ইউক্রেন অগ্নিগর্ভ। সেই আগুন কেবল রাজধানী কিয়েভ নয়, সমগ্র দেশকেই উত্তপ্ত করিতেছে। কিয়েভের কেন্দ্রস্থল ‘স্বাধীনতা-বাগ’-এ বিক্ষোভকারীদের সহিত সরকারি পুলিশ ও সেনাদের সংঘর্ষ রক্তক্ষয়ী হইয়া উঠিয়াছে। অবরুদ্ধ বাগকে মুক্ত করিতে গিয়া মঙ্গলবার রাতের সংঘর্ষে সেখানে অন্তত ২৮ জনের মৃত্যু হয়, যাহাদের অর্ধেকই পুলিশ। বুধবার আরও ৭১ জন বিক্ষোভকারী নিহত হইয়াছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ইয়ানুকোভিচের সরকারের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারির হুমকি দিয়াছে। অন্য দিকে ইউক্রেন সরকার এবং রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন উভয়েই কিয়েভের বিক্ষোভ-প্রতিবাদকে ‘সামরিক অভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্র’ আখ্যা দিয়া তীব্র দমননীতি নামাইবার হুঙ্কার দিয়াছেন।
অথচ কয়েক সপ্তাহ আগেও পরিস্থিতি এমন ছিল না। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরও রাশিয়া যে ইউক্রেনকে তাহার প্রভাবাধীন রাখিতে সচেষ্ট থাকিবে, ইউরোপ তাহা শিরোধার্য করিলেও ইউক্রেনের জনসাধারণ রাশিয়ার পরিবর্তে ইউরোপের সঙ্গেই নিবিড়তর নৈকট্য স্থাপনে আগ্রহী ছিল। সেই আগ্রহ ক্রমে ইউরোপের সহিত চুক্তিবদ্ধ হওয়ার প্রস্তুতি লইলে শেষ মুহূর্তে রাশিয়ার অঙ্গুলিহেলনে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট পিছু হটেন, যাহার প্রতিবাদে দেশব্যাপী তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। কালক্রমে সেই ক্ষোভ প্রশমিত হইতেছিল। বিক্ষোভকারীদের কিছু দাবি কর্তৃপক্ষ মানিতেছিলেন। ধৃত প্রতিবাদীদের পাইকারি মুক্তির সিদ্ধান্ত হয়। প্রেসিডেন্টের একচ্ছত্র ক্ষমতা কমাইয়া নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিসভাকে অতিরিক্ত ক্ষমতা দিতে সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব পর্যন্ত করা হয়। বিক্ষোভকারীরা অবরোধ তুলিয়া ঘরে ফেরার তোড়জোড় করিতেছিলেন। কিন্তু আন্দোলনে শামিল কিছু জঙ্গি, দক্ষিণপন্থী উগ্র-জাতীয়তাবাদী, রকমারি সরকার-বিরোধী গোষ্ঠী গোল পাকাইতে শুরু করিলে কিয়েভ পুনরায় অগ্নিগর্ভ হইয়া ওঠে। অতঃপর সংঘর্ষ, বহুসংখ্যক মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু।
দুর্ভাগ্য, ইউক্রেন বর্তমানে ইউরোপ বনাম রাশিয়ার প্রভাবাধীন এলাকা বিস্তারের প্রতিযোগিতা তথা প্রক্সি-যুদ্ধের শিকার। তাই বিক্ষোভকারী বিভিন্ন প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে যেমন ইউরোপ প্রচ্ছন্নে প্রশ্রয় দিতেছে, বিপরীতে রাশিয়া ভিক্টর ইয়ানুকোভিচের নিরঙ্কুশ ক্ষমতার প্রয়োগ চাহিতেছে। ইউরোপীয় আর্থিক সাহায্যের তহবিল উপেক্ষা করার জন্য আরও বিপুল অঙ্কের অনুদানের থলি লইয়া পুতিন আগেই ইউক্রেনের পশ্চিমমুখী পদক্ষেপ নিরস্ত করিয়াছেন। তাহার পরেও কেন ইউক্রেনবাসী পশ্চিমের দিকে হাত বাড়াইবে, সেটা ক্রেমলিনের কর্তাদের কাছে অসহ্য। তাহাতেই ‘সামরিক অভ্যুত্থান’-এর ভূত দেখা। গণতন্ত্রে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ ইত্যাদি যে বৈধ, সঙ্গত এবং কার্যত অপরিহার্যও বটে, দীর্ঘ কাল সোভিয়েত স্বৈরাচারে অভ্যস্ত রাশিয়া বা তাহার সাবেক উপগ্রহ-প্রজাতন্ত্রগুলির উপলব্ধির মধ্যে তাহা নাই। তাহারা তাই ইউক্রেনবাসীর অভিপ্রায়কে নিজেদের ইচ্ছাধীন করিতে ব্যস্ত, না পারিলে সেই অভিপ্রায়কে ষড়যন্ত্র বা চক্রান্ত আখ্যা দিতে দ্বিধাহীন। আবার প্রতিবাদের গণতান্ত্রিক অধিকারের সুযোগ লইয়া দুর্বৃত্ত, সমাজবিরোধী, হিংসাশ্রয়ী বিভিন্ন গোষ্ঠী যখন বোমা-বন্দুক লইয়া গণবিক্ষোভে মিশিয়া যায়, জনতার অন্তরালকে ঢাল বানাইয়া রাষ্ট্রশক্তিকে চোরাগোপ্তা আক্রমণ করে, তখন সেই নাশকতার শক্তিগুলিকে শনাক্ত ও বিচ্ছিন্ন করাও জরুরি। অন্যথায় শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক প্রতিবাদই লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার আশঙ্কা। উভয় পক্ষকেই সতর্কতার সহিত মীমাংসার পথে আগাইতে হইবে। |