মাথা নিচু করে বিড় বিড় করতে করতে ড্রেসিংরুমে ফিরছিলেন করিম বেঞ্চারিফা।
আপন মনে কী বলছিলেন বাগান কোচ? শেষ মুহূর্তে মুখের গ্রাস কেড়ে নেওয়ার জন্য চার্চিলের বলবন্ত সিংহকে ‘অভিশাপ’ দিচ্ছিলেন? নিজের কপালকে দুষছিলেন? না কি নিশ্চিত গোল নষ্ট করা কাতসুমিকে গালাগালি?
করিম কী বলছিলেন মনে করতে পারেননি সাংবাদিক সম্মেলনে আসার পথে! আফশোস, হতাশা বাক্সবন্দি করে রেখে তাঁর মুখ থেকে শুধু বেরিয়েছে, “আর একটাই সুযোগ আছে এই মরসুমে ক্লাবে আলো জ্বালাবার। সেটা সামনের ডার্বি। ছেলেদের ড্রেসিংরুমে বলে এলাম, আজ যখন জিততে পারলে না ডার্বির জন্য তৈরি হও।”
পুরো পয়েন্ট না পেলেও, মোহনবাগান যা খেলল তাতে পয়লা মার্চের ডার্বি জেতার স্বপ্ন দেখতেই পারেন করিম। এর মধ্যে অতিশয়োক্তি কিছু নেই। কিন্তু এর পরেই যে প্রশ্নটা উঠবে তা হল, জেতার জন্য বাগানের হয়ে ইস্টবেঙ্গলের জালে সে দিন বল পাঠাবেন কে? কাতসুমি, ক্রিস্টোফার, সাবিথ...? কার উপর ভরসা করবেন বাগান সমর্থকরা? নিশ্চিত গোল নষ্ট করলে জরিমানার রেওয়াজ এখনও চালু হয়নি বাগানে। যদি সেটা থাকত তা হলে, মরসুম শেষে এই তিন জনের কেউ হয়তো এক টাকা নিয়েও বাড়ি ফিরতে পারতেন না।
ফেড কাপ চ্যাম্পিয়নদের বিরুদ্ধে কত গোলে জিততে পারত করিম ব্রিগেড? মোহন কোচ বললেন, “৪-১, ৩-২ হতেই পারত। আমরা জিততেই পারতাম।” কেন হল না? “কেন আবার, বলবন্তের ব্যক্তিগত নৈপুন্যের কাছে আটকে গেলাম।” |
উড়ন্ত থাপা, আটকে গেলেন সাবিথ। |
ম্যাচ শুরুর আগে মনে হয়েছিল, সুভাষ ভৌমিক বনাম করিম বেঞ্চারিফার লড়াইটা তুল্যমূল্য হবে। স্ট্র্যাটেজির লড়াইয়ে ম্যাচটা হয়ে উঠবে উত্তেজক। ধুন্ধুমার। কিন্তু কোথায় কী? বেশির ভাগ সময়ই খেলাটা ঢলে রইল বাগানের পক্ষে ৬০-৪০। বল পজেসন থেকে বল কেড়ে নেওয়া, কোচের নিখুঁত অঙ্কের সফল রূপায়ণ থেকে প্রেসিং ফুটবলসবেতেই বাড়তি নম্বর পেয়ে গেলেন করিম। তাঁর দুর্ভাগ্য, কোনও বলবন্ত সিংহ ছিলেন না বাগানে! যিনি গোল করায় একশোয় একশো পেতে পারেন। দু’টো সুযোগদু’টো গোল। সুনীল ছেত্রী ছাড়া আর কোনও ভারতীয় স্ট্রাইকারকে বলবন্তের পাশে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। “শেষ মিনিট পর্যন্ত লড়তে হয়। জেসিটির অ্যাকাডেমিতে ছাত্র থাকার সময় শেখাতেন কোচেরা। তার সুফল পেলাম আজ,” বলছিলেন বাগানে বসন্ত আটকে দেওয়া পঞ্জাবের ছেলেটি।
বলবন্তের মাটিতে ঠুকে দেওয়া হেডের বল থেকে গোল শুরুতে এগিয়ে দিয়েছিল চার্চিলকে। ১-০ থেকে ১-১ হয়ে গেল এক মিনিটের মধ্যেই। চার্চিলের আত্মঘাতী গোলের সৌজন্যে। তারপর পেনাল্টি থেকে বাগানের ২-১। এবং ম্যাচের শেষ মিনিটে বলবন্তের অসাধারণ গোলে ম্যাচ ২-২। বাঁ পায়ের কোনাকুনি শটটা যখন বাগানের জালে আছড়ে পড়ল তখন শিল্টন পাল দর্শক। খেলা দেখতে আসা চার্চিল আলেমাওকে দেখা গেল, ম্যাচের সেরাকে জড়িয়ে চুমু খেতে। চার্চিল কোচ মারিয়ানো ডায়াসও স্বীকার করে গেলেন, “আমরা খেলতেই পারিনি। আমাদের সৌভাগ্য এক পয়েন্ট পেয়েছি এবং সেটা বলবন্তের জন্য।”
চার্চিল-ঝড় ফেড কাপ সেমিফাইনালে বাগানকে শেষ করে দিয়েছিল শুরুর মিনিট কুড়ির মধ্যেই। এ দিন ওই সময় দেখা গেল উলাটপুরান। রীতিমতো ঝড় তুলে বাগান কোণঠাসা করে ফেলেছিল গোয়ার ক্লাবকে। তেরো মিনিটের মধ্যেই কোচির হারের বদলা নেওয়ার সুযোগ এসেছিল বাগানের সামনে। হল না। কাতসুমি নামক এক গোল-কানা জাপানির জন্য। দুটো সহজতম গোলের সুযোগ নষ্ট করলেন তিনি। যা দেখে কপাল চাপড়াতে দেখা গেল করিমকে। রিজার্ভ বেঞ্চে বসে থাকা সুভাষকেও উঠে দাঁড়াতে বাধ্য করল। এবং চিৎকার করতে করতে সাইড লাইনের ধারে পৌঁছে গেলেন চার্চিল টিডি।
ভারতে যে ক’জন বিদেশি কোচ এখন আছেন তাদের মধ্যে ম্যাচ রিডিংয়ে করিম এক বা দু’নম্বরে থাকবেন। চার্চিলের মাঝমাঠের দুই সেরা বাজি শাবানা আর লেনিকে জোনাল মার্কিংয়ে বেঁধে দিয়ে সেটা বুঝিয়ে দিলেন শুরু থেকেই। সেকেন্ড বল ধরার জন্য দারুণ ভাবে নিজেদের ব্যবহার করল বাগান রক্ষণ। বিরতির পর সাবিথকে স্ট্রাইকার করে দিলেন করিম। মাঝমাঠে নিয়ে এলেন কাতসুমিকে। মোহন-কোচের এই চালও মস্তিষ্কে শান দিয়ে আসার সুফল। পাল্টা কোস্তারিকার লাগোসকে নামিয়েও সুবিধা করতে পারলেন না সুভাষ। দু’একটা কর্নার আদায় ছাড়া। |
ম্যাচের নায়ক বলবন্তকে করিমের অভিনন্দন। |
রাভাননের শুশ্রূষা। |
|
তবে ম্যাচের শেষ মিনিট পর্যন্ত চার্চিল যে এগারোজনই রইল সে জন্য দিল্লির রেফারি উমেশ বোরাকে শনিবার লাঞ্চ টেবিলে ডাকতেই পারেন সুভাষ। দুটো নিশ্চিত লালকার্ড থেকে তাঁর টিমকে বাঁচিয়ে দেওয়ার জন্য। ক্রিস্টোফারকে বিশ্রী ফাউল করেছিলেন চার্চিল কিপার ললিত থাপা। বাগান পেনাল্টি পেলেও ললিতকে হলুদ কার্ড দেখিয়েই ছেড়ে দেন রেফারি। বাইরে যাওয়ার কথা রাভাননেরও। চার্চিল স্টপার যেভাবে রাম মালিককে গলা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলেন, ফিফার নিয়মে সেটা লালকার্ড দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। তা ছাড়া এই ঘটনার পর চার্চিলের জনা চারেক ফুটবলার যে ভাবে রেফারিকে ধাক্কাধাক্কি করেও ছাড় পেয়ে গেলেন, তা দৃষ্টিকটু।
অবনমন হয়তো হবে না বাগানের। এক পয়েন্ট, এক পয়েন্ট জোগাড় করে পারের কড়িও জুটে যাবে। আর্সেনালের আট বছর ট্রফি নেই। তাদের সমর্থকরা প্রথম চারের মধ্যে থাকতে পারলেই খুশি হন। ধরে নেন, মরসুমটা ভালই শেষ হয়েছে। বাগানের অবস্থা এখন অনেকটা সেরকমই। চার বছর ট্রফি নেই। আই লিগের প্রথম চারে ঢোকারও সুযোগ নেই। তবে করিমের দলের সামনে একটা ট্রফি আছে এখনও—সেটা ডার্বি ট্রফি। নাকের বদলে নরুন।
মোহনবাগান: শিল্টন, প্রীতম (শৌভিক), ইচে, রোউইলসন, আইবর, রাম (উজ্জ্বল), জাকির (সাবিথ), ডেনসন, পঙ্কজ, কাতসুমি, ক্রিস্টোফার। |