সম্পাদকীয়...
মন্থর পুলক
দানীং বিদেশে ‘স্লো টিভি’-র প্রতিপত্তি বাড়িতেছে। উহার অর্থ, এমন টিভি-অনুষ্ঠান, যাহার অন্দরে কোনও নাটকীয়তা নাই, প্যাঁচ-পয়জার নাই, সর্বোপরি, উহা এমন একটি ঘটনা দেখাইতেছে, যাহার গতিটি অতীব মন্থর। নরওয়ের এক প্রসিদ্ধ চ্যানেল ২০০৯-এ দেখাইয়াছিল একটি সাত ঘণ্টার ট্রেন-যাত্রার সরাসরি সম্প্রচার। উহার পরে তাহারা ১৩৪ ঘণ্টার এক নৌযাত্রাও দেখাইয়াছিল। গত বৎসর তাহারা ১৮ ঘণ্টা ধরিয়া দেখায় স্যামন মাছের সাঁতার, ১০০ ঘণ্টা ধরিয়া একটি দাবা খেলা। জার্মানিতেও ট্রেনযাত্রা দেখাইবার চল রহিয়াছে। বহু পূর্বে, ১৯৬৩ সালে প্রসিদ্ধ ভাঙচুর-ধর্মী শিল্পী অ্যান্ডি ওয়ারহল ‘স্লিপ’ নামে চলচ্চিত্র তুলিয়াছিলেন, যাহাতে পাঁচ ঘণ্টা কুড়ি মিনিট ধরিয়া এক ঘুমন্ত ব্যক্তিকে দেখানো হইয়াছিল (সঙ্গে স্থিরচিত্র)। সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত মার্কিন ছবি ‘হার’, যাহা এক প্রযুক্তিসর্বস্ব ভবিষ্যৎ-পৃথিবীর কাহিনি বিবৃত করে, এক চরিত্রকে দেখায়, যে তাহার নিদ্রামগ্ন মাতার চলচ্ছবি তুলিতে ব্যস্ত। কিন্তু ইদানীং যে কোনও শিল্প বলিতে তো মানুষ বোঝেন এমন সৃষ্টি, যাহা দৈনন্দিন জীবনের গতানুগতিকতা হইতে পলায়নের পথ গড়িয়া দেয়, উপর্যুপরি বৈচিত্র ও নূতনত্ব দিয়া দর্শককে প্রতি মুহূর্তে প্রফুল্ল ও উত্তেজিত করিয়া তোলে। সন্ধ্যায় চুপ করিয়া বসিয়া থাকিতে অসহ্য লাগে বলিয়া সে টিভির মধ্য দিয়া এমন এক জগতে ঢুকিয়া পড়ে, যেখানে অসংখ্য চক্রান্ত ও তাহা হইতে উদ্ধারের ঘনঘটা তাহার হৃদয়কে বিরতিহীন ভাবে ব্যাপৃত রাখিবে। ফলে টিভি একটি ধীরতা-বিরোধী, দ্রুতি-পূজক ও পৌনঃপুনিকতা-নাশক যন্ত্র। সেই টিভিতে তবে এই মন্থর অনুষ্ঠানগুলি আমল পাইতেছে কী করিয়া? এক জন বসিয়া বসিয়া পশম বুনিতেছেন, বা কুয়াশার মধ্য দিয়া একটি স্থির অট্টালিকা দেখা যাইতেছে, ইহার প্রতি মুগ্ধ দৃষ্টিপাতের রহস্যটি কী?
এমন হইতে পারে, মানুষ সর্বক্ষণ প্রবল দ্রুতির বিস্ফোরণের মধ্যে থাকিয়া এখন বিশ্রাম চাহিতেছেন। যেমন কাল্পনিক কাহিনির আধিক্যে অস্থির হইয়া দর্শক এখন রিয়েলিটি শো বা নন-ফিকশনের প্রতি হেলিয়া পড়িয়াছেন, তেমনই হয়তো ছবি ও ভাবনার উচ্চণ্ড নাগরদোলায় সওয়ার হইয়া পলক ফেলিতে না ফেলিতে পট ও প্লট পরিবর্তন আর তাঁহারা গ্রহণ করিতে পারিতেছেন না। দূরদর্শনে বহু পূর্বে গৃহীত সাক্ষাৎকারগুলি এখন চ্যানেল বদলাইতে বদলাইতে সহসা চোখে পড়িয়া গেলে যেমন থামিয়া চোখ ভরিয়া দেখিতে ইচ্ছা হয়। ওই ধীরে কথা বলা, বহু সময় ধরিয়া এক জন মানুষকে জানিতে চাহিবার মধ্যে যেন এক আত্মার আরাম রহিয়াছে। ওই ধীরতা এমন এক কালখণ্ডের দ্যোতক, যখন দশ সেকেন্ডের মধ্যে মানুষকে কিনিয়া ফেলিবার দায় অনুভূত হইত না, শ্রদ্ধা ও মনোযোগ সহকারে ঘটনা বা ব্যক্তিকে যথাযথ মর্যাদা প্রদান করা হইত। হয়তো ট্রেনযাত্রা বা মৎস্য-শিকার সম্প্রচারের মধ্যে সর্বক্ষণের মেকিত্ব হইতে এমন এক মুক্তি রহিয়াছে, যাহা বাস্তবকে লইয়া এলাইয়া বসিবার সুযোগ দেয়, এমনকী অন্যমনস্ক হইবার ক্ষমাসুন্দর অবকাশও। যখন প্রতিটি মুহূর্ত নিঃশেষে চাখিয়া লইতে হইবে দাবি লইয়া কোনও হনুমান পিছনে ধাওয়া করে না। এই ধরনের অনুষ্ঠানে জীবনের খুঁটিনাটিগুলিও অধিক মাত্রায় চোখে পড়িবার সম্ভাবনা থাকে। ট্রেনের ইঞ্জিনে ক্যামেরা থাকিলে বহু ক্ষণ ধরিয়া রেলপথ ও তৎসংলগ্ন নিসর্গ দেখিতে দেখিতে আমরা বৃহৎ পৃথিবীকে চিনিয়া লইতে পারি, যাহা ট্রেনে থাকিবার সময়ও নজর এড়াইয়া যায়। হয়তো আমাদের মনে উদিত হইতে পারে, প্রকৃতি ও তাহা চিরিয়া মানুষের কৃত্রিম নির্মাণ, টানেল ও বাহিরের আলো-আঁধারির খেলা, ট্রেনের চালকের নিরন্তর মনোযোগের প্রয়োজন ও দুঃসাধ্যতা, এই রূপ নানা প্রসঙ্গ। সর্বোপরি, এই অনুষ্ঠানগুলি হয়তো নিজের ভাবনা শুনিবার সুযোগ প্রদান করে। যাহা, এই নিজেকে সর্বক্ষণ অবান্তর আমোদে নিমজ্জিত রাখিবার অন্তহীন স্রোতে, নিতান্তই বিরল।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.