|
|
|
|
কত দেরি হলে ফাঁসি রদ, জবাব অধরা |
নিজস্ব সংবাদদাতা • নয়াদিল্লি
২১ ফেব্রুয়ারি |
প্রথমে ফাঁসির দড়ি থেকে মুক্তি। তার পর জেল থেকেই ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত। এবং সেই সিদ্ধান্তের উপরে স্থগিতাদেশ। রাজীব হত্যাকারীদের শাস্তি ঘিরে ক্রমেই দানা বাঁধছে বিতর্ক।
রাজীব গাঁধীর সাত হত্যাকারীকে মুক্তি দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতা নিয়েছেন, তার বিরোধিতা করে লোকসভা ভোটের মুখে প্রচারে নামছে কংগ্রেস। আবার জয়ার সিদ্ধান্ত সুপ্রিম কোর্টে আটকে যাওয়াকে স্বাগত জানালেও তিন খুনির মৃত্যুদণ্ড মকুব করে দেওয়ার রায় পছন্দ হয়নি দলের শীর্ষ নেতৃত্বের। তাঁদের মতে, শীর্ষ আদালতের এই রায় ঘিরে বিতর্কের অবকাশ রয়েছে।
কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী কপিল সিব্বলের কথায়, “প্রতিটি মামলায় অপরাধের গুরুত্ব বুঝে বিচার করা উচিত। মৃত্যুদণ্ড দিতে দেরি হলে অপরাধ কোনও ভাবে লঘু হয়ে যায় না। যে কারণে আমরা মৃত্যুদণ্ড রদ করে যাবজ্জীবন কারাবাসের রায় পুনর্বিবেচনার আর্জি পেশ করেছি। আদালত যে স্থগিতাদেশ জারি করেছে, সেটি স্বাগত। তাকে মূলধন করে আমরা প্রচারে নামব।”
কোনও অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত কিনা, তা নিয়ে গোটা বিশ্বেই বিতর্ক রয়েছে। এ দেশেও সংসদ হানা মামলায় আফজল গুরুর ফাঁসি নিয়ে বিতর্ক কম হয়নি। বিজেপি বিষয়টিকে রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত করেছিল। মুম্বই সন্ত্রাসের ঘটনায় ধৃত আজমল কসাবকে ফাঁসি দিতে দেরি হওয়া নিয়েও সমালোচনায় সরব হয়েছিল তারা। কিন্তু সেই দাবির বিরোধী স্বরও কম শোনা যায়নি। বিজেপি নেতা তথা বিশিষ্ট আইনজীবী অরুণ জেটলির মতে, “এটা ঠিক যে, বিভিন্ন দেশ মৃত্যুদণ্ড বিলোপের পথে হাঁটছে। আমাদের দেশেও এ নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে। কিন্তু গত তিন দশক ধরে যে ভাবে সন্ত্রাসবাদ মাথাচাড়া দিয়েছে, সেই অবস্থায় এটি বিলোপ করা কি যুক্তিসঙ্গত?”
সুপ্রিম কোর্টের বক্তব্য, ফাঁসি দেওয়া উচিত, না উচিত নয়, এই নৈতিক দোলাচলে প্রাণভিক্ষার আবেদন অনির্দিষ্ট কাল ফেলে রাখা চলে না। কিন্তু সেই সময়কাল কতটা হওয়া উচিত, তা নিয়ে তারাও এক-এক সময় এক-এক কথা বলেছে। গোড়ায় শীর্ষ আদালতের মত ছিল, প্রাণভিক্ষার আর্জি দু’বছরের মধ্যে নিষ্পত্তি হওয়া উচিত। পরে পাঁচ সদস্যের ডিভিশন বেঞ্চ আবার বলে, এ ব্যাপারে কোনও সময়সীমা থাকতে পারে না। রাজীব হত্যাকারীদের মৃত্যুদণ্ড খারিজ করতে গিয়ে প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ কোনও সময়সীমার কথা বলেনি ঠিকই। কিন্তু তাদের মতে, ১১ বছর ধরে আর্জি ফেলে রাখাটা কোনও কাজের কথা নয়।
সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ে কংগ্রেস অখুশি হলেও রাজীবের খুনিরা যে ফাঁসির দড়ি থেকে পার পেয়ে গেল, সে জন্য তাদেরই দুষছে বিজেপি। জেটলির কথায়, “প্রাণভিক্ষার আর্জি বিবেচনার ক্ষেত্রে বিনা ব্যাখ্যায় অযথা দেরির জন্য সুপ্রিম কোর্ট সম্প্রতি মৃত্যুদণ্ড মকুব করেছে। এই দেরি বিভিন্ন কারণে হয়। কখনও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক, কখনও রাজ্য সরকার মতামত দিতে দেরি করে। কখনও আবার রাষ্ট্রপতি ভবনে আর্জি পড়ে থাকে দীর্ঘদিন। এই দেরির দায় কার, সেই দায়িত্ব তো বেঁধে দিতেই হবে।”
মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ক্ষেত্রে দেরির রেকর্ড অবশ্য রাজীব হত্যা মামলার নয়। আমেরিকায় রবার্ট কেনেডির হত্যার ৪৫ বছর পরেও খুনির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়নি। তার প্রাণভিক্ষার আর্জি একাধিক বার খারিজ হওয়ার পরেও।
অনেকে অবশ্য মনে করছেন, প্রাণভিক্ষার আর্জি বিবেচনায় দেরির কারণে মৃত্যুদণ্ড রদ হওয়া ঘিরে বিতর্কের থেকেও বড় বিতর্ক হল, রাজীব হত্যার সাত অপরাধীকে একেবারে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত। এই আইনজ্ঞদের মতে, মানবিক দিক থেকে বিচার করে মৃত্যুদণ্ড রদ করার অর্থ তো এটা নয় যে তাদের অপরাধ লঘু হয়ে গেল! এ ক্ষেত্রে যাবজ্জীবন কারাবাসের অর্থ নির্দিষ্ট কিছু বছর না হয়ে আমৃত্যুই হওয়া উচিত। ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে হল না, এটাই তাদের একমাত্র প্রাপ্তি হওয়া উচিত। বস্তুত কংগ্রেস নেতারাও এই বিবেচনা থেকেই প্রতিটি মামলার গুরুত্ব বিচার করে রায় দেওয়ার কথা বলছেন।
আইনজীবী মহলের একাংশ আবার বলছে, প্রধান বিচারপতি পি সদাশিবম নিজে তামিল। তাঁর নিরপেক্ষতা নিয়ে কোনও প্রশ্ন না তুললেও এই মামলার বিচারের ভার না-নিলেই সম্ভবত তিনি ভাল করতেন।
যে তামিল আবেগের কথা বিবেচনা করে আইনজীবী মহলের একাংশ এ কথা বলছেন, সেই আবেগের রাজনীতির অঙ্কেই যাবতীয় বিতর্কের তোয়াক্কা না-করে রাজীবের সাত খুনিকেই মুক্তি দেওয়ার কথা ঘোষণা করে দিয়েছেন জয়ললিতা। অঙ্কে যে কোনও ভুল নেই, তার প্রমাণ, মুখ্যমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করতে পারেনি তামিলনাড়ুর কোনও দলই। এমনকী জাতীয় স্তরে কংগ্রেস নিন্দায় মুখর হলেও তামিলনাড়ুর সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম বলেছেন, তিনি এই সিদ্ধান্তে অখুশি নন। কেননা, অপরাধীরা অনেক বছর জেল খেটেছে। আসলে লোকসভা ভোটের মুখে তামিল আবেগকে আঘাত করার ঝুঁকি নিতে নারাজ রাজ্যের কোনও নেতাই। অন্য দিকে, জাতীয় স্তরে রাজীব-আবেগকে কাজে লাগিয়ে ফায়দা তোলার আশায় জয়ার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মুখর হয়েছেন রাহুল গাঁধী।
তামিল-অঙ্কে সুর নরম একদা আফজল-কসাবের ফাঁসির দাবিতে সরব বিজেপি-রও। তামিলনাড়ুতে বিজেপি-র পায়ের তলায় মাটি নেই। কিন্তু লোকসভা ভোটের পরে জয়ললিতার হাত ধরার আশা করছে তারা। ফলে জয়ার তরফে এই বিতর্কিত ঘোষণার দিনে জোর গলায় প্রতিবাদ করেনি তারা। কিন্তু নরেন্দ্র মোদী গত কাল জেটলিকে ফোন করে দলের এই অবস্থানের বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন, “এতে তো শক্তিশালী রাষ্ট্র গড়ার দলীয় স্লোগানটাই লঘু হয়ে যাবে!” এর পরেই মুক্তির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মুখ খোলেন জেটলি।
কিন্তু কংগ্রেস জানে, সেই প্রতিবাদকেও চূড়ান্ত জায়গায় নিয়ে যাওয়া বিজেপি-র পক্ষে সম্ভব নয়। জয়ার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধার আশাতেই। আর সেই পরিসর কাজে লাগিয়েই জাতীয় রাজনীতির ময়দানে লাভের কড়ি ঘরে তুলতে চাইছে কংগ্রেস। |
|
|
|
|
|