বুড়োরা মানুষ নয়। একটা কোনায় সোফার ওপর বেঁকেতেড়ে পড়ে থাকে, সেখানে জাস্ট মুন্ডু বাড়িয়ে ‘ক্কী দাদ্দু’ হাঁক পাড়তে হয়, তার পরেই সুড়ুৎ ঢুকে পড়তে হয় স্বাভাবিকদের ঘরে। যারা জীবন বাঁচছে, বাজেট ভাবছে, শপিং মল যাচ্ছে, অ্যাড দেখে গাড়ি কেনার শখ খুঁটছে, এসএমএসে জোক ফরওয়ার্ড করছে। বুড়োরা ল্যাগবেগিয়ে হাঁটতে চায়, পেছন থেকে গাড়ির অধৈর্য হর্ন খায়, রাত্রে বাথরুম অবধি পৌঁছবার আগেই করে ফেলে, হলদেটে নেত্র মেলে সারেন্ডার-চাউনি দেয়। কী করবে, মাইডিয়ারি ক্ষমাভিক্ষা-পোজ ছাড়া তার আছেটা কী, সারা দিনে ‘এখন খাবেন?’ বউমা কর্তৃক এই জিজ্ঞাসা ছাড়া তাদের দিকে একটা মানুষ-কথাও ধাবিত হয় না, হওয়ার মানেও নেই, সে তো জীবনের কামরায় নেই, মৃত্যুর ওয়েটিং রুমে বসে বসে ঢুলছে জাস্ট। সবাই মিলে পুরী যাওয়ার প্ল্যান হলে তাকে শান্টিং করা হবে মেজোমাসির বাড়ির না সেজোপিসির, সেই সভা তাকে না জানিয়েই বসে যায়, সে আড়ি পাততে গিয়ে নাতির আওয়াজ খেয়ে ফিরে আসে।
অথচ মানুষ যৌবন পেরতে না-পেরতেই মালুম পায়, এই যে সে অঙ্গুষ্ঠপ্রমাণ আত্মা ও গোল্লাচোখ-বালকের প্রাণ নিয়ে দুনিয়া দাবড়ে বেড়াচ্ছে, তার বাইরের খোলসটা সেই গণিত মানার পরোয়া করছে না। দিব্যি ২২ বছরের হৃদয় নিয়ে হাবলা-উঁকি মারতে মারতে সহসা উলট-ঝাপড়া খেয়ে সম্বিৎ ফেরে, শরীরের মিটারে দেখাচ্ছে ৪৩, ৪৬, ৫২। টাকে হাত বুলিয়ে ৪২ বছরের কিশোর বোঝে, ৪৫ বছরের শিশু বোঝে, এই শরীরেই বন্দি থেকে তাকে চলতে হবে একটা গোটা আয়ু। ক্রমাগত কুঁকড়ে যাওয়া চামড়া তার আসলি সত্তার সঙ্গে ভয়াবহ বেইমানি করবে। |
বাইশের পুরুষ ও ঊনআশির নারীর প্রেম। ফিল্ম: ‘হ্যারল্ড অ্যান্ড মড’ (১৯৭১) |
অথচ সে-ও বুড়োদের দেখে গোবর-ঘুঁটের সমীকরণটা বুঝতে পারে না। হাসে। ঝুলে পড়া গাল আর গলে যাওয়া দাঁত দেখে শিউরে মুখ ফেরায়। ওই বুড়ো লোকটাও যে তারই মতো ২৩ বা ২৬-এ আটকে নিজ খাঁচার মধ্যে হাঁকপাঁক করছে, তারও যে সমান লালসায় খেতে ইচ্ছে করছে চানাচুর ও চুমু, তা সে বোঝে না, ভাবলে তার গা ঘিনিয়ে ওঠে। বুড়োদের ভোটাধিকার থাকলেও, জীবনের সত্যি অধিকারগুলো তাই একে একে সকলেই টপাটপ নিভিয়ে দেয়, এবং তার জন্য কোনও যুক্তি ঝালিয়ে নেওয়ার ন্যূনতম প্রয়োজন বোধ করে না। আর সবচেয়ে, সবচেয়ে নিঃশেষে হৃত হয় বুড়ো মানুষের প্রেমের, কামের অধিকার। সর্বজনপূজিত রবিশঙ্করও সত্তর বছর বয়সে বিয়ে করার কথা বললে, মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারে ছিছিক্কার, খ্যালখ্যাল পড়ে যায়।
প্রণয়, যা নিয়ে গোটা পৃথিবী সারা ক্ষণ টগবগাচ্ছে, তাবৎ সিনেমা সিরিয়াল কাব্য আর্তনাদ যার বেদিপ্রক্ষালণে ব্যস্ত, তা বুড়োদের ক্ষেত্রে সপাটে ব্যান। কোনও বৃদ্ধ যদি কোনও যুবতীকে প্রেমপত্র ছোড়েন, তাঁকে ক্লাবের মাঠে অনায়াসে কান ধরে ওঠবোস করানো যায়, কারণ বুড়ো ভামের আবার প্রেমে অধিকার কই? কোনও বৃদ্ধা যদি বলেন, আমার নগ্ন যুবক দেখতে খুব ইচ্ছে করছে, তাঁকে পারভার্ট পাগলি বলে আঙুল দেখিয়ে ডিগবাজি খাওয়া যায়, বুড়ি পেত্নি কী করে সেক্সের কথা বলে? যে হেতু যৌনতার ক্ষমতা বয়সের সঙ্গে কমে, এবং প্রচলিত দৃষ্টি অনুযায়ী কামসুন্দর থাকার শরীরও বয়স এসে কেড়ে নেয়, তাই আমরা ধরে নিই, বুড়োদের ইচ্ছেগুলোও, তাল মিলিয়ে, জীর্ণ, স্খলিত, অন্ধ হয়ে আসবে। অথচ মানুষ মাত্রেই জানে, প্রত্যেক দুপুরে ‘আমার বেশ তিন কোটি টাকা থাকবে’ ভাবা চিরভিখিরি মাত্রেই জানে, ক্ষমতা আর ইচ্ছে হাত-ধরাধরি না-ই করতে পারে। নিজের বাস্তব সীমাবদ্ধতাগুলোর কাছে কিছুতে না হেরে বারবার অসম্ভবের আশা জাপটে উড়াল নেওয়া, এ-ই তো মানুষের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা, এবং সবচেয়ে বড় জোর! কিন্তু কোনও অশক্ত শরীরের ভেতর যখন তাজা আকাঙ্ক্ষা মাথা কুটে মরে, আমরা তার বেদনার মর্যাদাটা ভদ্রতা দিয়েও দিই না। প্রেম বা যৌন প্রস্তাব ত্বরিত-ফুঁয়ে প্রত্যাখ্যান করা যেতেই পারে, অপমান করার হক কোত্থেকে আসে? এই ধারণা থেকে: এখানে শুধু এক ব্যক্তি অন্য এক ব্যক্তির সঙ্গ যাচ্ঞা করছে না, এখানে বার্ধক্য ধর্মচ্যুত হয়ে যৌবনের মৌরসিপাট্টায় সিঁদ কাটছে। এখানে জীবনের এক প্রতিষ্ঠিত নিয়ম অতিক্রম করা হচ্ছে, শালীনতা সুন্দরতা ন্যায় লঙ্ঘিত হচ্ছে। এই জন্যেই ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে যখন দেখানো হয় ‘প্যারাডাইস: লাভ’, যেখানে পঞ্চাশ বছরের মহিলা একের পর এক দৃশ্যে তাঁর ভুঁড়িওলা, ঝুলে-যাওয়া, বেঢপ শরীর নিয়ে উলঙ্গ হয়ে পড়েন ও যুবক-শরীর ভোগ করতে চান, কলকাতার দর্শক অস্বস্তিতে মোড়ামুড়ি দেয়। পড়ে নিশ্চয়ই আপনিও ঝেঁকে উঠলেন, কারণ বার্ধক্য ও যৌবনের চুমুলালা-ভাগের ভাবনাটা আপনার কাছে নান্দনিক নয়, স্বস্তিময় নয়, তাই জড়াজড়িটার প্যাশনটার ওপরেই রি-রি ধরে গেল। অথচ আসল প্রশ্ন: যারা আশ্লেষ-বদ্ধ, তারা আনন্দিত কি না। আসল প্রশ্ন: অন্যের বাসনা, মুরোদ, সম্মতির ওপর ফতোয়া জারি করার অধিকার আমাদের কে দিয়েছে? আসল প্রশ্ন: ভদ্র ভাবে, অন্যের ক্ষতি না করে, কেউ নিজের তীব্র আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করলে তার কৈফিয়ত সে পৃথিবীর কারও বাবাকে দেবে কেন?
আর প্রেম? তাকে সেক্সের মাসতুতো বলে প্রচার করলে আমরা হাঁ-হাঁ করে উঠি, শরীরের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্কই নেই, শুধু এক চামচে হৃদয় ও তিন ফোঁটা ধবধবে কোল্ড ক্রিম মিশিয়ে বস্তুটি তৈরি নিশ্চিত থাকি, কিন্তু বুড়ো বয়সে নতুন প্রেম জাগলে প্যাঁক মেরে ছাল ছাড়িয়ে নিই। অথচ, দেহের বলিরেখার সঙ্গে হৃদয়ের মরচের সম্পর্ক কী? এক জন ষাট বছরের মানুষের মন কেন প্রেম অনুভব করার অধিকার হারিয়েছে? কেনই বা তার মন শুধু নিজের বয়স-ব্র্যাকেটের লোকের হৃদয়কে ভালবাসতে পারে? ষাট বছরের লোকের হৃদয় যেমন অন্য এক ষাট বছরের লোকের হৃদয়কে ভালবাসার অধিকার রাখে, তেমনই তিরিশ বছরের লোকের হৃদয়কেও ভালবাসার সমান অধিকার রাখে। কিন্তু আমরা গোঁয়ার ঘাড় বেঁকিয়ে বলব, উঁহু, থিয়োরি ছাড়ো, মানাচ্ছে না। বুড়ো বয়সে কোনও নতুন চেষ্টাই মানানসই নয়, নতুন ভালবাসা-চেষ্টা তো নয়ই, কারণ ভালবাসাও, আমাদের আসলি মতানুযায়ী, টনকো ত্বকের সম্পত্তি, হৃদয়ের নয়।
এই সিনারিতে, এই ‘আমাদের অভ্যেসে ও অ-ভাবনায় যা জার্ক দেবে তাকেই পাটকেল ছুড়ব’ প্রান্তরে, চেন্নাইতে হপ্তাখানেক আগে হয়ে গেল বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের লিভ-ইন পার্টনার খোঁজার ক্যাম্প ‘লাভ এগেন’, আয়োজনে ‘বিনা মূল্য অমূল্য সেবা’ এনজিও। ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই সংগঠন বহু শহরে বহু বছর ধরেই এমন ক্যাম্প করছে। যদিও এই অনুষ্ঠানের প্রোফাইল ঠিক প্রণয়-প্রোমোটার’এর নয়, বরং নিঃসঙ্গতা-নাশকের, আমরা সে আস্তরণ সরিয়ে, বয়সের রাজনীতির বিরুদ্ধে এক জরুরি পদক্ষেপ বলে একে স্যালুট করতে পারি। চোখ বড় করে তাকালে বোঝা যায়, সারা পৃথিবীর সব আয়োজনই যৌবনের জন্য। বুড়োদের জন্য যদি বা কিছু চেষ্টা, তার মূলে একটি আহা, দুটি চুকচুক। ব্যাটারা স্ক্র্যাপ মাল, এট্টু সিমপ্যাথি দিলুম। তাই যদি কোনও কাজের সূত্রে বুড়োদের বলা যায়: নিজেকে উদযাপন-অধিকারের পতাকা ডেঁটে ওড়ান, যৌবনের কাছে হাতজোড় করে না-বেঁচে, প্রথা ও বয়স-সাম্প্রদায়িকতার পিচুটিকে লাত্থি মেরে, নিজের দাপটের রাজ্যে জেগে উঠুন, ভোগের ইচ্ছেপ্রকাশে অলজ্জিত আনন্দিত হোন তবে সভ্যতা তার সমঝদারির পথে কিয়দ্দূর এগোতে পারে। |