ্গিতও তো দিতে হবে। যাতে তিনি সত্যিই ভাল থাকার একটা পথ খুঁজে পান। মানে তাঁকে মানসিক ভাবে একটা ‘ফিল গুড’ অবস্থায় থাকতে সাহায্যও করতে হবে।
পরস্পরের সঙ্গে দেখা হলে আগুপিছু না ভেবেই আমরা বলি,‘কেমন আছেন?’ এই কেমন আছেন বলাটাও কখনও কখনও নিরর্থক। মানুষটা যদি সত্যিই ভাল না থাকেন, তাঁকে কেমন আছেন বলাটাই তো বিব্রত করা। তার চেয়ে অনেক বেশি দরকারি মানুষটাকে এমন কিছু বলা, যাতে তাঁর রোজকার জীবনে একটু আলো-বাতাস খেলে যায়। যাঁর সঙ্গে কুশল বিনিময় করছেন তিনি যদি কোনও সমস্যায় থাকেন বা অবসাদে, তাঁর আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনার টোটকা দিতে হবে তো। তাঁর মনে পজিটিভ ভাবনার সঞ্চার করতে হবে তো।
প্রশংসা করতে পারাটাও একটা আর্ট। মেয়েদের মন জয় করার জন্য ছেলেরা কেউ কেউ যে ভাবে গদগদ হয়ে প্রশংসা করে, সেটাকে মোটেই কমপ্লিমেন্ট দেওয়া বলে না। আত্ম-অহমিকা মানে ‘ইগো’ থেকে বেরিয়ে আসার শিল্পটা শিখতে পারলে তবেই না উজাড় করে অন্যের প্রশংসা করা যায়, বা নিজেকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে গুরুত্ব দেওয়া যায়।
প্রশংসা করার প্রবণতাটা অফিসেও জরুরি। কেউ সহকর্মীকে তাঁর কাজের জন্য প্রশংসা করতেই পারেন। সেটা তো ভাল কথা। কিন্তু আপনি কতটা পরিণত সেটা তখনই প্রমাণ হয়, যখন আপনি বসের সামনে সেই সহকর্মীর দরাজ প্রশংসা করার উদারতা দেখাতে পারেন। উচ্ছ্বসিত হয়ে প্রশংসা করলে আপনার ব্যক্তিত্ব কোথাও খাটো হয়ে যাবে এমনটাও নয়। কোনও সহকর্মীকে সাবাশি জানালে আপনার মধ্যে যে ভাল কাজের স্বীকৃতি দেওয়ার মনটা আছে সেটা বেরিয়ে আসবে। মেধাকে স্বীকার করার এই মানসিকতার জন্যই বস আপনাকে মনে রাখবেন।
এ বার আসি আটপৌরে জীবনে। যখন কেউ মারা যান তখনই তো আমরা পাহাড়প্রমাণ প্রশংসার ফুল বেলপাতা দিয়ে তাঁর একটা ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ মহিমা সৃষ্টি করে থাকি। কেন মৃত্যুর পর এত প্রশস্তি? বেঁচে থাকতে থাকতেই অন্যের কাজকে স্বীকৃতি দিন। প্রশংসা করুন। |
|
রাস্তায় কোনও পরিচিতের সঙ্গে হঠাত্ দেখা হলে তাঁর পোশাক-আশাক, স্টাইলের তারিফ করতে পারেন। কারও বাড়িতে নেমন্তন্ন খেয়ে কোনও না কোনও রান্নার পদ তো নিশ্চয়ই আপনার সুস্বাদু লাগে। সেই পদটির বিশেষ ভাবে প্রশংসা করুন। বাড়ির লোকের কথার তারিফ করে সেই কথার মধ্যে যে গভীরতা আছে তা অন্যদের সামনে তুলে ধরুন। বাড়ির রাঁধুনির প্রশংসা করতে পারেন ভাল রান্নার জন্য, ট্যাক্সি ড্রাইভার যদি সঠিক পথ ধরে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছে দিতে পারেন তাঁর প্রশংসা অবশ্যই করবেন। দারুণ গল্প বলা বয়স্কা মাসিমা থেকে পরীক্ষায় যথেষ্ট ভাল ফল না-করতে পারা ছাত্র বা ছাত্রী স্বীকৃতির দাবি থাকতে পারে কোনও না কোনও ভাবে তাঁদেরও। যদি কোনও ছাত্র বা ছাত্রী ভাল ফল না করে থাকে তবে এই ব্যর্থতার জায়গাটুকু বাদ দিয়ে তার মধ্যে বড়দেরকে শ্রদ্ধা করার, যত্ন করার যে প্রবণতা আছে তার প্রশংসা করুন। মোট কথা, নেগেটিভ দিকটা সরিয়ে রেখে যে কোনও মানুষের পজিটিভ গুণগুলোর প্রশংসা করুন।
প্রশংসা অনেক কঠিন বরফ ভেঙে দিয়ে জোগায় কথা বলার ভাষা। কারও যদি চওড়া প্রশংসা করেন, সঙ্গে সঙ্গে তার মধ্যে আপনার সঙ্গে কথা বলার একটা তাত্ক্ষণিক আগ্রহ তৈরি হয়ে যাবে। আর যদি লোকজনের সঙ্গে দেখা হওয়া মাত্রই রাজনীতির জটিল সমস্যা মারপ্যাঁচ নিয়ে আলোচনা শুরু করেন তা হলে কিন্তু ভাল সম্পর্ক গড়ে ওঠা দূরে থাক, পরস্পরের মধ্যে মনোমালিন্যও হয়ে যেতে পারে। রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে যদি হয়ই, ধর্মের প্রসঙ্গটা সযত্নে এড়িয়ে যান। এর মানে এটা নয় যে আড্ডা বা আলাপ থেকে রাজনীতি বা ধর্মের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাদ দেওয়া উচিত। বলতে চাইছি প্রথম আলাপেই ধর্ম-রাজনীতি এ সব টেনে আনবেন না।
মোদ্দা কথা, পাশের মানুষটিকে গুরুত্ব দিয়ে বিশেষ করে তুলতে হবে। এমন কিছু কথার সমাদর করতে হবে যাতে আপনার কথার ওপর ভর করেই তিনি জীবনের কয়েক কদম এগিয়ে যেতে পারেন। শুধু ‘ভাল থেকো’ বলাটুকুই নয়, অনুঘটকের কাজ করুক আপনার স্বীকৃতি আর প্রশংসা। যার ফলে সেই মানুষটি আশাবাদী ভাবে উদ্যমী হতে পারেন নিজের কাজে। প্রশংসা ঠিক কী নিয়ে করবেন এই প্রশ্নটা নিশ্চয়ই মাথায় ঘোরাঘুরি করছে? সঙ্গীর চেহারার প্রশংসা করতে পারেন। সরব হতে পারেন তাঁর কাজের দক্ষতা, মনোভাব, দৃষ্টিভঙ্গি বা বিশেষ কোনও গুণ নিয়েও।
কোনও মহিলাকে যদি বলেন তিনি খুব সুন্দর শাড়ি পরেছেন, সেটা কিন্তু কোনও ‘কমপ্লিমেন্ট’ হল না। প্রকাশ করতে হবে কী ভাবে সুন্দর শাড়িটা তাঁর সৌন্দর্যের আবেদন বাড়িয়ে দিয়েছে। কিংবা বলা যায় শাড়ির রংটায় কী অসাধারণ মানিয়েছে তাঁকে। কোনও মেয়ের সাজপোশাকের প্রশংসা করতে হলে বলতে হবে কী ‘ক্রিয়েটিভ’ ভাবে তিনি মিক্স অ্যান্ড ম্যাচ করে সেজেছেন। প্রশংসা যেন সাধারণ না হয়, তাতে যেন যাঁর প্রশংসা করছেন তাঁর স্বভাবের বা সৌন্দর্যের একটা বিশেষ দিক সুন্দর ভাবে ফুটে ওঠে।
পুরুষদের ‘কমপ্লিমেন্ট’ দেওয়ার ক্ষেত্রেও ওই একই কথা খাটে। কোনও পুরুষের শুধু কাজটুকুর স্বীকৃতি দিয়েই ক্ষান্ত হবেন না। সেই কাজ করতে গিয়ে যে কত কঠিন পরিস্থিতি তাঁকে পেরিয়ে আসতে হয়েছে সেটা মনে করিয়ে দিয়ে প্রশংসাকে আরও ব্যাপ্তি দিন। পুরুষদের ‘কমপ্লিমেন্ট’ দেওয়ার কায়দাটা হল, সাবাশি দিন তাঁদের কৃতিত্ব অর্জনের ক্ষেত্রে লেগে থাকার প্রবণতা, সহমর্মিতা, মননশীলতা, এবং যে কোনও পরিস্থিতিতে ধৈর্যে অটুট এবং শান্ত থাকার মনোবলকে। পুরুষেরা তাঁদের রসবোধের প্রশংসা করলে খুব খুশি হন। অফিসে কোনও পুরুষ সহকর্মী যদি কোনও ভুল কাজের প্রতিবাদ করে স্পষ্ট কথা বলেন, সঙ্গে সঙ্গে তার মর্যাদা দেওয়া উচিত। সেক্ষেত্রে সোজা উঠে গিয়ে বলা যায়, “স্পষ্ট কথা বলতে অনেক সাহস দরকার। আপনি বা আপনারা যে ভাবে এই পরিস্থিতিটাকে সামলালেন আমার পক্ষে সেটা কিছুতেই সম্ভব হত না।” এই কথা বলার পর দেখবেন সেই সহকর্মী আর কখনও আপনাকে তাঁর নিজের চেয়ে হীন বা কমতি ভাববেন না।
বরং আপনি দিনকে দিন তাঁর বন্ধুই হয়ে উঠবেন।
আরও কিছু মন্ত্রগুপ্তি দিতে পারি। মন থেকে আসছে না তবুও প্রশংসা করছেন এমনটা যেন না হয়। তবে হ্যাঁ, অন্যের ভাল দিকগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টাটাও চালিয়ে যাওয়া উচিত। প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই কিছু না কিছু ভাল গুণ থাকে। যদি খোঁজ চালিয়ে যান, দেখবেন একটা সময়ের পর নিজেরই মনে হচ্ছে একটা বিরল গুণ আপনি আয়ত্ত করে ফেলেছেন। আপনার সেই গুণ হয়তো আপনারই খুব কাছের কোনও মানুষের জীবনে পরম সৌভাগ্য হয়ে এল! কখনও কারও কোনও কাজে যদি আপনার এতটুকু উপকার হয়ে থাকে তা হলে তত্ক্ষণাত্ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবেন। অনেকেই আছেন যাঁরা উপকার পেয়ে তা স্বীকার করতে চান না। কৃতজ্ঞতা বা প্রশংসা করাটা তাঁদের কাছে নেহাতই মাথা নোয়ানো।
উপকারীর প্রশংসা করলে জানবেন সেই মানুষটির সঙ্গে আপনার বন্ধুত্ব আর এক ধাপ এগিয়ে গিয়েছে। মানুষের সঙ্গে থাকা, পাশে থাকায় জীবনটা অনেক বেশি অর্থবহ হয়ে উঠেছে।
ছোটোখাটো ‘কমপ্লিমেন্ট’ দেওয়াটাকে রোজের অভ্যেস করে নিন। তবে এমন প্রশংসা করবেন না, যাতে কেউ অকারণে নিজেকে বিরাট ভাবতে আরম্ভ করে! প্রশংসা করার পাত্র বা পাত্রীকে দেখে, শুনে, বুঝে নিন।
তার পরে বলুন ‘ভাল থেকো’। বলছিলাম না ‘ভাল থেকো’ বলাটাই শেষ কথা নয়।
|
|
|
|
|
|