• আনন্দবাজার পত্রিকার সঙ্গে যোধপুর পার্ক বয়েজ স্কুল ও বিদ্যা ভারতী গার্লস হাই স্কুলে গিয়ে নিজের ছোটবেলা কি ফিরে পেলে?
সত্যিই খুব ভাল লাগছিল। আমরা তো স্কুলে তুমুল দুষ্টুমি করতাম। সব সময় ছুতো খঁুজতাম কী করে কম ক্লাস করা যায়, বাঙ্ক করা যায়। বকাঝকাও খেয়েছি। কিন্তু স্কুল থেকে বেরনোর পর খুব মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। প্রথম ‘ব্যোমকেশ বক্সী’ রিলিজ করার পর আমায় পুরনো স্কুলে যেতে হয়েছিল একটা অনুষ্ঠানের সূত্রে। অবাক হয়ে দেখলাম, যাঁদের এত ভয় পেয়েছি, চোখ তুলে কথা বলতে পারিনি, তাঁরাই কেমন বন্ধুর মতো হয়ে গিয়েছেন। তাঁরা যখন আমায় বুকে টেনে বললেন, ‘তোমার কাজ দেখেছি, খুব ভাল লেগেছে, বাড়ির লোককে গর্ব করে বলি, এ এক দিন আমাদের ছাত্র ছিল’, সত্যিই ভীষণ আনন্দ হয়েছিল। সে দিন স্কুলে আমাদের ঘিরে ছোট থেকে বড়রা যে ভাবে হইচই করছিল সেটা দারুণ উপভোগ করছিলাম। এই ধরনের হুল্লোড়ের সঙ্গে আমি খুব পরিচিত যে!
• স্কুলের টিফিন টাইম...
স্কুলে চেষ্টা করতাম টিফিন টাইমের আগেই টিফিনটা শেষ করে ফেলার। কারণ সেই সময়টা ভরপুর খেলাধুলোর জন্য! কিন্তু এক দিন টিচারের কাছে ধরা পড়ে গেলাম। আমার তখন মুখভর্তি টিফিন। ‘এখন টিফিন খাচ্ছ কেন?’ প্রশ্ন ছুটে আসতে আমি মুখের খাওয়াটা শেষ করে খুব কাঁচুমাচু মুখে বলেছিলাম, ‘সকালে টিউশনে যেতে হয়েছিল, তার পরই সোজা স্কুলে চলে এসেছি। কিছু খাওয়া হয়নি তো, তাই।’ সুতরাং বেকসুর খালাস। কিন্তু বন্ধুদের কাছে পার পেলাম না। কারণ যে টিফিনটা খাচ্ছিলাম, সেটা অন্য আর এক জনের। সে যত ক্ষণে বুঝেছিল, তত ক্ষণে আমি পুরো টিফিনটাই সাবড়ে ফেলেছি। সে তো রাগে ফুঁসছিলই, অন্যরাও ফুঁসছিল। কারণ কারওরই আর ওই টিফিনের ভাগ পাওয়া
হল না।
• লুকিয়ে পড়া প্রথম বই?
ঠিক মনে নেই। তবে যখন ক্লাস সেভেন-এ পড়ি, আমার জন্মদিনটা খুব ঘটা করে পালন করা হয়েছিল। প্রচুর উপহার পেয়েছিলাম। বেশ কিছু বইও। কেউ এক জন আমাকে একটা ডিটেকটিভ বই উপহার দিয়েছিলেন। ঠিক ডিটেকটিভ না, সুপারস্পাই গোছের। অনেকটা জেম্স বন্ড-এর মতো। বড়দের বই। আমিও অমনি বাড়ির কাউকে কিছু না বলে বইটা পুরো পড়ে ফেলেছিলাম। তার পর স্কুলে বন্ধুদের জানাতে তাদের তো কী আনন্দ! বইটা যে কত হাত ঘুরেছিল কী বলব! বই পড়ার এই হ্যাবিট-টা কিন্তু এত কাজের মধ্যে এখনও রাখার চেষ্টা করি।
• তুমি তো নেক্সট ফেলুদা করছ। ফেলুদা এখন ইংরেজিতেও পাওয়া যায়। বাংলায় ফেলুদা পড়ে আমরা যে আনন্দ পেয়েছি, ইংরেজিতেও কি সেই আনন্দ পাওয়া যায়?
সত্যি বলতে কী, আমার মনে হয় না। কারণ ছোট থেকে বাংলায় ফেলুদা-ব্যোমকেশ পড়তে পড়তে আমাদের সামনে যেন গোটা গল্পটাই ছবি হয়ে ফুটে উঠত। এই ধরো ‘হোল্ড-অল’, তার পর ‘চাটুজ্জে’, ‘গেসলো’ এই সব কথার সঙ্গে আমরা যে ভাবে পরিচিত হয়েছি, তার স্বাদ তো ইংরেজিতে পাওয়া সম্ভব নয়। এখনকার ছেলেমেয়েরা যত ক্ষণ না এগুলো পড়বে, বুঝতে শিখবে, তত ক্ষণ এর মিঠে স্বাদটাই পাবে না।
• এখনকার অনেক ছেলেমেয়ে বাংলার চেয়ে ইংরেজিতে বেশি স্বচ্ছন্দ। ‘বাংলা আমার ভালভাষা’ আজকের দিনে কী ভাবে সম্ভব হবে?
ছোটবেলায় আমরা বন্ধুদের মধ্যে একটা খেলা খেলতাম। ধরো, মিনিট পাঁচেক সময় দেওয়া হল। ওইটুকু সময়ের মধ্যে কথা বলতে গিয়ে কোনও ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করা যাবে না। বললেই দশ পয়সা ফাইন। এখন যা পরিস্থিতি, তাতে প্রত্যেক দিন আমাদের এই খেলাটা খেলা উচিত। চারপাশ দেখেশুনে মনে হচ্ছে, সত্যিই বোধহয় আমরা বাংলা ভাষাটা আস্তে আস্তে ভুলে যাচ্ছি। কাজের ক্ষেত্রে ইংরেজি জরুরি। তাই বলে মাতৃভাষাকে অবহেলা? অন্য দেশ, এমনকী অন্য প্রদেশের মানুষও তাদের ভাষা নিয়ে ভীষণ গর্বিত। কিন্তু আমরা যেন মাতৃভাষায় কথা বলতে লজ্জা পাই। নিজের ভাষাটাকেও ভালবাসা দরকার। তাই বলে একটাও ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করবে না, সে তো হতে পারে না। তবে কথা বলার সময় যেন বাংলার প্রতি ভালবাসাটা থাকে এই ভাষা আমার ভাষা, আমার ভালবাসা।
পারলে ডায়রি লেখো। সারা দিন কী হল, ছুটির দিনে কী করলে। যখন সময় পাবে। বাংলাতে ডায়রি লিখতে লিখতে দেখবে ভাষাটা সড়গড় হয়ে গিয়েছে। ধরো, বাবা বাইরে গিয়েছেন, অনেক দিনের জন্য। তাঁকে একটা চিঠি লেখো না! বানান ভুল হল কি না, ঠিক মতো লিখতে পারলে কি না, সে সব পরে ভাববে। আগে তো লেখো। দেখবে, এক সময় ভাষাটা ঝরঝরে হয়ে গিয়েছে। |
সাক্ষাত্কার: সৌরজিত্ দাস। |